সেই মার্চ মাস থেকে একটানা রোগী দেখে যাচ্ছি, দেখেই যাচ্ছি। বাড়িতে মেয়েদের কাছাকাছি ঘেঁষতে পারিনা। মন মেজাজ অত্যন্ত খারাপ। তার উপর রোগীও যদি মশকরা করে…..
ঘন্টা খানেক আগেই মেডিকেল কলেজের এক সহপাঠী চিকিৎসক ফোন করেছিল, ‘ভাইরে, যুদ্ধ শেষ, করোনা পজিটিভ হয়ে গেছি। হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যাচ্ছি।’
ফোন পাওয়ার পর থেকেই মনটা আরো খিঁচড়ে গেছে। বুঝতে পারছি আমারও বিদায় নেওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে। সরকারি চিকিৎসকরা তবু করোনা যোদ্ধার সম্মান পাবেন। আমাদের হাতে হ্যারিকেন।
সামনের জ্বরের রোগিণী বিশ্রী রকম কাশছেন। হতশ্রী মাস্কেও অজস্র ফুটো। ভাইরাস সেই ফুটো দিয়ে এরোসলে চেপে নাচতে নাচতে যাতায়াত করবে। সম্ভবত লকডাউনের একদম প্রথম থেকেই তিনি ওই মাস্ক ব্যবহার করছেন।
তাড়াতাড়ি ওষুধ পত্র লিখলাম। তারপর বললাম, ‘যদি দু- তিন দিনে জ্বর না কমে, তাহলে করোনার পরীক্ষা করতে হবে। এ কদিন বাড়িতে আলাদা ঘরে থাকবেন, ভালো সার্জিক্যাল মাস্ক পরে থাকবেন। আলাদা বাথরুম ব্যবহার করবেন।’
ভদ্রমহিলা বললেন, ‘আমার করোনা হবে না ডাক্তার বাবু। আমি অ্যালবাম খেয়ে নিয়েছি।’
মাথাটা টং করে গরম হয়ে গেলো। বললাম, ‘ডাক্তার বাবুর সাথে মশকরা করছেন! লজ্জা লাগে না!’
ভদ্রমহিলা আহত দৃষ্টিতে বললেন, ‘মশকরা? কোথায় মশকরা করলাম?’
‘অ্যালবাম কি খাওয়ার জিনিস? করোনা হলে অ্যালবামে ছবি হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট থাকে। তা বলে অ্যালবাম খেয়ে করোনা আটবেন?’
ভদ্রমহিলা বললেন, ‘আপনি ভুল বুঝেছেন ডাক্তার বাবু। ওই যে করোনার একটা ওষুধ আছে না.. কি যেন অ্যালবাম?’
রেগেমেগে বললাম, ‘আপনি অ্যালবাম খান, বাবুলগাম খান, যা ইচ্ছে খান। দিন তিনেকের মধ্যে জ্বর না কমলে সোয়াব টেস্ট করতে হবে। ব্যাস… কথা শেষ।’
কিন্তু আমি কথা শেষ করতে চাইলেই কি কথা শেষ হয়। ভদ্রমহিলার চোখ দুটো ছল ছল করে উঠলো। বললেন, ‘ডাক্তার বাবু, পাঁচ দিন আগে আমি একটা বিয়ে বাড়িতে গেছিলাম। ওখান থেকে কি করোনা হতে পারে?’
‘এই মহামারীর মধ্যে আপনি বিয়ে খেতে গেছিলেন?’
‘কী করব ডাক্তার বাবু। আমার বড় মামার শালার মেয়ের বিয়ে। এত নিকটাত্মীয়। আর এত করে বলল…’
নিকটাত্মীয়? আমি হাঁ হয়ে গেলাম।
ভদ্রমহিলা এবার প্রায় কেঁদে ফেললেন। ‘যদি সত্যি করোনা হয়, মরে যাব না তো ডাক্তার বাবু?’
বললাম, ‘করোনাতে যদি নাও মরেন, এতো প্রেশার- সুগার নিয়ে ঘন ঘন নিকটাত্মীয়ের বিয়ে খেয়ে বেরোলে অন্য রোগে মারা পড়বেন।’
খুব ভালো কেস স্টাডি। স্যার আপনি চিকিৎসক আর আমি একজন grassroot health worker. NGO. আমার কাছে এমন বহু কেস স্টাডি আছে এবং মানুষ এমন কিছু বলে শুনে মনে হয় আমরা বাইরে যতটা আধুনিক মনের দিকে ততটাই পিছিয়ে আছি।
হঠাৎই আপনার একটা লেখা চোখে পড়ল। তারপর একটানা কয়েকটি পড়লাম। চিকিৎসক, সুলেখক, রসিক এবং মানবিক ……. বিরলপ্রায় সংমিশ্রণ। আমার মতো সাধারণের কাছে আপনিই ‘অতিম্যান’। ভালো থাকুন আপনি ও আপনার প্রিয়জন।
আরও লিখুন, লিখেই চলুন।