আগে বলতো, কালি-কাগজ-মন লেখে তিনজন। আর এখন ফোন আর মন এই দুজনে লেখে। কালি-কাগজ গত হয়েছে। এরকম কতজনই এখন হঠাৎ করে হারিয়ে যাচ্ছে। ফোনে যখন R টাইপ করি যে শব্দটা প্রথমেই সাজেস্ট করে তাহল RIP। শেষ কিছুদিনে কতগুলো ছবির তলায় এটা লিখতে হয়েছে, হিসেব নেই। কিছু ছবি চেনা, কিছু অচেনা। তাদের কেউ বা ডাক্তার, নার্স, পুলিশ, ব্যাঙ্ক কর্মী অথবা সাফাই কর্মী। কারও ছবির ওপরে করোনা শহীদ বা Covid Worrior লেখা। কিন্তু তাতে কী যায় আসে-এরা কারও মা, বাবা, ছেলে, মেয়ে। কত পরিবারে আচমকা আঁধার ঘনিয়ে আসছে। সুখ অলীক। ওঁরা কাজ করতে গিয়ে ‘বিমারি’ পেয়েছেন, সরকারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া ‘বিমা’র টাকাটা পাচ্ছেন কিনা কে জানে!
কিছুদিন আগে পাড়ায় কারও করোনা হলে আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় জানতাম সেই ‘নরকের কীট’ কোন বাড়িতে থাকে। কিন্তু আজ তো সে আমাদের পরিবারেই থাবা বসিয়েছে। গতকাল বৃষ্টি পড়ছিল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে পাশের বাড়ির কার্নিশে বসা দুটো পায়রাকে দেখছিলাম, ওরা ভিজতে চায় না, কিন্তু কোথাও যাওয়ার জায়গাও নেই। আমাদেরও অনেকটা সেই হাল। আসলে কালকের এই মেঘ, বৃষ্টির ফোটা, ভেজা পায়রা সবাই আমার মনখারাপের সঙ্গী। এমনই বৃষ্টির দিনে যার সঙ্গে কাগজের নৌকো বানিয়ে উঠোনের জলে ভাসাতাম, সে তার নৌকো নিয়ে গতকাল ভোরে না ফেরার দেশে পাড়ি দিয়েছে। এমন বৃষ্টির দিনে যে মামার হাত ধরে স্কুলবাস থেকে নেমে বাড়ি ফিরতাম তিনি আর কখনওই আমার হাত ধরবেন না। দুজনকেই করোনার কাছে হারালাম। আর একজন খুব কাছের মানুষ, যিনি আমাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করেছেন,গত দু সপ্তাহ ধরে ভেন্টিলেটরে।
আলমারিতে অনেক বই থাকে যেগুলো অনেক দিন পড়া হয়নি। তবু জানতাম, সেগুলো আছে, চাইলেই গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে পারবো। কিন্তু যেই দেখি সেগুলো নেই, শুধু ধুলোর দাগটা রয়ে গেছে তখনই এক অপরাধবোধ চলে আসে। এই অদ্ভূত ভয়, অবসাদ যেন গ্রাস করছে।
আমি পেশেন্ট দেখতে ভয় পাচ্ছি, পেশেন্ট আমাকে দেখে ভয় পাচ্ছে। সিজারের আগে কোভিড টেস্ট এর রিপোর্ট এর জন্য অপেক্ষা করা যেন রোগী, ডাক্তার দুজনের কাছেই জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা…
কিন্তু জীবন কখনওই এখানে থেমে থাকে না। মহামারী আগেও হয়েছে, মৃত্যু মিছিল ইতিহাস আগেও দেখেছে। আর শেষ পর্যন্ত মানুষের সাহসই জিতেছে। আর ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়, তাই এবারও আমরাই জিতবো।
তাই চেম্বার খোলা। নাক, মুখ ঢাকা থাকলেও ডাক্তার-রোগীর চোখের ভাষা বুঝিয়ে দেয় তাঁরা একে অপরকে কতটা ভরসা করে। অনেক পুরনো পেশেন্ট, যাঁরা আজ আত্মীয়র থেকেও কাছের, তাঁরা শুধু এইটুকু জানতে ফোন করেন, আমি সুস্থ আছি কিনা। কিছুটা ঝামেলা আর অহেতুক ঘোরাঘুরির পরে কোভিড পজিটিভ মায়েরও সিজার হয়, মা, বাচ্চা দুজনে সুস্থ হয়ে বাড়ি যায়। সেই বাচ্চাকে আগলে রাখা মা আর মাকে আঁকড়ে থাকা বাচ্চা আবার কাজে ফিরে যেতে সাহস জোগায়। সিস্টার ডাক্তারের কাছে বকুনি খায় হাতে স্যানিটাইজার না লাগানোর জন্য। ডাক্তার সিস্টারের কাছে বকুনি খায় মাস্কটা নাক থেকে নেমে গেছে বলে। ব্যাংকের লোক হাসিমুখে ভিড় সামলায়। করপোরেশনের কর্মী একই মাস্ক পরে প্রতিদিন ব্লিচিং পাউডার ছড়াচ্ছে। ফার্মাসিস্ট বাড়ি ফিরে সব জামাকাপড় গরম জলে ভিজিয়ে দেয় আর অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভার স্নান সেরে ভয়ে ভয়ে বাচ্চাকে আদর করে। পুলিশ চুপচাপ নিজের কর্তব্য করে যায়, বাড়িতে বয়স্ক বাবা মা আছে বলে সে ভয়ে বাড়ি ফেরেনি।
আর কত প্রাণ ঝরে যাবে কে জানে, কে কার ছবির তলায় RIP লিখবে জানিনা। শুধু জানি আমরা যদি একে অপরের ভরসা হয়ে উঠতে পারি তবেই এই যুদ্ধে জিতবো।