হাত দুটোর কী বিশ্রী অবস্থা! তাকাতে পর্যন্ত ইচ্ছে করে না। আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে সাদা সাদা হাজা, হাতের তালুতে… ইস। নখগুলো অবধি কালো হয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অথচ খুব যে একটা জল ঘাঁটতে হয় শ্রীপর্ণাকে, তা নয়। বয়সও তেমন নয়, এই সবে মাঝ-চল্লিশ। ওষুধে কমে, তবে সাময়িক, ফের হয়। ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান ডাঃ সমাদ্দার রেফার করলেন ত্বক বিশেষজ্ঞ ডাঃ সান্যালকে।
কোনো ওষুধ লেখার আগে রক্ত পরীক্ষা করতে দিলেন ভদ্রলোক। ব্লাড সুগার। হাসিই পেল শ্রীপর্ণার। ব্লাড সুগার? সে তো বুড়োদের ব্যাপার। তার কেন সেসব হতে যাবে? রিপোর্ট দেখে ভুরু জোড়া প্রায় ইঞ্চিখানেক ওপরে ঊঠে গেল ডাঃ সান্যালের।
-করেছেন কি? স্বাভাবিকের প্রায় তিনগুণ বেশি শর্করা শ্রীপর্ণার রক্তে। ডায়াবেটিস! –তাহলে হাতের এই অবস্থা…
– হ্যাঁ ডায়াবেটিস থেকেই। আপনি এক কাজ করুন। ওষুধগুলো খান আর রিপোর্টটা গিয়ে বরং দেখান ডাঃ সমাদ্দারকে। এ রোগের ওষুধ উনিই বলে দেবেন।
শ্রীপর্ণার গল্পটা কিন্তু গল্প নয়। নামগুলোই শুধু আলাদা, নইলে ঘটনাটা সত্যি।
হ্যাঁ, অনেক রকম ত্বকের অসুখ হতে পারে ডায়াবেটিস থেকে। এক এক করে বলি –
শ্রীপর্ণার যেমন হয়েছিল ছত্রাকজনিত চর্মরোগ ক্যানডিডিয়াসিস, এছাড়াও জীবাণুঘটিত সংক্রমণ ঘটতে পারে। হতে পারে ফোঁড়া, কার্বাঙ্কাল, সারতে না চাওয়া বিশ্রী ঘা। নখেও ছত্রাক সংক্রমণ হতে পারে। ছেলেদের ক্ষেত্রে খুব বেশি হতে দেখা যায় পুরুষাঙ্গের সামনের ত্বকে এবং লিঙ্গমুন্ডে প্রদাহ। বার বার এই প্রদাহ হতে থাকলে দেখা দিতে পারে ফাইমোসিস। ক্যানডিডাল ভালভোভ্যাজাইনাইটিস জনিত সমস্যায় ভুগতে পারেন মহিলারা। পায়ু আর যৌনাঙ্গে অসহ্য চুলকানি অনেক সময় ডায়াবেটিসের হাত ধরে আসে। এছাড়া পায়ে, ঊরুতে এক ধরনের ছোট ছোট কালো, বসে যাওয়া দাগ হতে দেখা যায় ডায়াবেটিক রোগীদের শতকরা প্রায় পঞ্চাশ জনের ক্ষেত্রেই। একে বলে ডায়াবেটিক ডার্মোপ্যাথি। এছাড়া পায়ে বা হাতেও আপনা থেকেই ফোস্কা হতে পারে। বেদনাহীন স্বচ্ছ ফোস্কা। ৩-৫ সেমি পর্যন্ত বড় হতে পারে ফোস্কাগুলো। তবে আবার সেরেও যায় আপনা থেকেই। এগুলো হল ডায়াবেটিক বুলি।
আর হতে পারে ইরিসিপেলাস জাতীয় অসুখ, পায়ের নীচে হোয়া ঘা, যার সঙ্গে থাকবেই নার্ভের সমস্যা। এই ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথিতে ভোগেন প্রধানত বয়স্ক মানুষেরাই। হাতে-পায়ে অসাড়তা, ঝিনঝিনে ভাব, ব্যথা এবং জ্বালার অনুভূতিও হতে পারে। অনেক সময় আক্রান্ত অংশটা ঘামছে না এরকম দেখা যায়। ডায়াবেটিক গ্যাংগ্রিন-ও হতে পারে অসাবধান হলে।
সারা গায়ে বের হোয়া হলদেটে, দানাদানা ইরাপটিভ জ্যান্থোমেটোসিস সঙ্গে চোখের কোণে জমা সাদাটে জ্যান্থোলেসমা কিন্তু অনেক সময়ই ডায়াবেটিসের সঙ্গে ধরাধরি করেই আসে।
আর হতে পারে ঘাড়ে, বগলে কালচে ময়লার মতো দেখতে অ্যাকান্থোসিস নিগ্রিকানস।
এছাড়া আরো কিছু লম্বা নামের অসুখ যেমন নেক্রোবায়োসিস লিপয়ডিকা ডায়াবেটিকোরাম, ডায়াবেটিক মাইক্রোঅ্যাঞ্জিওপ্যাথি হতে দেখা যায় ডায়াবেটিক রোগীদের। পারফোরেটিং ডার্মাটোসিস হলেও সাবধান হোয়া ভালো। একবার রক্তটা পরীক্ষা করানো উচিত। অথবা আরেকটা ত্বকরোগ লাইকেন প্লেনাস, সেটা হলেও তাই।
সারা গা চুলকাচ্ছে, অথচ বহুবার চুলকানির ওষুধ খেয়েছেন বা মেখেছেন। একবার রক্তটা শুধু পরীক্ষা করে নিন। কিছুদিন আগে অবধি এই জেনারেলাইজড প্রুরাইটাস-কে ডায়াবেটিসের একটি লক্ষণ বলেই মনে করা হত।
দেখা গেছে, ডায়াবেটিস রোগীদের শতকরা দশ জনের শ্বেতি হতে পারে। অথবা পারনিশিয়াস অ্যানিমিয়া কিংবা থাইরয়েডের সমস্যা।
না আতঙ্কিত হবার কিছু নেই। ডায়াবেটিস এমন একটি অসুখ, ঠিক ধরা পড়লে আর ঠিকঠাক চিকিৎসা চললে চমৎকার থাকা যায়।
ত্বক আমাদের দেহের আবরণ। তাতে ফুটে ওঠা কিছু অসুখের কথা জেনে রাখাই ভালো। এই সচেতনতাটা জরুরি। অসুখ-অসুখ বাতিক নয়। সাব-ধানতা। আর জানেনই তো, সাবধানের মার নেই।