শীতলবাবুর হাতের লিকলিকে বেতটা টেবিলের উপর আছড়ে পড়ল। ‘চুপ, কেউ একটা কথা বললেই খাতা নিয়ে বাইরে বার করে দেব।’
সমস্ত শ্রেণী কক্ষে শ্মশানের নিস্তব্ধতা নেমে এল। কথা রাখার ব্যাপারে শীতলবাবুর সুনাম আছে। তিনি ফাঁকা আওয়াজ দেননা। এরপরও কথা বার্তা বললে পরীক্ষার হল থেকে বাইরে তো বের করবেনই, হয়ত বিকেলে সাইকেল নিয়ে বাড়িও চলে যেতে পারেন। বাড়ি গিয়ে বাবার কানে পুত্রের কুকীর্তির কথা একবার তুলে দিলে দেখতে হবেনা।
এই ঘরে মধ্যমগ্রাম হাই স্কুলের নাইন ডি সেকশনের ছেলেদের হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষা চলছে। নাইন ডি সেকশন মানে দুনিয়ার যত ফেল করা ছাত্র এক জায়গায় হয়েছে। সেই ঘরে শীতলবাবুর গার্ড দেওয়া রীতিমত অন্যায়।
আমরা ফার্স্ট সেকেন্ড হওয়ার জন্য পরীক্ষা দিই না। ভাল নম্বর পাওয়ার জন্যও পরীক্ষা দিই না। আমরা পরীক্ষা দিই শুধু পাশ নম্বরটুকু তোলার জন্য। আমরা পরীক্ষায় পাশ করলে জগত সংসারে কারো কোনও অসুবিধা নেই। কিন্তু পাশ না করতে পারলে বাবার হাতুড়ে ঠেঙানি, মায়ের চোখের জল, পাড়ার লোকের ব্যঙ্গ এসব মুখ বুজে সহ্য করতে হয়।
রেজাল্ট বেরোলেই পাড়ার লোকজন জিজ্ঞাসা করে, ‘কিরে, তোর রেজাল্ট কেমন হল? এবার পাশ করেছিস তো?’
আমার ধারনা তারা জেনেশুনেই জিজ্ঞাসা করে। সব শয়তানি। কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিয়েই তাদের আনন্দ। আমার রেজাল্ট না জানলে যেন তাদের ঘুম হচ্ছে না।
এদের একজনও আমার মত লংজাম্প দিতে পারবে? আমার মত একশ মিটার, চারশ মিটার দৌড়াতে পারবে? এই তো দুসপ্তাহ আগে বারাসত স্টেডিয়ামে উত্তর ২৪ পরগণা জেলা স্পোর্টসে তিনটে বিভাগেই প্রথম হলাম। তখনতো একজনও কিছু জিজ্ঞাসা করতে আসেনি! এই যে নেপাল, আমাদের সুব্রত কাপ দলের এক নম্বর স্ট্রাইকার, শোনা যাচ্ছে কদিনের মধ্যেই মোহন বাগানের হয়ে ওকে খেলতে দেখা যাবে। ওর গাছ কি করে সালোক সংশ্লেষ করে, নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র কি, পানিপথের প্রথম যুদ্ধ কবে হয়েছিল এইসব জেনে হবেটা কি!
আমারতো মনে হয় দেশ থেকে পড়াশুনো তুলে দিয়ে খেলাধুলাটাই বাধ্যতামূলক করে দেওয়া উচিৎ। স্বয়ং বিবেকানন্দ বলে গেছেন গীতা পাঠ অপেক্ষা ফুটবল খেলা ভালো।
কিন্তু আমার চাওয়া না চাওয়ায় কিছু পালটাবে না। আপাতত ইতিহাস পরীক্ষাটাই দিতে হবে। শীতলবাবুর কড়া নজরের মধ্যেই অন্তত কুড়িটা নম্বর যে করেই হোক তুলতে হবে। এমনিতে হাফিয়ার্লিতে ফেল করলে তেমন অসুবিধা নেই। একবছর নষ্ট হবে না। কিন্তু বাবা নামের মনুষ্য প্রজাতিটি হাফিয়ার্লি, এনোয়্যাল কিছুই মানেন না। তাঁদের এক ও একমাত্র লক্ষ ছলে, বলে, কৌশলে যে কোনও অজুহাতে ছেলেদের পেটানো।
আপাতত আমি ভারত ছাড় আন্দোলন নিয়ে লড়ে যাচ্ছি। ভারত ছাড় সম্বন্ধে আমার দুটি জ্ঞান রয়েছে। গান্ধীজী এই আন্দোলনের নেতা আর ইংরেজদের ভারত ছাড়া করার জন্য এই আন্দোলন হয়েছিল। এদিক ওদিক চেয়ে দেখলাম। অনেকে মুখ নিচু করে লিখে চলেছে। অনেকেই আবার কলম চেবাচ্ছে। কিন্তু শীতলবাবুর ভয়ে কেউই টুকলি বের করতে পারছে না। একে ওকে জিজ্ঞাসাও করতে পারছে না। একমাত্র অসীম ওর বিখ্যাত হারমোনিয়াম টুকলি আঙুলের ফাঁকে রেখে টুকছে। ধরা পড়লে ওর ভাগ্যে দুঃখ আছে।
হারমোনিয়াম টুকলি হ’ল কাগজে লিখে সেটা জাপানী পাখা বা হারমোনিয়ামের মত ভাঁজ করা টুকলি। চিরাচরিত টুকলির সাথে এর পার্থক্য হল, বড় টুকলিকে এভাবে ভাঁজ করে নিলে সেটা খুব ছোটো হয়ে যায়। আর একটু অভ্যাস করলেই আঙুলের ফাঁকে এই টুকলি রেখে লেখা যায়। অসীম এটাকে প্রায় শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে।
অসীম ভাল হাত সাফাইয়ের খেলা আর ম্যাজিক দেখায়। টুকলি করার ক্ষেত্রেও সেই প্রতিভা কাজে লাগায়। সেই কনফিডেন্সেই শীতল বাবুর সামনে টুকলি করার সাহস পাচ্ছে।
যাক, ওসব নিয়ে ভেবে লাভ নেই। আমি ভারত ছাড় আন্দোলন সম্পর্কে লেখার চেষ্টা করি। ইতিহাসে যত পৃষ্ঠা লিখব তত নম্বর। খাতা নাকি কেউ পড়ে দেখেননা। লিখতে শুরু করলাম।
“গান্ধিজী ইংরেজদের ভারত ছাড়া করতে এই আন্দোলন শুরু করেন। ইংরেজদের থাকার জন্য আলাদা একটি দেশ আছে। সেই দেশের নাম ইংল্যান্ড। তারা কেন ভারতে এসে বসবাস করবে। অতএব গান্ধিজীর এই আন্দোলন অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত।
কিন্তু ভারত ছাড়ো বললেই তো ইংরেজ ভারত ছেড়ে চলে যাবে না। অতএব মারপিট শুরু হল। গান্ধিজীর পক্ষে রয়েছেন ক্ষুদিরাম, নেতাজী, বাঘা যতীন, ভগৎ সিং। ইংরেজদের পক্ষে তেমন বীর কেউ ছিল না। ইতিহাস তাই কোনও ইংরেজের নাম মনে রাখেনি।”
একমনে লিখে যাচ্ছি। বেশ একটা আবেগ চলে এসেছে। তর তর করে লেখা এগোচ্ছে। হঠাৎ কানে একটা টান পড়ল। ইতিহাস থেকে বর্তমানে ফেরত এলাম। এবং বুঝতে পারলাম পরিস্থিতি ভারত ছাড় আন্দোলনের চেয়েও সংকট জনক।
আমার এক কান শীতল বাবুর কব্জায়। শীতলবাবু বললেন, ‘মর্কট এসব কি লিখছিস। ক্ষুদিরাম ছিলেন গান্ধীজীর ডান হাত আর নেতাজী বাম হাত। ক্ষুদিরামের বন্দুক চালানোতে অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন। বহুদূর থেকে লক্ষভেদ করতে পারতেন। একবার গান্ধীজী গাছের উপরে একটা নকল পাখিকে লক্ষভেদ করতে বলেছিলেন। ক্ষুদিরাম লক্ষভেদ করার সময় শুধু পাখিটির চোখ দেখেছিলান।’
শীতলবাবু হুঙ্কার দিলেন, ‘অ্যাঁ… স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নিয়ে রসিকতা, অ্যাঁ…’
আমার মাথায় পরপর দুটো গাঁট্টা পড়ল। মাথার ঘিলু নড়ে গেল। ভারত ছাড় আন্দোলন, সিপাহী বিদ্রোহ, জালিওয়ানা বাগের হত্যাকাণ্ড সব একাকার হয়ে গেল। আড় চোখে দেখলাম পাশে গণেশ মুচকি মুচকি হাসছে।
যথারীতি শীতলবাবুর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে গণেশ ধরা পড়ল। ‘এই যে, স্ট্যাণ্ড আপ। তুই হাসছিস কেন? আমাকে দেখে মজা পাচ্ছিস…’
‘না স্যার, মানে স্যার পল্টুর ইতিহাস জ্ঞান দেখে হাসি পাচ্ছিল…’
‘তাই নাকি, তাহলে তোর ইতিহাস জ্ঞানটা একটু দেখি।’ শীতলবাবু গণেশের খাতা ধরে টানলেন।
‘একিরে… এতো কবিতা লিখেছিস! সিপাহী বিদ্রোহ নিয়ে কবিতা। বাহ বাহ…’
স্যার পাঁচালির সুরে পড়তে আরম্ভ করলেন,
‘ইংরেজ ভার্সেস ভারতীয় সৈন্য,
বিলাতীয় বৈভব, এদেশীয় দৈন্য।
কবিতার মাধ্যমে জানাবই ধিক্কার,
হই হই কাণ্ড, রই রই চিৎকার।
ঐ আসে ইংরেজ, হাতে দামী বন্দুক,
লাল মুখো গোরা দেখে প্রাণ করে ধুকপুক।
ভয় নেই এসে গেছে মঙ্গল পাণ্ডে,
ঘুঘু দেখা ইংরেজ পড়িবেই ফান্দে।’
এরপরেই গণেশের মাথায় দুটো রাম গাঁট্টা পড়লো। আমার ভেতরে ভেতরে বেশ আনন্দ হচ্ছিল। কিন্তু মুখ গম্ভীর করে রাখলাম। হাসিমুখ দেখলেই শীতলবাবু গাঁট্টা কষাতে পারেন।
সময় শেষের দিকে, আমি একমনে লেখার চেষ্টা করছি, “গান্ধীজীর এই ভারত ছাড়ো আন্দোলনের চাপেই ইংরেজরা ভারত ছাড়ে এবং ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট ভারত স্বাধীন হয়। ভারতের আকাশে তিন রঙা পতাকা ওড়ে…”
হঠাৎ ধাঁই করে একটা জোর আওয়াজ আর তারপরেই সুদীপ্তর চিল চিৎকার, ‘বাবারে, মরে গেলুম রে…’
শীতলবাবু পর্যন্ত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। তিনি ঘটনাস্থলে দৌড়ে গেলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি হয়েছে?’
‘স্যার, সত্য আমাকে জুতো ছুঁড়ে মেরেছে।’
‘অ্যাঁ, জুতো ছুড়ে মেরেছে? তাও যেখানে আমি আছি? সত্য, তোর এতো সাহস হলো কি করে?’
সত্যব্রত দাঁড়াল। নীচু গলায় বলল, ‘স্যার, আমি জুতো ছুড়ে মেরেছি এটা সত্যি। কিন্তু তার পেছনে কারণ আছে। সেই কারণটা শুনে নিন। তারপর যে শাস্তি দেবেন, মাথা পেতে নেব।’
সত্যব্রত মধ্যমগ্রাম স্কুলের সুব্রতকাপ দলের গোল রক্ষক। কোনও পরিস্থিতিতেই ঘাবড়ায় না। আমরা হলে শীতল বাবুর সামনে এতো সাজিয়ে গুছিয়ে কথা বলতে পারতাম না।
শীতলবাবু দাঁত কড়মড় করে বললেন, ‘বল, তোর চটি ছোড়ার পেছেনের কারণটা বল। তারপর মজা দেখাচ্ছি।’
‘স্যার, আমি গোলকিপার। গোল আটকানো কাজ। পরপর ম্যাচ ছিল। তাই আর বই খোলার সময় পাইনি। এই প্রশ্নপত্রের একটাও প্রশ্ন পারব না। সুদীপ্তকে তাই বলেছিলাম কয়েকটা উত্তর বলে দে, যাতে পাশ নম্বরটা উঠে আসে। সুদীপ্ত বলল, পনেরো মিনিট পরে বলছি। আমি যেটা লিখছি, সেই উওরটা শেষ করে নি।
পনের মিনিট পরে ওকে আবার জিজ্ঞাসা করলাম। বলল, আর একটু বাদে বলছি।
এভাবে পনেরো মিনিট বাদে বাদে আমি জিজ্ঞাসা করে গেছি, আর ও একই কথা বলে গেছে। “পনেরো মিনিট বাদে বলছি।”
পরীক্ষা শেষ হতে আর পনেরো মিনিটও বাকি নেই। আমি ওকে বললাম, এবার তো বল। ও একই উত্তর দিল, “পনেরো মিনিট বাদে বলছি।”
আমি আর ধৈর্য্য রাখতে পারিনি। এর চেয়ে সুদীপ্ত প্রথমেই বলে দিতে পারতো বলবে না। মিথ্যা কথা বলার দরকার ছিল না। মিথ্যা কথা বলা অন্যায়। আর অন্যায় যে করে সেও যেমন দোষী, অন্যায় যে সহ্য করে সেও সমান দোষী। তাই আমি অন্যায় সহ্য করিনি। চটি ছুঁড়ে মেরেছি। সুদীপ্ত আর সহজে মিথ্যে বলবে না।’
সুশীলবাবু হুঙ্কার দিলেন, ‘তোর বক্তব্য শেষ হয়েছে?’
‘হ্যাঁ স্যার।’
‘তোরা দুজনেই এগিয়ে আয়। খাতা নিয়ে এগিয়ে আয়।’ শীতলবাবু টেবিল থেকে বেতটা হাতে নিলেন।
এর পরে কি হতে চলেছে সকলেই জানে। অতএব তার বিস্তারিত বিবরণ নিষ্প্রয়োজন।