আন্দোলন কথাটির অর্থ কি? যখন রাষ্ট্রের/সরকারের/মালিকপক্ষের দ্বারা নিপীড়িত, শোষিত, লাঞ্ছিত মানুষের প্রতিকার পাওয়ার উদ্দেশ্যে জানানো দাবী, একটা বিপুল তরঙ্গ তুলে বহু সংখ্যক মানুষকে সেই ঢেউয়ে শামিল করে নেয়, তাকে আন্দোলন বলে।
স্বাধীনতা উত্তর ভারতবর্ষ বহু আন্দোলন দেখেছে। তার কিছু হয়ত প্রান্তিক, কিছু দুলিয়ে দিয়েছে সারা দেশকে।
নানা বিষয়ের বিভিন্ন আন্দোলনের প্রসবভূমি এই ভারতে উপেক্ষিত রয়ে গিয়েছে কিছু নাম, চাপা পড়ে গিয়েছে ধূলিমলিন স্মৃতির নীচে। আজ যখন দেশের উত্তর পশ্চিম প্রান্তে একটি আন্দোলনকে দমন করতে রাষ্ট্রের পুলিশকে রাস্তায় গজাল পুঁততে দেখি, তখন নীচের মহলের আন্দোলনের মুখ একটি বিস্মৃতপ্রায় নাম ভেসে ওঠে মনের চোখে।
শঙ্কর গুহনিয়োগী।
তাঁর কথা আমি খবরের কাগজে কখনো পড়িনি। কারণ, যখন তিনি দেশের সমস্ত মুখ্য সংবাদপত্রগুলির হেডলাইন হতেন, তখন আমার নিয়মিত খবরের কাগজ পড়ার অভ্যাস হয়নি। এই নামটি আমি প্রথম শুনি আমার ডাক্তারির শেষ পরীক্ষা পাশ করার পরে, ইন্টার্নশিপ শেষ করে যখন হাউসস্টাফশিপ করছি, তখন। আমাদের হাউসস্টাফশিপের স্টাইপেন্ড ছিল নগণ্য। সেইটি আরো বাড়ানো উচিৎ, এমন একটি ঘরোয়া আলোচনার সময়, এক সিনিয়র দিদি বলেছিল — “এখানে তো অনেক টাকা পাচ্ছিস — জানিস, মধ্যপ্রদেশে এমন একটা জনসেবামূলক হাসপাতাল আছে, যেখানে বেতন বলতে শুধুই পেটচুক্তি খাওয়া আর কিছু হাতখরচ? আমাদেরই কিছু সিনিয়র দাদাদিদি গ্ল্যামারাস কেরিয়র উপেক্ষা করে সেখানে চলে গিয়েছে মানুষের জন্য কাজ করবে বলে, সে খবর রাখিস কিছু?”
সেই প্রথম শুনলাম শঙ্কর গুহনিয়োগী আর তাঁর শহীদ হাসপাতালের নাম। যদিও মানুষটি তখন আর এই পৃথিবীতে নেই।
তাঁর পিতৃদত্ত নাম ছিল ধীরেশ। অসমের নগাঁও জেলার এক গন্ডগ্রাম থেকে স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে, আসানসোলের কাছে সাঁকতোড়িয়ার খনি অঞ্চলে মামার বাড়িতে এগারো বারো ক্লাস পড়তে এসেছিলেন তিনি। তারপর পরিবারের চাপে এবং পৃষ্ঠপোষকতায় জলপাইগুড়ির ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হতে হয় ধীরেশকে। অন্যায্য সুবিধা চাননি তিনি। তাই কলেজ এবং গৃহ দুই-ই ত্যাগ করেন গড়পড়তা মানুষের চেয়ে অন্যরকম ছেলেটি।
এসে পড়েন মধ্যপ্রদেশে। ভিলাই স্টিল প্ল্যান্টের একজন শ্রমিক হিসেবে মাত্র আঠারো বছর বয়সেই শুরু হয় কর্মজীবন। সালটা ১৯৬১। পড়াশোনায় আগ্রহ ছিল, তাই কাজ করতে করতেই ভিলাইএর কলেজ থেকে স্নাতক হয়েছিলেন। কিন্তু সেই কলেজেই জড়িয়ে পড়েছিলেন ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে।
সেই রাজনীতির আঁচ এসে পড়ল ভিলাইয়ের শ্রমিক ইউনিয়নেও। শ্রমিকদের ন্যায্য বেতনের দাবিতে ডাকা হলো স্ট্রাইক। ছাঁটাই হলেন ধীরেশ।
ততদিনে বিভক্ত হয়েছে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি। সেটা ১৯৬৪ সালের কথা। ধীরেশ যোগ দিয়েছেন সিপিআইএম-এ।
ভিলাই স্টিল প্ল্যান্ট থেকে বিতাড়িত হওয়ার পরে আত্মগোপন করলেন তিনি। কিন্তু আন্ডারগ্রাউন্ড থাকা অবস্থাতেই আরম্ভ করলেন শ্রমিকদের সংগঠিত করার কাজ, তাদের দাবিদাওয়ার ব্যাপারে সচেতন করার জন্য সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘স্ফুলিঙ্গ’ প্রকাশ ও প্রচারের কাজও। সেই কাজে কখনো রাখাল বাগালের ছদ্মবেশে, কখনো ফেরিওয়ালা বা জেলের ভেক ধরে পৌঁছে গিয়েছেন মধ্যপ্রদেশের আদিবাসী অধ্যুষিত বস্তার, রাজনন্দগাঁও, দুর্গ, বিলাসপুর আর রায়পুর জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলিতে। মধ্যপ্রদেশ তখন লোহা, কোয়ার্টজাইট, বক্সাইট ইত্যাদি নানা ধাতুর স্বর্ণপ্রসূ খনির গর্ভগৃহ, আবার চূড়ান্ত শস্তা শ্রমেরও আকর।
এদিকে, পশ্চিমবঙ্গের নকশালবাড়ি থেকে জন্মানো আন্দোলন তখন ছড়িয়ে পড়েছে আশেপাশের রাজ্যেও।
CPI(M) থেকে CPI(ML) এ চলে গিয়েছেন ধীরেশ। যদিও, ১৯৬৯ সালে মতাদর্শের বিরোধের কারণে বিতাড়িতও হয়েছেন সেই দল থেকে।
তারপর কাজ নিয়েছেন দানিটোলা কোয়ার্টজাইট খনিতে। নাম নিয়েছেন শঙ্কর। বিয়ে করেছেন সহকর্মী সিয়ারামের কন্যা আশাকে।
এরপরে এসেছে ১৯৭৫ সাল। জরুরি অবস্থা। আরো অনেক শ্রমিক নেতাদের মতো শঙ্করও তখন জেলবন্দী।
ইতিমধ্যে, দানিটোলা থেকে অল্প দূরত্বে অবস্থিত দল্লি রাজহরা লৌহখনিতে বদলি এবং স্থায়ী শ্রমিকদের সমকাজে সমবেতনের দাবীতে শুরু হয়ে গিয়েছিল শ্রমিক অসন্তোষ।
এই ছাইচাপা আন্দোলনের আগুন খুঁজছিল একজন যোগ্য নেতা। শঙ্কর বুঝেছিলেন, সরকার এবং মালিকপক্ষের কাছ থেকে শ্রমিকদের জন্য ন্যায়সঙ্গত দাবী আদায় করতে গেলে তার সঙ্গে জড়িয়ে নিতে হবে ছত্তিশগড়ী আদিবাসীদের স্বাভিমান এবং স্বার্থের প্রশ্নও।
জরুরি অবস্থার অবসানে শঙ্কর ফিরলেন দানিটোলায়। দল্লি রাজহরার বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা পেয়ে গেল তাদের নেতাকে। ১৯৭৭এ শঙ্কর গুহ নিয়োগী তৈরি করলেন ছত্তিশগড় খনি শ্রমিক সংঘ।
লক্ষণীয়, এর আগে যে ট্রেড ইউনিয়নগুলি শ্রমিকস্বার্থরক্ষার্থে কাজ করছিল, যেমন আইএনটিইউসি, সিটু বা ভারতীয় মজদুর সংঘ— তারা কেউই শ্রমিকদের মজুরি, বোনাস বা এক্সগ্রাসিয়া ব্যতিরেকে অন্য কোনো চাহিদার কথা তাদের ইস্তাহারে পেশ করেনি।
শঙ্কর কিন্তু ভাবলেন। আট ঘন্টা ডিউটির সময় পার করেও, বাকি ষোল ঘন্টার ভালমন্দের কথা ভাবলেন, আর ভাবতে বাধ্য করলেন রাষ্ট্র তথা শিল্পপতিদেরও।
ছত্তিশগড় খনি শ্রমিক সংঘের পরিচালনায় শ্রম ও বেতন সংক্রান্ত বিভিন্ন দফতর ছাড়াও ছিল কৃষি, স্বাস্থ্য, খেলাধুলো, সংস্কৃতি বিষয়ক, শিক্ষা, সঞ্চয় প্রকল্প, গ্রন্থাগার, শরাববন্দি (মদ্যপান বিরোধী), ইত্যাদি নানা দফতর। শঙ্কর মনে করতেন শ্রমিকদের ঝরানো রক্তের বিনিময়ে অর্জিত টাকা যদি মদের দোকানের ক্যাশবাক্সে গিয়ে সঞ্চিত হয়, তবে আর বিপ্লব বা স্বাধিকার রক্ষার আন্দোলনের কি প্রয়োজন? এই শরাব-বন্দিতে তিনি শামিল করেছিলেন মেয়েদের— গড়ে উঠেছিল ছত্তিশগড় মহিলা মুক্তি মোর্চা। মহল্লায় মহল্লায় চলত প্রচার, আর নবলব্ধ জ্ঞান ও শিক্ষার আলোকে মদ্যপানের কুফল থেকে মুক্তি মিলেছিল অনেকটাই।
ধীরে ধীরে প্রসারিত হলো শ্রমিক সংঘের কর্মকান্ড। তৈরি হলো খনি শ্রমিকদের সন্তানদের জন্য প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, স্বাস্থ্য সম্মত শৌচাগার, ফুটবল তথা অন্যান্য খেলার মাঠ— আর ১৯৮২ সালের ২৬শে জানুয়ারি উদ্বোধন হলো একটি ডিসপেন্সারির। ১৯৭৭ সালে দল্লি রাজহরা মাইনসে বেতন বৈষম্যের বিরুদ্ধে শঙ্করের ডাকা শ্রমিকদের স্ট্রাইকে পুলিশের গুলিতে নিহতদের স্মৃতির উদ্দেশে এই ডিসপেন্সারির নাম হলো শহীদ ডিসপেন্সারি। ছোট এই ডিসপেন্সারি পরবর্তীতে পরিণত হলো শহীদ হাসপাতালে, যেখানে নামমাত্র বেতনে যোগ দিলেন পশ্চিমবাংলার সদ্য পাশ করা ডাক্তাররা— কেবল মাত্র আদর্শ আর পরহিতৈষাকে সম্বল করে।
ঐ ১৯৮২ সালেই গুহনিয়োগী এবং তাঁর সহযোগীদের হাতে জন্ম হলো ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চার।
প্রসঙ্গত, স্বতন্ত্র ছত্তিশগড় রাজ্য তখনো ভবিষ্যতের গর্ভে।
দল্লি রাজহরা লৌহখনিতে মেকানাইজেশনের বিরুদ্ধে তখন আন্দোলন শুরু করেছেন শঙ্কর। এই আধুনিক প্রযুক্তির প্রসার ও ব্যাপ্তি ঘটলে কাজ হারাবেন বহু শ্রমিক। কি হবে তাঁদের পুনর্বাসন বা ক্ষতিপূরণের? ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পুলিশ জেলে ভরে রাখল শঙ্করকে। সমস্যা কিন্তু মিটল না।
অশান্তি, হিংসা উত্তরোত্তর বেড়েই চলছিল। সেই সঙ্গে বাড়ছিল মোর্চার নেতৃস্থানীয়দের আভ্যন্তরীণ বিসম্বাদ।
ঐ একই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে এই বিষয়ে রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপ চেয়ে দিল্লী গেলেন গুহনিয়োগী। রাজধানী থেকে ফেরার সপ্তাহ দুয়েক পরেই, নিজের বাড়িতে ঘুমন্ত অবস্থায় অজানা আততায়ীদের গুলিতে খুন হয়ে গেলেন শঙ্কর গুহনিয়োগী।
নিম্ন আদালতে অভিযোগ প্রমাণিত হলেও, হাইকোর্টে একজন বাদে বাকি অভিযুক্তরা বেকসুর খালাস হয়ে গেল। তাদের মধ্যে ছিলেন দুজন শিল্পপতিও।
তারপর গঙ্গা দিয়ে গড়িয়ে গিয়েছে অনেক জল। আর্থসামাজিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে— হ্যাঁ, ছত্তিশগড়েও। গণতন্ত্রের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে পচন ধরেছে ঠিকই, কিন্তু গণতান্ত্রিক কাঠামোটি যে নির্ভুল এবং নির্বিকল্প, বারে বারে প্রমাণিত হয়েছে সেই কথা।
মানুষের শুভ করতে গেলে, মূলধারার রাজনীতিতে থেকেই পঙ্কোদ্ধার করতে হবে, এই বিশ্বাসেই সম্ভবত শঙ্কর গুহনিয়োগীর কন্যা মুক্তি, নির্বাচনে লড়ে, জিতে, দল্লি রাজহরা পৌরসভার কাউন্সিলর হয়েছেন।
বর্তমান দেশব্যপী রাজনৈতিক অস্থিরতা, গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধের রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টা, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, সেলিব্রিটিকুলের সরকারের নির্লজ্জ পদলেহন, শিক্ষাক্ষেত্রে সার্বিক নৈরাজ্যের অবসন্ন আবহে, সেই স্বল্পচর্চিত শ্রমিকদরদী মানুষটির কথা ভীষণভাবে মনে পড়ছে।
আজ বেঁচে থাকলে কি করতেন শঙ্কর গুহনিয়োগী? সক্রিয় আন্দোলন? রক্তক্ষয়ী বিপ্লব? না কি এই ভেবে আপস করে ফেলতেন পরিস্থিতির সঙ্গে, যে এতে লোকক্ষয় কমবে?
উত্তর জানা নেই।
চোদ্দই ফেব্রুয়ারি তাঁর ৭৮তম জন্মদিন। সকলেই ভ্যালেন্টাইন্স ডে পালন করলেন। আমি কেবল এই চির উপেক্ষিত স্বপ্নদর্শীকে সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করলাম।
চমত্কার থাম্বনেল স্কেচ । আপনাকে ধন্যবাদ । দাল্লি-রাজহরা ,বা সামগ্রিকভাবে ছত্তিশগড়ে ,শঙ্কর গুহনিয়োগী ও তাঁর সংগঠনের দীর্ঘ আন্দোলনের ফলশ্রুতি হিসেবে যে আর্থ-সামাজিক সদর্থক পরিবর্তনগুলো এসেছিল , হোমিও-ডাক্তার রমণ সিংয়ের স্বৈরতান্ত্রিক রাজত্বকালে তার প্রায় সবগুলোই ধুয়েমুছে গেছে মাওয়িস্ট জুজুর ভয় দেখিয়ে। এখন দেখা যাক ভূপেশ বাঘেলের আমলে অবস্থার উন্নতি কতটা হয় । তবে পরিস্থিতির খুব একটা আহামরি কোন পরিবর্তন হবে বলে মনে হয়না।