এবার আক্ষরিক অর্থেই হাঁফিয়ে উঠছি। একে এই বেয়াড়া ভ্যাপসা গরম, তার ওপর নাক-মুখ চেপে বসে আছে এন ৯৫। গলগলিয়ে ঘামছি। চট করে মাস্ক খোলারও উপায় নেই। কখন অজান্তে নাকে-মুখে হাত লেগে যায়… গলা শুকিয়ে কাঠ।
সাধারণ রোগীর সংখ্যা অনেক কমলেও আশঙ্কাজনক রোগী আসার বিরাম নেই। একেকজন খারাপ রোগী এলে অন্তত চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় যায়। দু’দন্ড বসার জন্য অনকল রুমে এলেও বসে থাকা যাচ্ছে না। ছেঁড়া চাদর পাতা লোহার খাট রোদের তাপে জ্বলছে যেন! নয় নয় করে বেশ অনেকগুলো বছর শুধু শিশুদের চিকিৎসা নিয়েই গেল। এই ভরা গরমে এত জ্বর, সর্দিকাশি, শ্বাসকষ্ট কোনোদিন দেখিনি। দূরদূরান্ত থেকে আসা রোগীদের অনেকের বাড়িতেই দু-তিনজন বা তারও বেশি জ্বরের রোগী। কারও করোনা পরীক্ষা করা হয়নি। করোনা হ’তে পারে এটা মানতেও অনেকের আপত্তি। পরীক্ষা করা হয়নি কেন জিজ্ঞেস করলে সপাট জবাব আসছে, “না, না… সেরকম কিছু নয়। সামান্য ঠান্ডা লেগে দু’দিন একশো জ্বর এসেছিল। করোনা-টরোনা নয়। পাড়ার ডাক্তারের অ্যান্টিবায়োটিক খেয়েই ঠিক হয়ে গেছে।” কে কাকে বোঝাবে- চোখে দেখে করোনা কিনা বোঝার মতো বড়ো ডাক্তার এখনও পাওয়া যায়নি। পরীক্ষা করালে এই ‘সামান্য ঠান্ডা লেগে জ্বর’-এর অনেকেরই করোনা রিপোর্ট পজিটিভ আসবে। তাঁরা নিজেদের আলাদা রাখারও প্রয়োজন বোধ করছেন না। প্যারাসিটামল খেয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন এদিক-ওদিক। এরকম বেশ কিছু বাড়ির বাচ্চারা গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর তাদের রিপোর্ট পজিটিভ আসছে। করোনার সংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে নিজেদের মতো উপসংহার টানার আগে এরকম অনেক কিছু মাথায় রাখা দরকার।
মারীর সাথে আপাতদৃষ্টিতে সম্পর্কহীন হলেও কেন জানি না হঠাৎ করে কৌটোর দুধ খাওয়ানোর প্রবণতা বড্ড বেড়ে গেছে। ‘দুধ হচ্ছে না’ বলাটা যেন প্রায় ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ সঠিকভাবে খাওয়ালে আর প্রয়োজনীয় উপদেশগুলো মেনে চললে এসবের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাইরের দুধ লাগবে না। জিজ্ঞেস করছি, বাচ্চা পেচ্ছাব ভালো (সারাদিনে অন্তত ছ’ থেকে সাতবার) করছে? দুধ খেয়ে ঘন্টাদুয়েক ঘুমোতে পারছে? ওজন বাড়ছে? এদের সবগুলোরই উত্তর আসছে- ‘হ্যাঁ’। ফুটো বালতির উদাহরণ দিয়ে বোঝাচ্ছি- বালতিতে জল না থাকলে জল ঝরছে কীভাবে? অনেকেরই ধারণা, বাচ্চা হওয়ার প্রথম দিন থেকেই বুঝি বালতি বালতি দুধ হবে। আসলে সদ্যোজাত শিশুর পাকস্থলীর আকার একটা চেরি বা মার্বেলের মতো। ওইটুকু দুধই তার একবার খাওয়ার জন্য যথেষ্ট। স্তনবৃন্ত ভেতরের দিকে ঢুকে থাকলে, রাতে না খাওয়ালে, বাচ্চাকে সঠিকভাবে না ধরলে, মায়ের জল খাওয়া কমে গেলে, পুষ্টির অভাব হ’লে কিংবা মানসিক চাপে দুধ কমে যেতে পারে। সেগুলোর দিকে নজর না দিয়েই চামচে ঠকাঠক করে দুধ গুলিয়ে খাইয়ে বাচ্চাগুলোর সর্বনাশ করা চলছে। বাচ্চা একবার বাইরের দুধের মিষ্টি স্বাদ পেয়ে গেলে আর বুকের দুধ খেতে চায় না। শুধু ওজনে বেড়ে ফুলতে থাকে। সঠিক পুষ্টি হয় না। ইমিউনিটি গড়ে ওঠে না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এটাও সত্যি, শহরের অনেক নামকরা কর্পোরেট হাসপাতাল স্তন্যদানের ব্যাপারে উৎসাহ দেয় না। গরমে কাহিল অবসন্ন শরীরে বুকের দুধ খাওয়ানোর কথা বলতে বলতে এবার সত্যি সত্যি হতাশ হয়ে পড়ছি। অনেকে আবার বুকের দুধ বাড়ানোর আশায় এলাচ গুঁড়ো, চিনিগুঁড়ো ভরা কৌটো খেয়েই যাচ্ছেন। কে বোঝাবে, এগুলো খেয়ে বুকের দুধ বেড়ে যাওয়ার কোনও প্রমাণ নেই… শুধু শুধু পয়সা নষ্ট।
নতুন করে লকডাউনে স্বাস্থ্যকর্মীরা অনেকেই সঠিক সময়ে কর্মস্থলে আসতে পারছেন না। বহু বহু স্বাস্থ্যকর্মী রোজ আক্রান্ত হচ্ছেন। প্রায় প্রতিদিনই একাধিক জনের সব ছেড়েছুড়ে চিরমুক্তির সংবাদ আসছে। সাধারণের জন্য টিকা অপ্রতুল। সুড়ঙ্গের শেষে আলোর হদিশ এখনো অধরা।
আমার তবু মাথার ওপর ছাদ আছে। একটু অসময় হলেও দু’বেলা নিশ্চিত ভাত আছে। বেশ ক’মাস হ’ল ছোট্ট একখানা চারচক্রযানও হয়েছে। যাতায়াতের অসুবিধে নেই। ভীষণরকম স্বার্থপরভাবে ভালো আছি। পিপিই, গাউন, গ্লাভস, মাস্ক, ক্যাপের বর্ম পেরিয়ে দৃষ্টি যায় না বেশিদূর। চিৎকার করতে গেলে শুকিয়ে যাওয়া গলা আগে ক’ফোঁটা জলের আদর চায়। ওই যে বাইরে কুকুরটার খান পাঁচেক খুদে খুদে বাচ্চা হয়েছে, সারাক্ষণ কিলবিলিয়ে ঘুরে বেড়ায়… অন্যসময় হ’লে মনটা বেশ হাল্কা হয়ে যেত। দমবন্ধ করা কাজের পরিবেশ সামলে আর কোনোদিকে তাকাতে ইচ্ছে করে না। আপাতত ছুটি চাই, বৃষ্টি চাই, ঘুম চাই…
(ছবিটি গুগল সূত্রে প্রাপ্ত)