এক পরাক্রমশালী রাজা হিসেবেই ইতিহাসে বিধৃত হয়েছেন ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিস্। যুদ্ধক্ষেত্রে ও রণকৌশলে রাজা ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিস্ ভয়ঙ্কর ছিলেন বলেই কথিত। রাজ্যভার গ্রহণ করার পরই রাজ্য বিস্তারে বিশেষ মনোযোগী হন ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিস্। প্রথমে আক্রমণ শানাতে থাকেন পার্শ্ববর্তী রাজ্য সমূহে। একে একে ছোটো বড় বিভিন্ন রাজ্য দখল করতে শুরু করেন তিনি। আনাতোলিয়া (অধুনা তুরস্ক) অঞ্চলের রোমান মিত্র রাজ্যগুলো জয় করে ইজিয়ান সাগর তীরে রোমান রাজ্যের সীমানায় উপস্থিত হন ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিস্। এই সময়ে গোটা আনাতোলিয়া অঞ্চল নিজ সাম্রাজ্য ভুক্ত করে ফেলেন তিনি। ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিসের হাতে রোমান মিত্রদের পরাজয় এবং পন্টাস রাজ্যের বিস্তারে চিন্তিত হয়ে পড়েন রোমানরা। ফল স্বরূপ খৃস্টপূর্ব ৮৯-৬৩ অব্দের মধ্যে তিনবার মিথ্রিডাটিসের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন রোমান সেনাদল, ইতিহাসে যা মিথ্রিডাটিয় যুদ্ধ নামে খ্যাত। রোম সাম্রাজ্যের সীমা থেকে মিথ্রিডাটিসকে হঠাতে রোমান সেনাধ্যক্ষ লুসাস কর্নিলিয়স সুলার নেতৃত্বে বিশাল এক বাহিনী হাজির হয় পন্টাস রাজ্যের পশ্চিম সীমান্তে। শুরু হয় প্রথম মিথ্রিডাটিয় যুদ্ধ (খৃষ্টপূর্ব ৮৯-৮৫ অব্দ)। প্রাথমিক ভাবে কিছুটা পিছু হটেন মিথ্রিডাটিস। পরে পাল্টা আঘাতও হানেন তিনি। অবস্থা যা দাঁড়ালো তাতে কেউ কাউকে সূচাগ্র মেদিনী ছাড়তে রাজি নন। ফলে, দীর্ঘস্থায়ী হলো যুদ্ধ। বছর চারেক পর, খৃষ্টপূর্ব ৮৫ অব্দ নাগাদ রোমান রাজ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে সেনাধ্যক্ষ সুলা রোম অভিমুখে যাত্রা করেন। একই সময়ে মিথ্রিডাটিসের বিজিত রাজ্যেও শুরু হয় বিদ্রোহ। ফলে উভয় পক্ষই যুদ্ধ বিরতিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। পরিণতিতে সমাপ্তি ঘটে প্রথম মিথ্রিডাটিয় যুদ্ধের। ঘরোয়া অবস্থা কিছুটা সামলানোর অনতিকাল পরেই আবার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন দুপক্ষ। শুরু হয় দ্বিতীয় মিথ্রিডাটিয় যুদ্ধ (খৃস্টপূর্ব ৮৩-৮২ অব্দ)। এই যুদ্ধে রোমানরা পিছু হঠতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয় ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিসের কাছে। এরপর বেশ কিছুটা সময় শান্তই ছিল উভয়পক্ষ। খৃস্টপূর্ব ৭৩ অব্দে, পার্শ্ববর্তী বেথিনিয়া রাজ্যে নিজেদের পছন্দের উত্তরাধিকারকে মসনদে বসাতে গিয়ে ফের যুদ্ধে জড়িয়ে পরেন এই দুই রাজ্য। শুরু হয় তৃতীয় মিথ্রিডাটিয় যুদ্ধ (খৃস্টপূর্ব ৭৩-৬৩ অব্দ)। ১০ বছর ধরে চলল এই তৃতীয় মিথ্রিডাটিয় যুদ্ধ। এই যুদ্ধে রোমান সেনাদের নেতৃত্ব দেন সেনাধ্যক্ষ নিয়াস পম্পিয়স ম্যাগনাস, যিনি পম্পি নামে অধিক পরিচিত। দীর্ঘ ১০ বছর ধরে যুদ্ধ করার পর, মিথ্রিডাটিসের রণক্লান্ত সেনাবাহিনীর একাংশ বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। রাজ্যলাভের আশায়, পন্টাস রাজ্যের এই সেনা বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন মিথ্রিডাটিসেরই দুই পুত্র। মিথ্রিডাটিসের সেনারা আর যুদ্ধ করতে নারাজ। বরং এই যুদ্ধবাজ রাজার বিরুদ্ধে রোমানদের সাহায্য করেতই বেশি আগ্রহী তাঁরা। পরিণতিতে তৃতীয় মিথ্রিডাটিয় যুদ্ধে পরাজিত হন মিথ্রিডাটিস। নিজের স্ত্রী-কন্যা ও নিকটজনদের নিয়ে রাজধানী সিনোপ ত্যাগ করে কৃষ্ণসাগরের অপর পাড়ে (উত্তর দিকে) ক্রিমিয়া উপদ্বীপের প্যান্টিকাপিয়ম (অধুনা কের্চ) শহরের দুর্গে আত্মগোপন করেন তিনি। এদিকে মিথ্রিডাটিসের পালানোর সংবাদ পেয়ে তাঁর সন্ধানে নেমে পড়েন রোমান বাহিনী। মিথ্রিডাটিসের সন্ধান পেতে অবশ্য বিশেষ বেগ পেতে হয় নি রোমানদের। তাঁকে বন্দি করতে প্যান্টিকাপিয়মে সেনা পাঠান পম্পি। প্যান্টিকাপিয়ম অভিমুখে রোমান সেনা অভিযানের খবর জানতে
কৃষ্ণসাগরের দক্ষিণে গাঢ় বেগুনি বর্ণ : ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিসের পূর্বে পন্টাস রাজ্য।
কৃষ্ণসাগরের উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণে হালকা বেগুনি বর্ণ : ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিসের রাজ্য বিস্তার শুরু। গোলাপি বর্ণ : প্রথম মিথ্রিডেটিয় যুদ্ধের সময় পন্টাস রাজ্য। |
পারেন মিথ্রিডাটিস্। কিন্তু না, তাঁর জাতশত্রু রোমানদের হাতে কিছুতেই ধরা দেবেন না তিনি। রোমানদের গ্রাপ্তারি এড়াতে সপরিবারে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেন মিথ্রিডাটিস্। নিজের সাথে সব সময়েই কিছু পরিমাণে বিষ বহন করতেন মিথ্রিডাটিস্। সেই বিষ তিনি তুলে দিলেন তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের হাতে। রাজা
ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিসের দুই মেয়ে- মিথ্রিডাটিস্ (বাবার মতো একই নাম) ও নাইসা, বিষ পান করে মৃত্যু বরণ করেন। তাঁর স্ত্রীও বিষপান করা মাত্রই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। অবশিষ্ট বিষের সবটাই পান করেন মিথ্রিডাটিস্[2] নিজে। কিন্তু হায়! সেই মারাত্মক বিষপান করেও মৃত্যু হলো না তাঁর, দিব্যি বেঁচে রইলেন তিনি। নিয়মিত বিষ প্রতিষেধক গ্রহন করে, এখন যে নীলকণ্ঠ হয়েছেন তিনি। কোনো বিষই আজ আর বিষ বলে প্রতীয়মান হয় না তাঁর কাছে। সকল প্রকার বিষের প্রতিরোধী হয়ে গেছেন তখন তিনি। তাই মারাত্মক এই বিষ সেবন করার পরও দিব্যি বেঁচে রইলেন মিথ্রিডাটিস্। তবে বিষক্রিয়ার ফলে তাঁর শরীর তখন অবসন্ন, ক্লান্ত। দেহে আর শক্তি যেন নেই তাঁর। নির্জীব হয়ে নিজ শয়ন কক্ষে পড়ে আছেন তিনি। কিন্তু বেঁচে আছেন তিনি তখনও। এদিকে রোমান সেনারাও শহরে ঢুকে পড়ল বলে। কিন্তু না, জীবন থাকতে রোমান সেনাদের হাতে ধরা দেবেন না তিনি। অগত্যাই তাঁর বিশ্বস্ত এক সেনাকে ডেকে মিথ্রিডাটিস্ বললেন, “শত্রু প্রতিরোধে তোমার দক্ষিণ হস্ত থেকে প্রচুর ফল লাভ করেছি আমি। আমি সবথেকে বেশি লাভবান হবো যদি তুমি হত্যা করো আমায় এবং রোমান বিজেতাদের বিপদ থেকে এমন একজনকে রক্ষা করো … যে বিষপান করেও মৃত্যুকে বরণ করতে পারছে না, বোকার মতো, সকল প্রকার বিষক্রিয়া থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রেখেছে সে”[2]। অনুরোধেই হোক বা নির্দেশে, তাঁর অনুগত সেনার হাতেই শেষ পর্যন্ত মৃত্যু বরণ করলেন রাজা ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিস্।
জীবনের একদম অন্তিম মুহূর্তে ঠিক কি ভাবে মৃত্যু বরণ করেছিলেন রাজা ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিস্ তা নিয়ে বহুমত বিদ্যমান। নিজ সেনার হাতে মৃত্যুর উপরোক্ত বয়ান ছাড়াও আরো দুটো মত পাওয়া যায় এই বিষয়ে। দ্বিতীয় মতানুসারে, বিষ পানে মৃত্যু অধরা দেখে নিজের তরবারি দিয়ে আত্মহত্যা করেন রাজা ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিস্[4][6]। তবে এই মতের বিরোধিতা করে অনেকে বলেন, বিষপান করে রাজা এতটাই নির্জীব হয়ে পড়েছিলেন যে তরবারি উঠানোর ক্ষমতাটুকু পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি তখন[5]। তৃতীয় মতানুসারে, নিজ রাজ্যের বিদ্রোহী সেনাদের বল্লমের ঘায়েই শেষ পর্যন্ত মৃত্যু ঘটে তাঁর[5]।
ষষ্ঠ মিথ্রিডাটিসের মৃত্যুর পরই রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করেন রোমান সেনার। রাজার ঘরে ঢুকে, মৃত রাজাকে উদ্ধার করেন তাঁরা। রাজার পাশে একটা পুঁথি উদ্ধার করেন রোমান সেনাদল, তাতে বেশ কয়েকটা বিষ প্রতিষেধক প্রস্তুতির উপায় লিপিবদ্ধ করা ছিল। সেনাধ্যক্ষ পম্পির হাতে সেই পুঁথি তুলে দেন রোমান সেনারা। পুঁথির গুরুত্ব বুঝে তা সযত্নে রক্ষা করেন সেনাধ্যক্ষ পম্পি। কিছুকাল পরে, তাঁর উদ্যোগেই এই পুঁথির রোমান অনুবাদ প্রকাশিত হয়[৯]। (চলবে)
গ্রন্থপঞ্জী –
1) Adrienne Mayor, ‘The Poison King: The Life and Legend of Mithridates, Rome’s Deadliest Enemy’
2) Appian (of Alexandria), ‘Roman History’.
3) Aulus Cornelius Celsus, ‘De Medicina’
4) Aulus Gellius, ‘Attic Nights’
5) Cassius Dio, ‘Roman History’.
6) Florus, ‘Epitome of Roman History’
7) Laurenve M. V. Totelin, ‘Mithradates antidote-a pharmacological ghost’
8) Marcus Junianus Justinus, ‘Epitome of the Philippic History of Pompeius Trogus’.
9) Pliny (the Elder), ‘Natural History’
10) Various online sites (for herbal names).