সময়ের সাথে সাথে অন্যান্য বিষয়ের মত চিকিৎসা বিজ্ঞানের নানান শাখাগুলিতেও অনেক উন্নতি ঘটেছে। প্রায় রোজই নতুন নতুন আধুনিক ওষুধ আবিষ্কার হচ্ছে এবং বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা সহজতর হচ্ছে। আধুনিক ওষুধগুলিকে আমরা অনেকে আবার এলোপ্যাথিক ওষুধও বলি। বিভিন্ন অপপ্রচার বা অতিরিক্ত সচেতনতা -যে কারণেই হোক না কেন অনেক মানুষের মানেই আধুনিক ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে কিছু ভ্রান্ত ধারণা তৈরী হয়েছে।
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ব্যাপারটা বোঝার আগে চলুন দেখি আধুনিক ওষুধ (মডার্ন মেডিসিন) কি ভাবে চিকিৎসার জন্য ব্যবহারের অনুমতি পায়।
ধরা যাক বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখলেন যে, কোনো এক ধরনের ওষুধ কোনো এক রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার করা যেতে পারে। তাহলে এরপর ওই ওষুধটি বিভিন্ন প্রাণীর ওপর প্রয়োগ করা হয়। যদি মনে হয় যে ওই ওষুধটি ব্যবহার করায় বিপদ নেই তাহলে সেটি মানুষের ওপর ব্যবহারের কথা ভাবা হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই যে এই ধাপটি অনেক ওষুধই পেরোতে পারে না এবং সেইসব ওষুধ মানুষের ওপর আর প্রয়োগ করা যায় না। এই ধাপটিকে প্রি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল( pre-clinical trial ) বলে এবং এই ধাপটি সম্পূর্ণ হতে ৩.৫ থেকে ৪ বছর সময় লাগে।
এর পরে সেই ওষুধটি মানুষের ওপর পরীক্ষামূলক ভাবে ব্যবহার করা শুরু হয়। এই ধাপটিকে বলা হয় ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল( clinical trial)। ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চারটি ভাগে বিভক্ত-
- প্রথম ধাপে(phase 1) ২০ থেকে ৮০ জন ইচ্ছুক রোগীর ওপর ওষুধটি প্রয়োগ করা হয়। এই ধাপের উদ্দেশ্য হল -ওষুধটি কিরকম মাত্রায় (dose)এ মানুষের দেহে ব্যবহার করা যেতে পারে তা জানতে পারা (সর্বোচ্চ বা সর্বনিম্ন মাত্রা কি তা বোঝার চেষ্টা করা)। কোন ওষুধ মানবদেহে বেশি মাত্রায় পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া করলে সেই ওষুধটি আর পরের ধাপগুলিতে ব্যবহার করা হয় না। এই ধাপ শেষ হতে ১ থেকে ১.৫ বছর সময় লাগে।
- দ্বিতীয় ধাপে(phase 2)-ওষুধটি ১00-৩00 রোগীর ওপর ব্যবহার করা হয়। এই ধাপে ওষুধের নিশ্চিত ফলদানের ক্ষমতা/কার্যক্ষমতা (efficacy) বিচার করা হয়। এই ধাপ সম্পূর্ণ হতে প্রায় 2 থেকে ৩ বছর সময় লাগে। গবেষণায় দেখা গেছে যে এই ধাপে ব্যবহৃত ওষুধগুলির মধ্যে কেবল এক তৃতীয়ংশ (৩৩%) এই ধাপটি ঠিক ভাবে পেরোতে পারে।
- তৃতীয় ধাপে (phase 3) বিভিন্ন দেশের অনেক রোগীর ওপর ওই ওষুধ প্রয়োগ করা হয় (কয়েক হাজার রোগীর ওপর)। ওই রোগে ব্যবহৃত অন্যান্য ওষুধের সাথে নতুন ওষুধটির গুণাগুণের তুলনামূলক আলোচনা করা হয়। ওই ওষুধের dose ও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে বিস্তারিত গবেষণা করা হয়। এই ধাপ সম্পূর্ণ হতে ২ থেকে ৫ বছর সময় লাগে।
- এর পর FDA (food and drug administration)এর কাছে ওই ওষুধটি ব্যবহারের জন্য আবেদন করা হয়। সমস্ত গবেষণা খতিয়ে দেখা র পারে যোগ্য মনে হলে FDA থেকে অনুমতি পাওয়া যায়। অর্থাৎ যদি কোন ওষুধের ব্যাপক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া থেকে থাকে তাহলে সেগুলি অনুমোদন পাবে না। কিন্তু এখানেই শেষ নয়।ওই ওষুধ বাজারে আসার পরেও বেশ কয়েকবছর ওই ওষুধের ওপর কড়া নজর রাখা হয় (post marketing surveillance)। সব মিলিয়ে সবকিছু ঠিকঠাক চললে ওই ওষুধটি বাজারে আসতে সময় লাগার কথা প্রায় ১২ বছর।
সুতরাং একথা বলা যায় যে শুধুমাত্র মনে হওয়ার ওপর ভিত্তি করে আধুনিক ওষুধ প্রস্তত বা ব্যবহার করা যায় না। অন্যদিকে বাজারে প্রচলিত আধুনিক ছাড়া অন্যান্য ওষুধগুলির ক্ষেত্রে ওষুধ প্রস্তুতির বিষয়ে কিন্তু এইরকম কোনো কড়া নিয়ম নীতি আছে বলে শোনা যায় না।
এবার যাই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কেন হয় সে বিষয়ে। আমাদের শরীরে বিভিন্ন অঙ্গে অনেক ধরনের রিসেপ্টর আছে। ধরা যাক কারো লিভারের সমস্যা আছে। তাহলে যেখানে সমস্যা (যেমন এখানে লিভার) আছে সেখানকার কোনো রিসেপ্টরকে টার্গেট করে ওষুধ বানানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু মুশকিল হলো এই যে শরীরের আরো অনেক জায়গাতেই কম সংখ্যায় হলেও ওই জাতীয় বা একই রকম বৈশিষ্টপূর্ণ রিসেপ্টর আছে। সুতরাং ওষুধ দিলে লিভারের সমস্যা কমবে কিন্তু অন্য অঙ্গের রিসেপ্টরগুলির ওপর এফেক্টের জন্য কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হবে (যেহেতু অন্যান্য অঙ্গে ওই রিসেপ্টরগুলির সংখ্যা কম তাই এই পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার ব্যাপ্তি কমই হয় এবং কোনো মারাত্মক অসুবিধা তৈরি হয় না)। সুতরাং ক্রিয়া থাকলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকা খুব স্বাভাবিক।আগেই বলেছি যে আধুনিক ওষুধের জন্মলগ্ন থেকেই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে গবেষণা করা হয় এবং সেগুলি কমানোর জন্য ডাক্তারবাবুও নানান উপায় বলে দেন। যদি কোনো ওষুধের মারাত্মক কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে তবে তা মানবদেহে ব্যবহারের জন্য অনুমোদিতই হয় না।
সুতরাং যাঁরা দাবি করেন বা বিজ্ঞাপন দেন যে তাঁদের ওষুধে বিন্দুমাত্র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই তাঁরা মনে হয় ঠিক দাবি করেন না| পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া না থাকার অর্থ সে ঔষধ কাজ ও করে না। ভেবে দেখুন যে জলের অপর নাম জীবন, সেই জলও মাত্রাতিরিক্ত পান করলে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হয়। তাই যেকোনো কার্যকরী ওষুধের কিছু হলেও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া থাকবেই। আর জানা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার (modern medicine-এর) থেকে অজানা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া (সেইসব ওষুধ,যেগুলি কোনো পরীক্ষা ছাড়াই, অনুমোদন ছাড়াই বাজারে পাওয়া যায়)তো আরো বেশী বিপজ্জনক।
খুব যুক্তিপূৰ্ণ.
Very important and useful information, sir. Thanks a lot.