আমি জানি খাঁচার পাখি, কেন গান গায়…!
“…her wings are cut and then she is blamed for not knowing how to fly.”
― Simone de Beauvoir, The Second Sex
#Mybodymychoice#justice#Iwantjustice#justiceforRGKar
এখন দ্রোহকাল। অভয়ার বিচারের দাবিতে এই বাংলার আকাশ-বাতাস বিদ্রোহের স্লোগানে-গানে মুখর। মনে পড়ে যাচ্ছে স্বনামধন্যা এফ্রো-আমেরিকান লেখিকা এবং কবি মায়া এঞ্জোলোর বিখ্যাত কবিতা “কেজড বার্ড”-এর কথা। খাঁচার পাখী কেন গান গায়। স্বাস্থ্যভবনের সামনে জুনিয়র ডাক্তারদের অবস্থান মঞ্চে সারাক্ষণ ধরে কেন গান গাওয়া হবে, এই নিয়ে কিছু তথাকথিত “প্রগতিশীল” মানুষ প্রশ্ন তোলেন। তাঁদেরকে মায়ার এই কবিতাটা আরো একবার পড়ার জন্য অনুরোধ করবো। “ওরা ভয় পেয়েছে রোবসন”, হ্যাঁ, প্রকৃত অর্থেই মাননীয়া সহ এদেশের শাসকেরা এমন স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহের গানে ও স্লোগানে ভয় পেয়েছে। তাইতো তাঁদের পৃষ্ঠপোষক কিছু বুদ্ধিজীবিরা আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের গান গাইতে মানা করছেন। অবস্থান মঞ্চে এসে বা না এসে সমালোচনা করছেন অনেকেই। আসলে ওরা ভয় পেয়েছে। অভয়া ওরা তোমার ভাই-বোনেদের বিদ্রোহের গানে ভয় পেয়েছে। তোমার খুনের বিচার আজ না হয় কাল তুমি পাবেই, এটা জেনে রোখো অভয়া। যে রাজনৈতিক দল এই আন্দোলনের নেতৃত্বে নেই, তবু তাঁদের নামে নাশকতার অভিযোগ এনে জনতার চোখকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে চাইছে সরকার। কলতানদেরকে শিখন্ডী করে জুনিয়র ডাক্তারদের এই আন্দোলনকে কলুষিত করতে চাইছে তারা। শাসক ও তার দালাল মিডিয়াগুলো উঠে পড়ে লেগেছে আন্দোলনের মোড় অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু বাংলার সাধারণ মানুষ শাসকের নির্লজ্জ সাফাই গাওয়ার বিরুদ্ধে সজোরে জবাব দিয়েছে। গতকাল কলকাতার রাজপথে নেমে এসেছিলো মানুষের উত্তাল ঢেউ। আজ একসঙ্গে রাজ্যের ৫০ টা জায়গায় ৫০ টা পথনাটকের দল রাস্তায় নেমে চলমান এই আন্দোলনকে সংহতি জানাবে। এ’সবই প্রমাণ করে দেয় মানুষ শেষত ক্ষমতাতন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়।
যাইহোক, জাস্টিস ফর আরজি কর আন্দোলনের সূত্র ধরে, গত কয়েকদিন ধরে ফেসবুকে ঘুরছিলো একটি ছবি। একটি মেয়ের শরীর। সেখানে স্তন আর যোনি দেশ, পৃথকভাবে মাটিতে পড়ে। টুকরো করা হয়েছে তা, দূরে আগ্নেয়গিরির লাভা উদগীরণ। মেয়েটি যেন বলতে চাইছে – “যাবতীয় সমস্যার মূল আমার শরীর। আমার শরীর থেকে ওই দুই অঙ্গ সরিয়ে নাও। আগ্নেয়গিরির জ্বালা নয়, শান্তি আসুক আমার জীবনে। মেয়ে নয়, মানুষ হিসেবে দেখো আমাকে। ও পৃথিবী বাঁচতে দাও আমাকে। কি বড্ড বেশি স্যাডিসটিক লাগছে আমায়?” হ্যাঁ, সমাজের মূল স্রোত এবং তার মদত পুষ্ট সংগঠিত অপরাধ বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে যখন কোন ব্যাক্তি বা সমষ্টি কথা বলে, প্রতিবাদ করে বা প্রতিরোধ আন্দোলনে সামিল হয়, তখন নানাভাবে তাকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করা। তাকে নিরাশাবাদী অথবা দুঃখবাদী বা বিচ্ছিন্নতাবাদী ও হটকারী ইত্যাদি নানা বিশেষণে ভূষিত করা হয়। সবদেশে, সবকালে, সর্বত্র শাসকরা এই কাজটাই করে থাকে। আর সেই মূল স্রোতের সংগঠিত অপরাধের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যদি এক বা একাধিক নারী থাকেন তবে তো কোন কথাই নেই। সঙ্গে সঙ্গে সেই নারী বা নারীদের ব্যক্তিগত জীবন, তাঁর/তাঁদের পোষাক বা দৈনন্দিন জীবনযাত্রা নিয়ে কাটাছেঁড়া করার কাজ শুরু হয়ে যায়। এটাই ক্ষমতাতন্ত্র বা পিতৃতন্ত্র – যা অন্য স্বরকে অবদমন করার মধ্যে দিয়ে নিজের ক্ষমতা বা পুরুষত্বকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়। সেই ক্ষমতার কেন্দ্রে কোন পুরুষ থাক বা মাননীয়ার মতো কোন নারী, সকলেই ঐ পিতৃতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকের কাজ করে। দিনের শেষে, জাস্টিস ফর আরজি করের দাবিতে ছাত্র-ছাত্রী ও অসংখ্য সাধারণ মানুষের আন্দোলন দীর্ঘদিনের স্থবিরতাকে ভেঙ্গে দিয়েছে। শাসকের সকল জুজু, ভয় ও অপপ্রচারকে উপেক্ষা করে মেয়েরা রাতের দখল নিচ্ছে, সাধারণ মানুষ পথে নামছে।
“জনতার কলোচ্ছাসে ভয় পেয়েছে
একতার তীব্রতায় ভয় পেয়েছে
হিম্মতের শক্তিতে ভয় পেয়েছে রবসন
ওরা সংহারের মূর্তি দেখে ভয় পেয়েছে রবসন।”
গায়কঃ হেমাঙ্গ বিশ্বাস
মূলঃ নাজিম হিকমাত (তুর্কী কবি)
অনুবাদঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়
সুরকারঃ কমল সরকার
#Mybodymychoice
চলমান এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায়, শুধু অভয়ার জন্য জাস্টিস চেয়ে থেমে গেলে চলবে না। আমাদের সকলকে, বিশেষ করে মেয়েদের বা ট্রান্স-ওম্যানদের অবশ্যই ভাবতে হবে এবং এই আন্দোলনের মূল স্লোগানের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, তা হল “নারীর শরীর, নারীর অধিকার”। সমাজের চোখে, মানুষের চোখে, মেয়ে মানেই দুই সাজানো মাংসপিন্ডের তাল। আপনি যখন কিছু বুঝতে শেখেননি, এটা আপনাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। বারে বারে। স্কুলে, বাড়িতে, খেলার মাঠে, আপনার প্রত্যেকটা বেড়ে ওঠার জায়গায় স্টিকার লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। আপনি, আপনার মা, আপনার মেয়ে, আপনার মাসি-পিসি, যত বনগাঁবাসী, আপনি চাকরি করেন, বা চাকরি করেন না, আপনি কাজের মাসি বা দোকানি, ব্যবসায়ী কিংবা গৃহবধূ, উড়নচণ্ডী গাইয়ে বা হাইলি কর্পোরেট, ইটভাঁটার শ্রমিক বা বাজারের মাছউলি, কিম্বা ছাত্রী, বা সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, যৌনকর্মী, ডাক্তার-এঞ্জিনিয়ার, শিক্ষিকা, নার্স, মেথরানি, ক্রিকেটার, পাইলট, খেলোয়াড় থেকে রাজনীতিবিদ- প্রথম বিষয় “শরীর”। কাজের পরিসংখ্যান পরে আসবে। গায়ের রং, রোগা না মোটা বেঁটে না খাটো, চ্যাপ্টা না হাসা, সেটার বিচার আগে। সেই সময়ের সানিয়া থেকে বর্তমানের মানু হয়ে- “কৃষ্ণকলি দীপ্সিতা” – ভোট আদায়ে সিপিএমের মত দলের বিজ্ঞাপনেও থাকে আপনার “শরীর”। সৌন্দর্যের নিক্তিতে মেপে নেওয়া হয় প্রত্যেককে। স্কার্টের ঝুল, গেঞ্জির গলা কেমন হবে সেটা প্রথম আলোচনার বিষয়। অধ্যাবসায় পরে, ইন্টেলিজেন্স পরে, দক্ষতা পরে। আমরা এটাই করি, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রায় প্রত্যেকেই করি।
#Mybodymychoice
আমরা এমন এক সময়ে দাঁড়িয়ে, যেখানে ধর্ষিতার ভিডিও দেখতে চেয়ে রেকর্ড সংখ্যক গুগল সার্চ হয় যমজ দুই শহরে। অথচ প্রায় প্রতিদিনই অসংখ্য মিছিলে এই নৃশংসতার প্রতিবাদে পা মেলাচ্ছি আমরা! আগুনে ক্ষোভ জানাচ্ছি! ঘটনাটা বেশিদিন নয়, গত কুড়ি আগস্ট। রেপ ভিকটিমের নাম নিয়ে ইন্টারনেটে তার রেপ ভিডিও দেখতে চেয়ে খোঁজ লাগিয়েছেন অসংখ্য মানুষ। হয়তো তাঁরাও প্রতিবাদের মোমবাতি নিয়ে আমাদের পাশেই হেঁটেছেন। কি কারণ?
আমরা বলছি
#Mybodymychoice
সমাজের সব শ্রেণী উদ্বেলিত এই প্রতিবাদ জোয়ারে। সত্যিই তো এমন অন্ধকার দিনে তো আর ঘরে বসে থাকা যায় না। আরজি করের নৃশংস ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনা ঘিরে মানুষের অনেকদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ প্রকাশ পাচ্ছে। যত না-পাওয়া, যত অপমান, যত অসামঞ্জস্য এ’সবের হিসেব বুঝে নিতে চাইছি আমরা। রাত জেগে প্রতিবাদে নেমেছি। নানান স্লোগানের পাশে চিরকালীন অবস্থান “My body my choice” তাই! আর কতটা পেরোলে এ পৃথিবী বুঝবে! আমার চয়েজ? যেখানে মেয়েরাই একটা সামাজিক বা ব্যক্তিগত শারীরিক (বৈষয়িক) সম্পত্তি হিসেবে ট্রিট পায়! সেখানে কোন চয়েজ? কোনো মেয়ের সঙ্গে অসম্মানজনক কিছু হলেই তার পরিবার টেনে কথা হয়। কারণ সে পরিবারের সম্পত্তি। সত্যিই? এখনো? বিবাহিতা-অবিবাহিতা, বয়ঃসন্ধিকালের মেয়ে, শিশু-প্রৌঢ়া-মধ্যবয়স্কা, কার আছে, নিজস্ব চয়েজ? কে বাঁচতে পারেন নিজস্ব চয়েজে? সমাজ ছাড় দেয়? মেনে নেয়? নিজস্ব পরিসর আছে? নিজস্ব পরিসর কি, সেই সম্পর্কে ভেবেছে কটা মেয়ে? পিতৃতান্ত্রিকতা কতটা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে বসে আছে, তা বোঝে কটা মেয়ে বা অন্যান্য মানুষ? বছর খানেক আগে, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্তৃপক্ষ, ছাত্র-ছাত্রীদের কিছু একান্ত সময়ের ভিডিও ফুটেজ দেখাতে ডেকে নেয় তাদের অভিভাবকদের! কেউ প্রশ্ন তুলেছিল? আদৌও কর্তৃপক্ষ কি পারে এটা? শুধুমাত্র ক্ষমতা আছে বলেই কি এর এই অপব্যবহার করা যায়? এই কাজে বজায় থাকে, ব্যক্তিগত পরিসরে মানুষের স্বাছন্দ্যে থাকার অধিকার? অনেকদিনের জমে থাকা ক্ষোভ, আক্রোশে পরিণত হয় যখন ম্যারাইট্যাল রেপের পক্ষে রায় দেয় এ’দেশের সর্বোচ্চ কোর্ট।
“One is not born, but rather becomes, a woman.” ― Simone de Beauvoir, The Second Sex