প্রতিটি মানুষের জীবনে গল্প থাকে। ভালোবাসার গল্প, ভালোবাসা হারিয়ে ফেলার গল্প, লড়াইয়ের গল্প, খিদের গল্প, হেরে যাওয়ার গল্প, উত্তরণের গল্প। এগুলো আমাদের অজানাই থেকে যায়। দুয়েকটা গল্প অকস্মাৎ যখন আমাদের সামনে অভিনীত হয়, আমরা হতবাক হয়ে যাই।
অনেকবছর আগের কথা। তখন মেডিক্যাল কলেজের সার্জারি ডিপার্টমেন্টে ইন্টার্নশিপ চলছে। সবে ডাক্তার হয়েছি। সবকিছুতেই চরম উৎসাহ। সারাদিন হাসপাতালেই পড়ে থাকি। পিজিটি দাদারা, হাউসস্টাফ দাদারা যা করতে বলে সে সব করে নিজেকে ধন্য মনে করি।
রক্ত টানা, চ্যানেল করা, ক্যাথেটার পরানো, রাইলস টিউব পরানো শিখে গেছি। ছোটো খাটো কাঁটা ছেঁড়া দিব্যি সেলাই করে দিচ্ছি। এমনকি এমারজেন্সিতে সাধারণ সমস্যা নিজেই চিকিৎসা করে বাড়ি পাঠাচ্ছি।
একদিন বিকাল বেলায় একটি চৌদ্দ বছরের মেয়ে “হেড ইনজুরি” নিয়ে ক্যাজুয়ালটি ব্লকে (সিবি টপ) ভর্তি হল। সিটি স্ক্যান হয়েছে। মেয়েটির মাথার মধ্যে সামান্য রক্ত জমেছে। মেয়েটির জ্ঞান আছে। তবে বমি করছে।
হাউসস্টাফ দাদা দেখে বলল, ‘বাঁ হাতটাও তো একেবারেই নাড়তে পারছে না। মনে হচ্ছে কনুইটা ভেঙ্গেছে। তুই নীচে নিয়ে এমারজেন্সি থেকে একটা এক্স রে কর। যদি ফ্র্যাকচার থাকে তাহলে একেবারে অর্থোপেডিক্সের কাউকে দেখিয়ে আনবি। প্লাস্টার করতে হলে একেবারে করিয়ে আনবি। মাথায় যেটুকু হেমারেজ হয়েছে তার জন্য মনে হয়না বড় সমস্যা হবে। আমি নিউরো সার্জারিতে একটা রেফার লিখে রাখছি।’
মেয়েটির বেড জোটেনি। সিবি টপের বারান্দার মেঝেতেই ভর্তি ছিল। মেয়েটির বাবা একটু দূরে বিষণ্ণ মুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হত দরিদ্র চেহারা। তাঁকে ডেকে নিলাম। ওয়ার্ডের এক দাদাকে ডাকলাম। একটা ট্রলি লাগবে।
লিফটে নামতে নামতে মেয়েটির বাবাকে বললাম, ‘কী করে এমন হলো?’
মেয়েটির বাবা বলল, ‘ও উঁচু থেকে পড়ে গেছে?’
‘উঁচু মানে? পাঁচিল থেকে নাকি ছাদ থেকে পড়েছে?’
‘না না, দড়ি থেকে পড়ে গেছে?’
অবাক হয়ে বললাম, ‘দড়ি থেকে পড়ে গেছে মানে?? দড়ির উপর ও কী করছিল?’
মেয়েটির বাবা বললেন, ‘রুহানা দড়ির উপর ব্যালেন্সের খেলা দেখায়। আমি আর মেয়ে মিলে খেলা দেখাই। ও দড়ির উপর ভল্টও খেতে পারে। আজ যে কী হলো…? কী করে যে পড়ে গেল? অন্যমনস্ক হয়ে গেছিল একটু।’
এতক্ষণে আহত মেয়েটির অত্যন্ত রংচঙে তাপ্পি দেওয়া ফ্রকটা পরে থাকার কারণ বুঝলাম। বললাম, ‘দড়ি থেকে পড়ে এমন হয়ে গেল? কত উঁচুতে দড়ি টানিয়েছিলেন?’
‘তা দশ ফুট হবে। ওর থেকে নিচে টাঙালে খেলা ঠিক জমে না। লোকে পয়সাও দিতে চায়না।’
‘দশ ফুট উপরে একটা মেয়েকে দড়ির উপর হাঁটাবেন, আর কোনো সুরক্ষার ব্যবস্থা রাখবেন না। নীচে কিছু পাতেন নি?’
ওর বাবা অবাক হয়ে বললেন, ‘কী আবার পাতব? আমরা যাযাবর মানুষ বাবু। বাপ ঠাকুরদার আমল থেকে আমাদের ঘরের ছেলে মেয়েরা এই খেলা দেখায়। নিচে কিছু বিছিয়ে রাখলে খেলাটা হবে কী করে?’
এক্সরে রুমে ঢুকিয়ে এক্সরে করা হলো। প্লেট নিয়ে ছুটলাম অর্থোপেডিক্সের অনকল রুমে। দেখা গেল হাউসস্টাফ দাদার আশঙ্কাই সত্যি। মেয়েটির রেডিয়াসের উপর দিকে ভেঙেছে। তবে ভাঙা জায়গাটা সরে যায়নি। হাড়ের ডাক্তারবাবু এমারজেন্সিতে এসে প্লাস্টার করে দিলেন।
নিউরোসার্জন দেখে জানালেন, ‘এখুনি কিছু করার নেই। ওষুধপত্র চলুক। দরকার হলে ছুটি দিয়ে দেওয়া যেতে পারে। পরে আউটডোরে এসে দেখাবে।’
দু’দিন বাদে সার্জারির ভিজিটিং প্রফেসর দেখে বললেন, ‘এভাবে বারান্দার মেঝেতে ফেলে রাখার কোনো মানে নেই। ছুটি দিয়ে দাও। একমাস বাদে এসে দেখিয়ে যাবে। ছয় সপ্তাহ বাদে প্লাস্টারটাও কেটে যাবে।’
ছুটি লিখে দেওয়া হলো। কিন্তু ইভনিং রাউন্ডে এসে দেখি মেয়েটি তখনও মেঝের বিছানায় বসে আছে। বাড়ি যায়নি।
জিজ্ঞাস করলাম, ‘কীরে বাড়ি যাসনি কেন?’
মেয়েটি কাঁদো কাঁদো হয়ে জানাল, আজ তার বাবা আসেনি। তাই ছুটিও হয়নি।
বেশ রাগ হয়ে গেল। এইটুকু একটা মেয়ে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে পড়ে গেছে। সকালের ভিজিটিং আওয়ার চলে গেল। বিকেলের ভিজিটিং আওয়ার চলে গেল। মেয়েটার বাবা একবারও আসার সময় পেল না। যাকগে- মরুকগে, কাল যদি সকালেও কেউ না আসে ওয়ার্ড মাস্টার অফিসে খবর দেব।
রাউন্ড দিয়ে বেরচ্ছি, দেখি গেটের সামনে গোলযোগ। একটি লোক ওয়ার্ডে ঢুকতে চাইছে, আর সিকিউরিটির ছেলেটি কিছুতেই তাকে ঢুকতে দেবে না। বারবার বলছে ভিজিটিং আওয়ার শেষ হয়ে গেছে। এখন ঢোকা যাবে না।
আমাকে দেখে লোকটি চিনতে পারল। বলল, ‘ডাক্তারবাবু, আপনি একবার বলে দিন না যেন ঢুকতে দেয়। সারাদিন মেয়েটাকে দেখিনি।’
রুহানার বাবা। ভালোমতো ঝাড় দিতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু লোকটির দিকে তাকিয়ে থমকে গেলাম। লোকটি একটি বছর দশেকের মেয়ের হাত ধরে রয়েছে। তারও পরনে ঝলমলে অথচ শতছিন্ন ফ্রক। গম্ভীর গলায় বললাম, ‘আক্কেল কী আপনার? ছোটো একটা মেয়েকে ভর্তি করে সারাদিনে একবারও আসার সময় পান না? আর অসময়ে এসে ঝামেলা করেন। সকালেই আপনার মেয়ের ছুটি লিখে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ছুটি দেওয়ার তো নির্দিষ্ট সময় আছে।’
লোকটি মাথা নিচু করে বললেন, ‘আসলে খেলা দেখাতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল?’
অবাক হয়ে বললাম, ‘খেলা…? কিন্তু যে খেলা দেখায় সেই মেয়েই তো আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি।’
লোকটি বলল, ‘খেলা বন্ধ রাখা তো মুশকিল। আমরা দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ বাবু। একদিন উপার্জন না করলে খাওয়া জোটা মুশকিল। রুহানা নেই, তাই ওর বোন খেলা দেখাচ্ছে। ও অবশ্য রুহানার মতো অতটা ভালো পারে না।’
কিছু বলতে গিয়ে থমকে গেলাম। মানুষ কতটা অসহায় হলে এভাবে নিজের আত্মজাদের বারবার বিপদে ঠেলে দিতে পারে।