আমাদের স্কুলে বধির বা hearing impaired বিভাগে একটি দারুণ বাঁদর আর দারুণ সোনা ছেলে আছে| বাঁদরামি আর সোনামি দুইয়ে মিলে fantastic হয়ে গেছে আমাদের লিডার| হ্যাঁ —–লিডার বলেই ডাকি তাকে|
লিডার সবসময় হাতপাগুলোকে ছুটিয়ে চলেছে গগনের গানে| লিডার বলেই যেন সে উড়ে চলবে বাকিদের মাথার প্যারালাল ওপরে| ফলে কী হয়—ক্লাসরুমের যেখান দিয়ে সে চলে কিছু না কিছু পড়ে যায়| যায়ই যায়| ধরুন, লিখবে বলে গেল ব্ল্যাকবোর্ডের কাছে| বেশি কিছু না– বোর্ডটা জাস্ট খসে গেল মাটিতে| স্কুলের ছোট কিচেনে জল খেতে গেল সবাইকে নিয়ে| সমবেত জলপানে কিচেন টলটলে এক দীঘি হয়ে গেল| তারপর সে দীঘিতে তার উদোম ডান্স প্রোগ্রাম| লিডার তখন পাকা কোরিওগ্রাফার| উদোম কেলাই| অন্তত কেলানোর ভাবটা বজায় রাখি শরীরের প্রতি বিভঙ্গে| কেলানোর ভাবটুকুও না দেখলে লিডার রান্নাঘরেই চান ফান করে একটা জ্যান্ত জলকেল্লা হয়ে যাবে|
অবাক হই কোথায় জানেন? যখন দেখি পিঠে পড়বে ভেবেও লিডারের হাসি মায়াময়| নির্মল| সে তো সব শিশুর শিশুলিডার –তাই না? ছোট্ট পিটুনির পর তার একটাই আবদার, দিদিমনিদের মাঝে বসে কাপে চা খাবে ফুঁ দিয়ে দিয়ে| ফুঁ এর ভঙ্গিটাও নির্ভুল করে দেখিয়ে দিয়েছে লিডার| শুধরে দিয়েছে আমাদের ভুল ফুঁ|
আর আশ্চর্য পাপশূন্য পপিতার চোখ! গরিব মায়ের দেয়া একটুকুশ কেক সে ভাগ করে দেয় সবাইকে| নিজে একফোঁটা না খেয়ে মেঝেতে হেসে শুয়ে পড়ে লিডার| পড়াশুনায় দারুন ভালো| লহমায় ঠোঁটস্থ করে নামতা| পদ্য পড়ে– ঠাকুমা যাবে গয়া কাশি| পরের লাইন না বলে আকাশমুখে ঠ্যাং তুলে ডুগডুগি বাজায়|
তার মা দিতে পারেন না একটি কম দামের শ্রবণযন্ত্রও| কেবলমাত্র আমার leap read করেই তুলে নেয় বাক্যের পর বাক্য| আমার কথা বলার বিশেষ tune| তো ক্লাসে আমরা দিদিমনিরা প্রায়ই আলোচনা করি– বধির কিংবা mentally challenged বাচ্চাদের দিয়ে কথা বলাতে হবে বেশি– লেখা বা writing skill এর চেয়ে reading ও speaking skill বাড়াতে হবে— নাহলে খুব বিপদ হবে এদের আগামী দিনে–ইত্যাদি ইত্যাদি| যেমন সব দিদিমনিরা ক্লাশ শুরুর আগে প্ল্যান করে আর কী!
একদিন দেখি, কখন যেন leap read করে এইসব কথাও তুলে নিয়েছে লিডার| পড়াচ্ছি দুজনকে| পাশের বাচ্চাটা কিছুতেই কথা বলছে না, কেবল পেন্সিল বুলাচ্ছে খাতায়| বাঁদর লিডার করেছে কী, বাচ্চাটার পেন্সিলটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে একটানে|তারপর বাচ্চাটাকে নিজের ছোট্ট বুকটায় জড়িয়ে ধরে বলছে— ওরে লেখা না–লেখা না– কথা বল কথা বল– নইলে বিপদ হবে আমাদের| বলেই যাচ্ছে– বলেই যাচ্ছে| আর আমি অবাক হয়ে দেখেই যাচ্ছি– দেখছিই—
ছোট লিডারের ছোট বুকে কুলোচ্ছে না সতীর্থর মাথা| তবুও বন্ধুকে বুকেই রেখে দিয়েছে লিডার|আর ভয়ঙ্কর ত্রস্ত গলায় বলে চলেছে– ওরে কথা বল, তোরা কথা বল, মিসের মত করে কথা বল| নাহলে বিপদ! বিপদ! আরে আরে একীইইই– উঠে দাঁড়িয়ে ড্যাবা চোখে বক্তৃতাই শুরু করেছে যে লিডার| ততক্ষণে ওর দেখাদেখি বেশ কটা বাচ্চা নিজেরাই এগিয়ে এসেছে আমার দিকে আর আমারটা শুনে শুনে আপ্রাণ ছড়া কেটে যাচ্ছে| জল দিলাম একজনকে| না খেয়ে ছড়া চালালো| সারা ঘরময়– কথা বল, কথা বল| অস্বস্তি বাড়ছিল আমার| ওরা কি বুঝে গেছে, এ সমাজ এ সংসারে বড় বিপদে আছে ওরা? পিছিয়ে পড়া শিশুর দল একে অপরকে কেন জড়ায় এমন আকুতিতে?
গলা ফেটে যাচ্ছে লিডারের| তার চিল চিৎকারে ফাটছে আমার কান| নিজের চোখটা যেন বেশি খটখটে লাগছিল আমার| কাছে টেনে কেবল হাত রাখলাম লিডারের পিঠে! এবার লিডারের প্রশ্ন : “আর কতোটা কথা বলব মিস?? কটা পর্যন্ত বলতে হবে কথা?” —
লিডারররর! যাস নে ভাই| তোর জলকেল্লায় ঠাঁই চাই| কেল্লায় যে টাটকা জল| পাপীর বাক্য ভিজে খই| নতুন শব্দ– তা থৈ তাতা থৈ|
লেখাটা খুব ভালো। কী মায়া ওদের , অথচ আমরা সুস্থ সবল হয়েও বুঝি না ওদের কত সময় ! লিডারদের অস্তিত্ব নিয়ে মাথাব্যথা নেই। সময়টাই বিপন্ন।