হিন্দুস্থান মোটর্সের চাকরিটা ছেড়ে বাবা শেষ অবধি আরেকটা নতুন চাকরি জোগাড় করেই ফেলল। কোনো সুপারিশে না। নিজের চেষ্টাতেই।
ক্লাস থ্রি থেকে ফোরে প্রোমোশনের রিপোর্ট কার্ড হাতে, দু’খানা ঢাউস কালো ট্রাঙ্ক আর পেটমোটা বেডিংএর পিছন পিছন, বাবা আর মায়ের কড়ে আঙুল ধরে, এক শীতের দুপুরবেলা আমি নামলাম খড়গপুর স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। বাবা বলেছিল — “এশিয়ার সেকেন্ড লংগেস্ট স্টেশন প্ল্যাটফর্ম, বুঝলি বাপি?”
আমি তখন ঠাকুরদাদার মনখারাপি বাড়ি থেকে মুক্তির আনন্দে টগবগ করে ফুটছি।
“যে বাড়িটায় আমরা থাকব, ওটা নতুন বাড়ি, না বাবা?”
“হুম”।
“চাদ্দিকে অনেক বাড়ি, বাবা? জঙ্গল নেই, তাই না?”
“জঙ্গল ভয় পাস, বলিসনি তো কখনো। না, পাড়ার মধ্যে বাড়ি, দু’চারটে গাছপালা থাকতে পারে আশেপাশে — জঙ্গল নেই রে”।
“আর বাথরুমে বড় বড় মাকড়সা? নেই তো বাবা?”— ঠাকুরদাদার বাড়ির অতীত আতঙ্ক কাঁপিয়ে দেয় আমার গলা। বাবা হেসে ওঠে শব্দ করে।
পিছন থেকে মা ফুট কাটে — “বাড়ির তত্ত্ব নিতে হবে না খুকু। এখানে কিন্তু নতুন স্কুল। খুব কড়া। অ্যাডমিশন টেস্টের জন্য তৈরি হ’ এবার”–
কড়া ইস্কুল! নতুন জায়গায় আসার আনন্দটা খানিকটা হলেও ফিকে হয়ে যায় আমার চোখে। বুকটাও দমে যায় একটু।
ফ্যাকটরির নাম ওয়েস্ট বেঙ্গল স্কুটার্স। জায়গাটার নাম রাখাজঙ্গল। খড়গপুরের প্রাণকেন্দ্র গোলবাজার ছাড়িয়ে, মেদিনীপুরের রেল লাইনের পাশের বম্বে টকিজ সিনেমা হল পেরিয়ে, নিমপুরা পার হয়ে, ও-ই যে একলা রাস্তাটা কলাইকুন্ডার দিকে চলে গিয়েছে, সেই পথেই পড়ে রাখাজঙ্গল। আর বাবার নতুন ফ্যাকটরির অফিসটাও ওখানেই।
ওয়েস্ট বেঙ্গল স্কুটার্স টু হুইলার্স তৈরি করত না। উত্তরভারতের বিভিন্ন কারখানা থেকে পার্টস নিয়ে এসে অ্যাসেম্বল করে স্কুটার বানিয়ে বাজারে ছাড়ত। নতুন কোম্পানি। দেশীয় বাজারে সর্বভারতীয় সংস্থা স্কুটার্স ইন্ডিয়াকে টেক্কা দেবার আগ্রহ নিয়ে কারবারে নেমেছিল তারা। বাবা সেখানে তাদের নতুন পার্সোনেল অফিসার হিসেবে যোগ দিলো। সালটা ১৯৭৭।
আমাদের ভাড়াবাড়িটা ছিল খড়্গপুরের ইন্দা এলাকায়। মেন রাস্তা থেকে একটু গলির মধ্যে ঢুকে মিনিটখানেকের হাঁটাপথ। ওই গলি ধরে আরো কিছুটা এগোলে একটা টিলা মতো পড়ত — সেই টিলার ওপর উঠে পশ্চিমদিকে তাকালে দেখা যেত সরু সুতোর মতো জল, রোদ্দুর পড়ে চিকচিক করছে। ওটাই কাঁসাই নদী।
আমাদের বাড়িটার চারধারে ঘেঁষাঘেঁষি বাড়ি। পাশে বাড়িওয়ালা কণাদি-মনাদি-ছোটকাদাদাদের বাড়ি। ওপাশে ছোটনদের বাড়ি। টিলার দিকে যেতে পুকুদের বাড়ি। আর ঐ টিলার ওপরে ছিল শর্মিদের বিরাট বাংলোবাড়ি।
আমাদের বাড়ির উল্টোদিকের বাড়িটা ছিল একটা মেসবাড়ি। একতলার সদরের ওপরের দেয়ালে আলকাতরা দিয়ে বড় বড় অক্ষরে লেখা ছিল — সেলফিশ মেস। অমন নামের মানে আমি অনেক ভেবেও বুঝে উঠতে পারিনি।
খড়গপুরে এসে আমি প্রথম পাড়া-কালচারের স্বাদ পেয়েছিলাম। প্রথম এবং শেষ।
সেখানে পতিদের বাড়ির পাশের পরিত্যক্ত জমিতে সকলের বাড়ি থেকে চেয়ে চিন্তে আনা শাড়ি-ধুতির ম্যারাপ খাটিয়ে হ্যাজাক ভাড়া করে, তপ্ত বৈশাখী সন্ধেতে রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠান হতো। চৌকি-তক্তপোশের স্টেজে আমার প্রথম অভিনয় — রবীন্দ্রনাথের ‘মুকুট’-এ ইন্দ্রকুমার। প্রথম এবং শেষ।
বিকেলে ইস্কুলফেরত কুমিরডাঙা, রুমালচোর, কিৎকিৎ, নানাবিধ খেলার হাতছানি। অফিসফেরত নাগকাকু, রায়চৌধুরীকাকু, বাগচীকাকুদের সঙ্গে বাবার সান্ধ্য আড্ডা — যেখানে প্রায়শই কাকিমারাও যোগদান করতেন। ফলে, রুমালচোর খেলুড়েদের সংখ্যা যেতো বেড়ে। আমার খুব মজাই লাগত।
বাবা অফিস থেকে গাড়ি পেতো। অফিসার বলে কথা। তাছাড়া দুপুরবেলা সেই রাখাজঙ্গল থেকে সাইকেল করে বাবার দুপুরের খাবার নিতে আসতো স্কুটার্সের পিওন। মা তৈরি রাখত চার বাটির টিফিন ক্যারিয়ার।
খড়গপুরেই আমাদের প্রথম ফ্রিজ কেনা হলো। চৌকো মতো সাদা আলমারি। ভিতরটা কি ঠান্ডা! মা গোলবাজারের দোকান থেকে আইসক্রিম পাউডার কিনে এনে ফুটিয়ে ঘন করা দুধের সঙ্গে মিশিয়ে নতুন ফ্রিজে জমিয়ে, আমাকে তৈরি করে দিল ঘরোয়া আইসক্রীম। সেদিন আমার আনন্দ আর ধরে না।
কলকাতা যাওয়া হতো মাঝে মাঝেই। মামার বাড়িতেও মাকে দেখতাম অনেক দ্বিধাহীন ভাবে চলাফেরা করছে। পরে বুঝেছি, সুপারিশের চাকরির মাথা নীচু করা হীনমন্যতা থেকে বেরিয়ে কতটা স্বস্তিবোধ করেছিল মা।
এত আনন্দের মাঝে আমাদের পুরোনো বাড়ি আর সেই উত্তর শহরতলির মাঠ ঘাট গঙ্গার পাড় আর জঙ্গুলে পাড়াটার জন্য মনকেমনের কোনো প্রশ্নই ছিল না। তবু, প্রশ্ন উঠল। আমার মনে। খড়গপুরের ইস্কুলটা আমার একটুও ভাল লাগল না।
নামজাদা কনভেন্ট ইস্কুলের বিশাল বিল্ডিং আর ততোধিক বিশাল প্লে গ্রাউন্ড আমার মনকে কুঁকড়ে দিয়েছিল প্রথম দিনেই। টিচারদের খুব দূরের মানুষ মনে হতো। মন খুলে বন্ধুত্ব করতে পারিনি কোনো সহপাঠিনীর সঙ্গেই।
মা টিফিনে দিতো মাখন পাঁউরুটি, ছাড়ানো কাঁঠালি কলা আর যে কোনো একটা শুকনো মিষ্টি। একদিন টিফিন বাক্স খুলে দেখি, কলাটা বোধহয় বেশি পাকা ছিল — মুগের লাড্ডুর সঙ্গে চাপাচাপি হয়ে বেশ একটা মাখোমাখো ফলারের রূপ ধারণ করেছে। আমার হেলদোল নেই, তাছাড়া ঘেন্না করে খাইনি বলে খাবার ফিরিয়ে নিয়ে গেলে মায়ের হাতের মার জুটবে কপালে। আর রাস্তায় খাবার ফেলে দেবার কথা তো ভাবাও পাপ — তাই অম্লানবদনে ওগুলো গলাধঃকরণ করতে আরম্ভ করেছিলাম।
আমার পাশে বসত লিজা নামে একটি অ্যাংলো মেয়ে। লিজা অ্যানি আইজ্যাক। সে নাকটাক কুঁচকে আমাকে জানালো — ”leave the question of eating, how can you even tolerate the sight of that food? I feel like vomiting”—-এই বলে সে উঠেই গেল আমার পাশ থেকে। কেমন এক কুন্ঠা মিশ্রিত অপমানে গুটিয়ে গেলাম আমি।
যে কোনো ধরনের আউটডোর গেমসে আমার ছিল ঘোর অনীহা। খোখো অবধি ম্যানেজ করতে পারতাম। কিন্তু, ভলিবল, বাস্কেটবল এইসব খেলায় নামতে বললেই আমার পেটে ব্যথা শুরু হয়ে যেত। অথচ পার্টিসিপেশন ছিল জরুরি।
এখনো মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্নে দেখি, খড়গপুরের ইস্কুলের ঢালা বাস্কেটবল কোর্টে আমি একটা ঢাউস বল নিয়ে ড্রিপ খাওয়াতে খাওয়াতে বিপক্ষের জালওয়ালা পোস্টের দিকে ছুটে চলেছি, খেলাটার বিন্দুবিসর্গও না বুঝে — দু’পাশ থেকে হিংস্র উৎসাহী চিৎকার উঠছে —“কাম অন সুকানিয়া, কাম অন—”
আর তারপরেই আমার দুই হাঁটুর মধ্যে কারো একখানা কেডস পরা পা ছিটকে উঠছে, আর আমি ধপাস, ঘ্যাঁসস করে ঐ সিমেন্টের কোর্টে হুমড়ি খেয়ে পড়ছি — সাদা মোজা মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে রক্তে —
ইস্কুলে আমার দুটি জিনিস ভাল লাগত। ওখানকার চ্যাপেল। কি শান্ত! যখন ইচ্ছে হতো, ঢুকতাম। হাঁটু মুড়ে বসতাম আধো অন্ধকার ঘরে। কেউ থাকত না বেশিরভাগ সময়। শুধু আমি, মা মেরি, কোলে ছোট্ট যিশু, আর আমাদের মাঝখানে একটা জ্বলন্ত মোমবাতি।
আর ভাল লাগত বাংলা দিদিমণির ক্লাস। যে পিরিয়ডেই থাকুক না কেন, বাংলা মিস ক্লাসে এসেই আমাদের দাঁড় করিয়ে প্রার্থনাসঙ্গীত গাওয়াতেন — বিপদে মোরে রক্ষা করো, এ নহে মোর প্রার্থনা, বিপদে আমি না যেন করি ভয় —
বহুদিন পরে সে প্রার্থনাসঙ্গীত মূর্ত হয়ে ধরা দিয়েছিল আমার কাছে, ঢাকুরিয়ার আমরি হাসপাতালের পেশেন্ট পার্টির ওয়েটিং লবি-তে।
ভেন্টিলেটরে লড়ছে মা, নিচে আকুল অপেক্ষায় আমি — নিজেও জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি যেন। তখন, মনের কোন লুকোনো কুঠুরির দরজা ফাঁক করে বেরিয়ে এসেছিল সেই ছেলেবেলার ভাল লাগার মন্ত্র, আমার বীজমন্ত্র হয়ে —
দুঃখতাপে ব্যথিত চিতে, না-ই বা দিলে সান্ত্বনা, দুঃখ যেন করিতে পারি জয়।
(ক্রমশ)