সূত্র ১ [একজন ব্যতীক্রমী মহিলা। আমার মা। ডাক্তার গায়ত্রী দত্ত। অসীম দারিদ্র্যের ভেতর দিয়ে বড়ো হয়েছে, সরকারি ইশকুলে পড়ারও পয়সা ছিলো না- তাই প্রাইভেটে ম্যাট্রিক,ইন্টারমিডিয়েট সব পাশ করে ডাক্তারি পড়লো। পাশ করে অন্য চাকরি না পেয়ে অগত্যা সিকিমের রাজার অধীনে চাকরি।
আর এক দরিদ্র ছেলে। অমলেন্দু শেখর ঘোষ। যে আমার ঠাকুর্দার মৃত্যুতে শিবপুরের ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে সিনেমা হলের ম্যানেজারি থেকে মাস্টারি করে সংসার চালিয়ে শেষে সিকিমে ওভারসিয়ারি করতে গেছে।
দুই স্বপ্নবিলাসী মানুষ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলো। তারপর বহু পথ পেরিয়ে বাবা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর হয়ে সিভিল সার্ভিসে যোগ দিলো।]
একজন নারীকে শেখানো হয়। আজন্ম। তোমার যোনিই তোমার সম্মান। তাই ধর্ষণ হয়। প্যালিওলিথিক যুগে, অর্থাৎ যখন সবে অস্ত্র হিসেবে পাথরের ব্যবহার শুরু হয়েছে, তখন ছিলো মাতৃতান্ত্রিক সমাজ। নারী নিজেই তার পছন্দের শয্যাসঙ্গী বেছে নিতো। আবার বদলেও নিতো। তখনও নারীর পুরুষ নির্দিষ্ট এই কৌমার্য আর সতীত্বের সংজ্ঞা এসে পৌঁছয় নি। আজ একজন নারীকে বা তার পরিবারকে বা তার সমাজকে অসম্মানিত করার একমাত্র উপায়- নারীটিকে ধর্ষণ। কেউ যদি ভেবে থাকে (ভুলক্রমেও) শারীরিক সুখের জন্য ধর্ষণ হয়, তাহলে সেটা মারাত্মক ভুল। এটা কেবলমাত্র অসম্মান, অপমান করা।
ঠিক তেমনি আদি থেকে শেখানো হয়- ডাক্তার তোমার কাজ মহৎ। এ কাজ সেবা করার। অথচ সেবার বদলে পয়সা নিতে হবে। আরে ভাই জীবন তো বাসের ড্রাইভারও বাঁচায়, যখন উল্টো দিক থেকে, মাঝ রাত্তিরে উন্মাদ লরি ধেয়ে আসে। পেশা অথচ মহৎ। মহৎ পেশা। টুপি কিন্তু রঙিন টুপি।
সূত্র ২ [গঙ্গাজলহাটি। একটা প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র। ডাক্তার শ্রীমতি গায়ত্রী ঘোষ (দত্ত) দায়িত্বে আছেন। পুত্র সুন্দর লাল ঘোষ। দেড় বছরের ছেলে। আমার না দ্যাখা সেই দাদা, তখন নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত। মায়ের পক্ষে গঙ্গাজলহাটি ছেড়ে বেরোনো সম্ভব হয়নি- ছুটি নেই। এক দোল পূর্ণিমার ভোরে তাকে তার বাবা বেকার অমলেন্দু শেখর এক বিরাট শিমুল গাছের গোড়ায়, পৃথিবীর মাটিকে সেই শিশুর দায়িত্ব দিয়ে আসে। মাটি ঢাকা দিয়ে। হে শিমুল, হে আকাশ, হে অরণ্য তোমরা দেখো। আমাদের প্রথম সন্তানকে তোমাদের কাছে নিবেদন করলাম। এই দম্পতি আর কোনোদিন দোল খ্যালে নি। সব রং দিয়ে এসেছে ঐ শিমুলের গোড়ায়।
দ্বিতীয় হার্ট অ্যাটাকে যখন কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়ে মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে আসি তারপরেই ডাক্তার গায়ত্রী দত্তের (ঘোষ) স্মৃতি হারিয়ে যায়। একটু পরে পরেই বলতেন “তপ্পি, দন্ডক অরণ্যে যখন আমি হাসপাতালে যেতাম, তোর চারপাশে তুলোর সাপ বানিয়ে রেখে যেতাম। জানিস? তুই তো খুব শান্ত ছিলি ওর মধ্যেই থাকতি।” অমলেন্দু শেখর তখন অন্য কোথাও চাকরির সন্ধানে। পরে হীরক শঙ্কর দত্ত, আমার সেজমামা পড়া ছেড়ে ওখানে গিয়ে আমাকে সামলাতো।
“তপ্পি, দন্ডক অরণ্যে যখন আমি হাসপাতালে যেতাম….”]
ডাক্তার তুমি সন্ধেবেলা টাই পরে সেজেগুজে কোথায় যাও? সেবা করতে? নাকি খদ্দের ধরতে? যতো ভালো সাজগোজ, ঠাটঠমক, ততই বেশী তার কদর। এটা কোন মহৎ পেশা গো? ডাক্তারি না বেশ্যাবৃত্তি? ও আমার মহান পেশা!
ডাক্তারবাবু, আপনি সেবা করবেন? বিনা পয়সায় রোগী দেখবেন? আপনার চেম্বারের খরচ কে দেবে? কোন জমিদারীর খাজনা থেকে আপনার ভাতের খরচ আসবে? আসুন বরং ছুটির দিনে অবসর মতোন এক বেলা, হেলাফেলা সেবা করি?
“ডাক্তারবাবু, আমার থেকে থেকে শ্বাসকষ্ট হয়, দম ফেলতে পারি নে, ঘন ঘন দম ফেলি… ও ডাক্তার বাবু….”
“আমি সেবা করছি। যাও এক্স রে করে আনো”
“কিন্তু আমি তো সারা দিনমান মাঠে ঘাটে কোদাল করি… অন্যের বাড়ি বাগান কোপাই…”
“হুম ছবি তো নর্মাল, একটা ইকো আর চেস্ট সিটি করে আনো”
“কিন্তু যখন সন্ধ্যার পর বসে থাকি… ছেলেটার লক ডাউনে চাকরি গ্যাছে.. আইটিআই পাস… মেয়েটার কলেজ বন্ধ…তখন য্যানো শরীর ক্যামন করে… ঘন ঘন শ্বাস পড়ে… বুকে চাপ হয়ে আসে…”
“তোমার সিটি, ইকো সবই তো নর্মাল…একটু ভিটামিন খাও”
আমার সদ্য দেখা ঘটনা। চায়ের দোকানের রতনদা। তবু পড়ে থেকে যায় গরীবের দল।
যখন সূত্রধার এসে পড়ে সূত্রের মধ্যে। আমার তিন বছরের সন্তানকে খুনের হুমকি। এই থানা থেকে অন্য থানায়। সঙ্গে এক বৃদ্ধ। প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর। কে যাবে সাথে? সেই বৃদ্ধ মানুষটি আছে। বৃদ্ধ অমলেন্দু শেখর।
তারপর ভবানী ভবন। তৎকালীন ডিসিডিডি২ শ্রীঅনুপ চ্যাটার্জি। সেখানেও সেই বৃদ্ধ।
সময় পেরিয়ে যায়। সেই তরুণ চিকিৎসক দীপঙ্কর বৃদ্ধ হয়। পিজিতে শয্যাভাবে আমরি সল্ট লেক। কাঁপা হাতে বন্ড সই করছে সেই বৃদ্ধ। “ডাক্তার শর্মা, আমিও ডাক্তার। ডাক্তার গায়ত্রী ঘোষ, আমি কি ওটিতে থাকতে পারি?” রঞ্জনদা হেসে মহিলার মাথায় হাত বুলিয়ে দ্যায়। “মাসিমা, দীপঙ্কর আমাদের এক কলেজের… আমিই দেখবো”
তৃতীয় হার্ট অ্যাটাক। একা বুড়ো ডাক্তার আইসিইউতে। ট্রপ টি পজিটিভ। এখন ছাতা নেই। পাশে সেই বুড়ো বুড়ি নেই। “ওরে ভাষা নেই, নেই বৃথা বসে ক্রন্দন। ওরে গৃহ নেই নেই ফুলশেজ রচনা। আছে শুধু পাখা আছে মহানভ অঙ্গন। ঊষা দিশাহারা নিবিড় তিমির আঁকা…এখনও সমুখে রয়েছে সুচির শর্বরী,ঘুমায় অরুণ সুদূর অস্ত অচলে…”