কসাই ডাক্তার
অনেক চেষ্টা করেও পজিটিভ থাকা যাচ্ছে না। রবিবার রবি ঠাকুরের জন্মদিন ছিল। ওনার গান একবারে পজিটিভিটির চূড়ান্ত। সাতসকালে স্কুটারে ঘোলার চেম্বারে যেতে যেতে গুনগুন করছিলাম,
“আমি ভয় করব না ভয় করব না।
দু বেলা মরার আগে মরব না, ভাই, মরব না॥
তরীখানা বাইতে গেলে মাঝে মাঝে তুফান মেলে—
তাই ব’লে হাল ছেড়ে দিয়ে কান্নাকাটি ধরব না”॥
গায়ে দু’ফোঁটা জল পড়তেই চমকে গান থামালাম। তরী বাইবার সময় তুফান এলে তবু মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু স্কুটার চালানোর সময় বৃষ্টি এলে মুশকিল। তার উপর আবার রেনকোট আনিনি।
যেই প্রথম রোগী খক খক করে কাশতে কাশতে খুপরিতে ঢুকলেন, গাটা সিরসির করে উঠল। বেশ বুঝলাম আজ সারাদিন ভূতুড়ে অক্সিজেন স্যাচুরেশনের রোগী দেখতে দেখতে কাটবে।
প্রথম রোগীর অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৮৭%। আমি পালস অক্সিমিটার নেড়েচেড়ে দেখলাম। চাইনিজ মাল, ঠিক আছে তো? তবে ইদানীং চীন দেশীয় করোনা যা খেল দেখাচ্ছে, তাতে চাইনিজ জিনিসপত্রের উপর শ্রদ্ধা ফিরে আসছে। পালস অক্সিমিটারটা নিজের হাতে লাগালাম। স্যাচুরেশন ৯৯%। ঠিকই আছে।
ভদ্রলোক বললেন, ‘ডাক্তারবাবু, পাঁচদিন ধরে জ্বরে ভুগছি। পরীক্ষা টরীক্ষা করে লাভ নেই। আমি শিওর আমার করোনা হয়েছে। সেই মতো ওষুধ দেন। আসলে প্রপার ওষুধটা পড়ছে নাতো, তাই জ্বরও কমছে না।’
এই সব ইয়ে পাকা রোগীদের হাড়ে হাড়ে চিনি। তবু গালি দিলাম না। আহা বেচারা, বাঁচবে কী মরবে ঠিক নেই। বলুক, যা ইচ্ছে বলে নিক। শান্ত ভাবে বললাম, ‘পরীক্ষা না করেই ধরে নেবো?’
ভদ্রলোক বললেন, ‘পরীক্ষা না দিয়ে ছেলেমেয়েরা উচ্চমাধ্যমিক, মাধ্যমিকের মার্কশিট পেয়ে যেতে পারে, আর আপনি পরীক্ষা না করে বলতে পারবেন না এটা করোনা কিনা?’
বললাম, ‘বিলক্ষণ পারব, আপনার নিশ্চিত করোনা হয়েছে। তবে ওষুধ দিতে পারব না। কারণ আপনাকে এখনি ভর্তি হতে হবে। আপনার স্যাচুরেশন ৯০% এরও নীচে।’
ভদ্রলোক বললেন, ‘কী যাতা বলছেন। আমি দিব্যি হাঁটাচলা করতে পারছি। হাঁটতে গেলে সামান্য একটু হাঁফ ধরছে। তা জ্বর হলে সেটুকু হাঁফ তো ধরতেই পারে, কী বলেন?’
কী আর বলব। বললাম, ‘দেখুন, কোভিডে যেটা হয় তাকে বলে সাইলেন্ট হাইপক্সিয়া। রোগীর তেমন কোনো সমস্যা হয় না, অথচ অক্সিজেন স্যাচুরেশন ক্রমশ কমতে থাকে। আর সমস্যা যখন শুরু হয়, ততোক্ষণে বড় দেরী হয়ে যায়। আপনি এক্ষুণি নিকটবর্তী সরকারি হাসপাতালে যান, গিয়ে অক্সিজেন, স্টেরয়েড, নেবুলাইজেশন ইত্যাদি নেন। ওখানে কোভিডের র্যাপিড টেস্টও হয়ে যাবে। বাড়ি বসে থেকে নিজের জীবনের ঝুঁকি নেবেন না।’
ভদ্রলোক অত্যন্ত অসন্তুষ্ট মুখে বিদায় নিলেন। আমার উপর অসন্তুষ্ট হন, তাতে অসুবিধা নেই, কিন্তু ওনার জীবনটা বেঁচে যাক।
পরের ভদ্রলোক রোগী আনেননি। ওনার মায়ের কোভিড হয়েছে। বাড়িতে রেখেই চিকিৎসা করছেন। সেটা নিয়েই আমার সাথে আলোচনা করতে এসেছেন।
ওনার বক্তব্য শুনে বুঝলাম মায়ের অবস্থা ভালো নয়। বাড়িতে রেখেই অক্সিজেন দিচ্ছেন। স্যাচুরেশন অক্সিজেন দিলে ৮৫- ৮৬% এর কাছাকাছি থাকছে। অক্সিজেন বন্ধ করলে ৮০% এর নীচে নেমে যাচ্ছে। ওনার মা খাওয়া দাওয়া প্রায় বন্ধই করে দিয়েছেন। লিকুইড ছাড়া কিছুই খেতে পারছেন না।
বললাম, ‘এতো ঝুঁকি নিয়ে বাড়িতে রেখে দিয়েছেন কেন? কোথাও ভর্তি করছেন না কেন?
ভদ্রলোক উত্তর দিলেন, ‘মা হাসপাতালে ভর্তি হতে চাইছেন না।’
বললাম, ‘কেউ কী সাধ করে হাসপাতালে ভর্তি হতে চায়। বাধ্য হয়েই হতে হয়।’
‘হাসপাতালে ভর্তি হলে শুনছি কেউ বেঁচে ফিরছেন না। আমাদের পাড়ার একজন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, কালকে মারা গেছেন।’
বললাম, তিনিও নিশ্চিৎ আপনার মায়ের মতো তিনদিন ধরে বাড়িতে অক্সিজেন নিয়ে তারপর ভর্তি হয়েছিলেন। আর হাসপাতাল থেকে ছুটি পাওয়ার পর অনেকেই তো দেখাতে আসছেন। তাঁদের কাউকে দেখেই তো আমার ভূত বলে মনে হয়নি।’
ভদ্রলোক বললেন, ‘আপনি একটু দেখুন ডাক্তারবাবু। একবার ওষুধপত্র গুলো ঠিক ঠাক চলছে কিনা দেখে দিন।’
ভালো করে দেখলাম। যা যা ওষুধ চলার কথা সবই চলছে। এন্টিবায়োটিক, নেবুলাইজেশন, স্টেরয়েড, ব্লাড থিনার, এমন কী এন্টি ভাইরাল ওষুধও খাচ্ছেন। বললাম, ‘সবই তো চলছে, এরপর উন্নতি না হলে ভর্তি করা ছাড়া দ্বিতীয় বিকল্প নেই।’
ভদ্রলোক অধির হয়ে বললেন, ‘আর কোনো ওষুধ দিলে কী উন্নতি হতে পারে। আপনি যদি একটু সাহায্য করেন। সরকারি হাসপাতালে নাকি রোগীদের ফেলে রেখে দিচ্ছে। ডাক্তার- নার্স কেউ রোগীর ধারে কাছে যাচ্ছে না। বিনা চিকিৎসায় সবাই মারা যাচ্ছে।’
রেগে মেগে বললাম, ‘সরকারি হাসপাতালের উপর ভরসা না থাকলে বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করুন।’
‘সেগুলো তো একেকটা ডাকাত। দরকার না থাকলেও রোগীকে ভেন্টিলেটরে তুলে মেরে ফেলবে, আর লাখ লাখ টাকা বিল করবে।’
মাথা বেশ গরম হয়েছে। ভদ্রলোককে অনেকক্ষণ বোঝানোর চেষ্টা করেছি, কিন্তু ইনি সহজে বোঝার লোক নন। ছোটো চিরকুটে একটা ফোন নাম্বার লিখে ভদ্রলোককে দিয়ে বললাম, ‘এইটা যত্ন করে রেখে দিন। আপাতত আপনাকে এই একটা মাত্র সাহায্যই করতে পারি।’
ভদ্রলোক অবাক হয়ে বললেন, ‘এটা কী?’
‘দেখুন, এখন করোনায় মারা গেলে হাজার ঝামেলা। যে কোনো শববাহী গাড়িতে মৃতদেহ নিয়ে যেতে পারবেন না, বিশেষ গাড়ি জোগাড় করতে হবে। কেউ মৃতদেহ তুলতে রাজী হবে না। যদি বা কেউ রাজী হয়, পিপিই কিট চাইবে। যে কোনো শ্মশানে মৃতদেহ দাহ করতে পারবেন না। সেই আলমবাজার শ্মশানে যেতে হবে। এটা একটা সংগঠনের ফোন নাম্বার যারা মাত্র দশ হাজার টাকা দিলেই বাড়ি থেকে মৃতদেহ তুলে নিয়ে গিয়ে দাহ করে দেবে। আপনাদের কোনো ঝামেলা থাকবে না।’
ভদ্রলোক সম্ভবত আমাকে গালাগালি দিতে দিতে খুপরি থেকে বেড়িয়ে গেলেন। এজন্যই ডাক্তারদের সবাই কসাই বলে।