– ডক্টর এই ওষুধের কোনও সাইড এফেক্ট নেই তো?
ডা. ঘোষ টেবিল থেকে মুখ তুলে ভদ্রলোককে আপাদমস্তক একবার দেখে নিয়ে মৃদুস্বরে বললেন..
– একদম নেই তা আর বলি কী করে? তবে যা আছে তাতে খুব বলার মতো কিছু ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা কম
– সে হোক.. আপনি সাইড এফেক্ট আছে জেনেও এইটুকু বাচ্চাকে ওষুধ লিখলেন? আপনি ডাক্তার হয়েও বাচ্চাটার কথা একবার ভাবলেন না?
আমাদের ডাক্তারবাবু চট করে মাথা গরম করেন না। এক চিলতে হাসি খেলে গেল তাঁর মুখে। যদিও মাস্কের আড়াল থাকায় বাইরে থেকে বোঝা গেল না। স্টেথো আর পেন টেবিলের ওপরে নামিয়ে রেখে ডা. ঘোষ চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন..
– প্যারাসেলসাসের নাম শুনেছেন?
ভদ্রলোক অন্যরকম কোনও উত্তর আশা করছিলেন। হঠাৎ আউট অফ দ্য সিলেবাস প্রশ্ন শুনে খানিক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন..
– অ্যাঁ?
– এই সুইস ভদ্রলোক পঞ্চদশ শতকের বিখ্যাত চিকিৎসক ও দার্শনিক। তাঁকে আধুনিক টক্সিকোলজি অর্থাৎ বিষবিদ্যার জনক বলা হয়।
– তো? আপনি কথা ঘোরাচ্ছেন কেন?
– আহা! চটেন কেন? গল্পটা শুনেই যান.. প্যারাসেলসাস বিষের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, “All things are poison and nothing is without poison, the dosage alone makes it so a thing is not a poison”
ডা. ঘোষের আপাত আগডুম-বাগডুম শুনতে শুনতে ভদ্রলোক উত্তেজিত হয়ে উঠছিলেন। ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে ঢকঢক করে জল গলায় ঢাললেন। ডা. ঘোষ কথা থামালেন না..
– অর্থাৎ কিনা, ডোজ বা মাত্রার ওপরেই নির্ভর করে কোনটা বিষ আর কোনটা নয়। এই কথাগুলো আজও ধ্রুবসত্য। যেমন ধরুন, এই যে আপনি জলটা খেলেন ওতে যদি আর্সেনিকের মতো কোনও অশুদ্ধি নাও থাকে তবু মাত্রাতিরিক্ত জল খেলে আপনার কিডনির ওপর চাপ পড়বে। সেই অর্থে জলও বিষ হয়ে যেতে পারে।
– ম-মানে?
– হ্যাঁ। এটাই সত্যি। মাত্রাজ্ঞান না থাকলে সবকিছুই বিষ। আবার ধরুন, এতজন ডিম, চিংড়ি বা সামুদ্রিক মাছ খাচ্ছেন অথচ বেছে বেছে কিছু মানুষের গায়ে চুলকুনি বেরোচ্ছে। তা বলে কি সেই খাবারগুলোকে দোষ দেবেন? এসব ওষুধেও হয়। যে ওষুধ খেয়ে হাজার হাজার জন সুস্থ হলেন সেই ওষুধেই কোনও রোগীর মারাত্মক অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশন হতে পারে। এমনকি রোগী মারাও যেতে পারেন।
– এসব আবার কী? মানে কেন?
– সোজা কথায় বলতে গেলে কারো শরীরের অনাক্রম্যতা তন্ত্রের কলকব্জার সাথে ওই ওষুধের বনিবনা হয় না। যদিও সেগুলো খুবই বিরল..
– তাই নাকি? আচ্ছা ওষুধ তৈরির সময় সাইড এফেক্টগুলো ধরা পড়ে না?
– বেশিরভাগই ধরা পড়ে। খুব মারাত্মক সাইড এফেক্ট হ’লে তখনই সেই ওষুধকে পত্রপাঠ বিদায় জানানো হয়। তবে ধরুন, যে সমস্যাগুলো অনেকদিন ব্যবহার না করলে হয় না সেগুলো আগে থেকে বোঝা মুশকিল। তার জন্য ওষুধ বাজারজাত হওয়ার পরেও কড়া নজরদারি চালানো হয়।
– ধরুন খুব খারাপ কিছু ধরা পড়লো..
– কী আবার? সে ওষুধ সরিয়ে নেওয়া হয়। এভাবে আজ অব্দি চারশোরও বেশি মডার্ন মেডিসিন তুলে নেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত নাম থ্যালিডোমাইড। ১৯৫৭ সালে তৈরি হওয়া এই ওষুধ মানসিক উদ্বেগ, অনিদ্রা ইত্যাদি রোগে ব্যবহার হ’ত। অন্যান্য সবার সাথে গর্ভবতী মায়েরাও এই ওষুধ খেতেন। ফলাফল হ’ল মারাত্মক। প্রায় দশ হাজার সদ্যোজাত শিশু বিকলাঙ্গ হয়ে গেল। তার মধ্যে চল্লিশ শতাংশ মারাও গেল। ১৯৬১ সালে ওষুধ নিষিদ্ধ করে দেওয়া হ’ল। পরে অবশ্য গর্ভবতী মা ছাড়া অন্যান্যদের কিছু কিছু বিশেষ রোগে এই ওষুধের ব্যবহার শুরু হয়। তাতে আর নতুন করে খারাপ কিছু পাওয়া যায় নি। এভাবেই ১৯৯৭ সালে ফেনফর্মিন, ২০০৪ সালে রোফেকক্সিব, ২০০৬ সালে গ্যাটিফ্লক্সাসিন, ২০১০ সালে রসিগ্লিটাজোনের মতো ওষুধগুলো নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
– তাই তো বলি.. এসব বিষাক্ত জিনিস বিশ্বাস না করাই ভালো। এই দেখুন.. জাস্ট দুফোঁটা। এসব ওষুধের কোনও সাইড এফেক্ট নেই।
বলে ভদ্রলোক কাঠের ছিপি দেওয়া লম্বা মতো ছোট্ট কাচের শিশি তুলে দেখালেন।
– ওই শিশির ওষুধের এফেক্টও নেই, সাইড-এফেক্টও নেই। ওতে মূল রাসায়নিকের একটি অণুও থাকে না। দ্রাবকের পরিমাণ বাড়াতে বাড়াতে ওতে বিশুদ্ধ অ্যালকোহল ছাড়া আর কিচ্ছু নেই। তার দু-ফোঁটায় কাজ বা অকাজ কোনোটাই হওয়ার কথা নয়। অবশ্য এসব বিকল্প ধারার ওষুধে অনৈতিকভাবে স্টেরয়েড থেকে শুরু করে অন্যান্য প্রচুর রাসায়নিক মেশানো হয়। সেসব ক্ষেত্রে বুঝতেই পারছেন..
– সে আপনি যাই বলুন.. আমি জেনেবুঝে সাইড-এফেক্ট হতে পারে জেনেও আপনার ওষুধ খাওয়াতে যাবো কেন?
– বাসে চড়েন?
– দেখুন, বারবার হেঁয়ালি ভাল্লাগে না। সোজা প্রশ্নের সোজাভাবে উত্তর দিন।
– বাসে চড়লে আপনার নাকে ধোঁয়া ঢোকে। তাতে ফুসফুসের ক্ষতি হয়। সেসব জেনে আপনি বাসে ওঠা বন্ধ করবেন নাকি?
ভদ্রলোকের মুখে কথা ফুটল না। ডা. ঘোষ মুখটা সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে আনলেন..
– সবটাই কস্ট-বেনিফিট অ্যানালিসিস। কী বুঝলেন? ওষুধগুলোর উপকারী দিক সাইড-এফেক্টগুলোর থেকে বহু বহুগুণ বেশি। তাই রাস্তায় নামলে ছোটোখাটো হোঁচট উপেক্ষা করেই এগিয়ে যেতে হয়। এমনিতেই ওষুধ তৈরি আর বাজারজাত হওয়ার প্রক্রিয়া অনেক দীর্ঘমেয়াদী ব্যাপার। বর্তমান নিয়মে খুব মারাত্মক ক্ষতিকর ওষুধ বাজারজাত হওয়া প্রায় অসম্ভব।
– বলছেন?
– আর একটা কথা শুনে রাখুন, যারা বলে ওষুধের সাইড-এফেক্ট কিচ্ছু নেই সে হয় মিথ্যে কথা বলে অথবা সেটা আদৌ ওষুধই নয়। বোঝেনই তো, চিটফান্ডেই অল্প সময়ে বেশি লাভের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
– সে নয় বুঝলাম। একটা কথা বলুন, ওই যে দশ হাজার বাচ্চা বিকলাঙ্গ হ’ল তাদের জীবনের দাম নেই? তারা তো নতুন পরীক্ষার বলি হয়ে গেল..
– কে বলল তাদের জীবনের দাম নেই? ওটা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক ঘটনা। কিন্তু যদি এসব ভেবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা বন্ধ করে দেওয়া হয় তাহলে নতুন ওষুধ আসবে কীভাবে? বিজ্ঞানের আশীর্বাদ যা এসেছে সবই কিছু না কিছু মূল্যের বিনিময়ে। বিনা রক্তপাতে কোনও যুদ্ধজয় হয় না। ওষুধ বিজ্ঞানের নিত্যনতুন আবিষ্কার যত সংখ্যক মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে সে তুলনায় এই সংখ্যাটা কিছুই নয়। এই ব্যর্থতা আমাদের কাছে বেদনাদায়ক নিশ্চয়ই। এই ব্যর্থতা আমাদের আরও সতর্ক হতে বলে কিন্তু কোনও যুক্তিতেই ব্যর্থতার কাছে মাথা নত করা যায় না।
– আসলে এসব কথা..
– জানতেন না, তাই তো? আমাদের দুর্ভাগ্য, জ্ঞান আর যুক্তির আলো এখনো টিমটিমে। মডার্ন মেডিসিন ছাড়া অন্য কোথাও সাইড-এফেক্ট বা ওষুধ বিজ্ঞানের অন্যান্য বিষয়ে প্রতিদিন প্রতিঘন্টায় নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলে না। ট্রেনে-বাসে-গুমটি দোকানে বিক্রি হওয়া অজানা জড়িবুটি বা কাগজে মোড়া ওষুধের সাইড-এফেক্ট নিয়ে কেই বা ভাবে? কোনও উন্নত দেশে এসব সাইড-এফেক্টহীন বলে দাবী করা ওষুধ রমরমিয়ে চলে না। ধরুন, আমি যদি বলি তাবিজ পরালে দড়ির ঘষা লেগে বাচ্চার চামড়ায় ঘা হয়, ছত্রাক সংক্রমণ হয়.. আপনি বাচ্চাকে তাবিজ পরানো বন্ধ করবেন?
– মানে ওই একটু-আধটু বিশ্বাস.. বোঝেনই তো..
– ওই একটু-আধটু বিশ্বাসের গেরো কেটে দেশ আর এগোতে পারে না.. অন্ধবিশ্বাস নয়, বিজ্ঞান মানুন। অন্ধবিশ্বাস, কিছু ধর্মীয় গোঁড়ামি আর বিকল্প ধারার ক্রমাগত কুৎসা এদেশে টিকাকরণকেও সম্পূর্ণ সফল হতে দেয় নি। তাঁরা খুঁজে খুঁজে এক কোটির মধ্যে একজনের শরীরে খারাপ প্রভাবের কথা ফলাও করে প্রচার করেন। আর তাঁদের কথায় বিশেষত প্রান্তিক মানুষের একাংশ বিপথে চালিত হন।
– আসলে অনেক ভুল ধারণা ছিল..
– তাতে দোষ নেই। সবারই ওরকম কিছু কিছু ভুল ধারণা থাকে। নতুন যা শিখলেন সেগুলো আর পাঁচজনকে জানান। যাক গে, ওষুধটা নির্দ্বিধায় বাচ্চাকে খাইয়ে দিন। জ্বরটা বাড়ছে..
– হ্যাঁ, হ্যাঁ.. দিচ্ছি ডক্টর..