১
হুইপস্ ক্রশ হাসপাতালের কার-পার্কিং থেকে গাড়িটা বের করে ওয়ালথামস্টাও টিউব ষ্টেশনের দিকে এগোলো নন্দিতা। নন্দিতা এন আর এসের ছাত্রী। এম ডি করে এদেশে এসেছে। এখন রেজিস্ট্রার, শিশুবিভাগে। স্বামী সঞ্জয় প্লাস্টিক সার্জেন। প্রেসটনে থাকে। লন্ডন থেকে ঘন্টা তিনেকের ড্রাইভ। দুজনে দুই শহরে। কিছু করার নেই। তিন বছরের মেয়ে আছে নন্দিতার। তার জন্য দুধ আর কয়েকটা টুকিটাকি জিনিস কিনতে হবে। আর তাছাড়া শোনা যাচ্ছে লক ডাউন হয়ে যাবে। করোনার ছায়া ব্রিটেনেও বাড়ছে। এখনও কেন করছে না, কে জানে! ইতালি, স্পেনের যা অবস্থা হয়েছে! কয়েক জন ওদের হাসপাতালেও ভর্তি হয়েছে। এখনো সেরকম কোনো ব্যবস্থাই নিচ্ছে না প্রশাসন। ন্যাশনাল হেল্থ সার্ভিস কি যে হার্ড ইমিউনিটির থিওরি দিচ্ছে! কি করে হয় কে জানে। টিউব চলছে, বাস চলছে। রেস্তরাঁ, পাব সব খোলা। গিজগিজ করছে লোক। সিটি, গ্যাটউইক- প্রত্যেকটা এয়ারপোর্ট চালু। দলে দলে লোক কন্টিনেন্ট থেকে এসে নামছে। সেরকম টেস্ট তো করা হচ্ছেই না। এখান থেকে লোকে কলকাতায় গিয়ে ধরা পড়ছে। কলকাতার বন্ধুরা গালাগাল দিচ্ছে। আগে ধারণা ছিল এন এইচ এস সব সামলে নেবে। ইতালির এই অবস্থার পরে এক ধরনের শিরশিরানি ভয় মনের মধ্যে ঢুকে গেছে। দুজনেই ডাক্তার, আজ হোক কাল হোক করোনা তো হতেই পারে। বাচ্চাটার কি হবে কে জানে!
এপিং ফরেষ্ট বাঁদিকে রেখে ডানদিকের রাস্তা ধরল নন্দিতা। লন্ডন শহরের মধ্যেই এরকম একটা জঙ্গল- ভাবাই যায় না। টেসকো এক্সপ্রেসে যেতে হবে। ওয়ালথামস্টাও ষ্টেশনের আগেই পড়বে টেসকো। এখানে পার্কিং পাওয়া খুব মুশকিল। অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে একটা জায়গায় গাড়ি রেখে সুপার মার্কেটে ঢুকে পড়ল সে। বাইরে থেকে বোঝা যাচ্ছিল না। ভেতরে প্রচুর ভীড়। মাত্র দুটো শপিং কার্ট পড়ে আছে। কয়েন ঢুকিয়ে তার একটা আনলক করে নিয়ে শেলফের দিকে এগোতেই দেখল একটা মোটাসোটা লালমুখো ব্রিটিশ একটা অল্প বয়স্ক মঙ্গোলয়েড মেয়েকে গালাগাল দিচ্ছে, ‘ ‘ইউ চাইনিজ, ইউ ব্রট দিস ভাইরাস টু আওয়ার কান্ট্রি, ফা* অফ’।
মঙ্গোলয়েড মেয়েটা কোরিয়ান-ও হতে পারে। স্টুডেন্ট মনে হয়। তাই আর কথা বাড়ালো না। শেলফে একটাও পাঁউরুটি নেই, মাখন নেই। ফ্রুট জুস নেই, টিস্যু নেই। সব খালি। ব্রিটিশ লোকটার শপিং কার্টে উপছে পড়ছে ট্যিসু পেপারের রোল, আরো অন্যান্য জিনিস।
‘হোয়াট আর ইউ ডুইং, ম্যান?’ নন্দিতা বলল। একটা আগুনে দৃষ্টি হেনে লোকটা অন্য দিকে চলে গেল। এরকম অভিজ্ঞতা কখনও হয় নি। ব্রিটিশরা খুব খারাপ কথাও প্রোটোকল মেনে মিষ্টি করে বলে।
বেবিফুডের দিকে এগোতেই একটা লম্বা মত শ্বেতাঙ্গ মহিলা রাস্তা আগলালো। ‘ইউ ইন্ডান, ইউ পিস অন দ্য ষ্ট্রীট। গেট লষ্ট।’
প্রচন্ড রেগে যেতে গিয়েও ঠান্ডা মাথায় একজন শপিং অ্যাসিস্ট্যান্টকে ডেকে পুলিশে খবর করল সে। পার্স থেকে হাসপাতালের আই কার্ডটা বের করে দেখালো সে। ‘আই ওয়ার্ক ইন এনএইচএস।’
‘আই অ্যাম সরি, ম্যা’ম’। পুলিশ তাকে এসকর্ট করে পার্কিং অবধি পৌঁছে দিল।
গাড়িতে বসে নন্দিতা দেখল, মোটাসোটা শ্বেতাঙ্গ লোকটাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে। এখানে রেসিয়াল আক্রমণকারীকে খুব কড়াভাবে দমন করা হয়। ইলিং ব্রডওয়ের দিকে গাড়ি চালিয়ে দিল সে। ওখানেই ওর বাড়ি।
২
পুষ্পিতা শিশিরকুঞ্জের গেট থেকে বেরিয়ে বাঁদিকে ঘুরেই অবাক হয়ে দেখল ষ্টারমল বন্ধ। স্পেনসার থেকে কিছু জিনিস কেনার ছিল। কার্ফু তো কালকে! আজ থেকেই সব বন্ধ? যাকগে, বেঁচে থাক মিলিদির দোকান। উল্টো দিকের গলিতেই বড় দোকান। দরকারি সব জিনিস পাওয়া যায়। লিষ্ট মিলিয়ে সবকিছুই পেয়ে গেল সে। কার্ডে পেমেন্ট করা যাবে না এখানে। অথচ নন্দিতা পইপই করে বলে দিয়েছে ক্যাশ দেওয়া-নেওয়া না করতে। কারেন্সি নোট থেকে নাকি করোনা ছড়ায়! নন্দিতা ওর থেকে আট বছরের ছোট। কিন্তু ও ডাক্তার। লন্ডনের হাসপাতালে চাকরি করে। ও ভালো জানে।
কি যে এক রোগ এসেছে চীন থেকে! ডেঞ্জারাস রোগ। হু-হু করে ছড়িয়ে পড়ছে সারা পৃথিবীতে। আর সেই রকম মৃত্যুহার। এখানেও আস্তে আস্তে বাড়ছিল। এখন দ্রুত বাড়ছে। কিন্তু লোকে বুঝলে তো! দোকান-পাট, বাস-ট্রেনে কী ভীড়! হবে না-ই বা কেন। একশ চল্লিশ কোটির দেশ। এখানে চীন-ইতালির মত শুরু হলে কি হবে কে জানে! লোকের সামান্য সচেতনতা নেই। পাত্তাই দিচ্ছে না! ভারতের মত গরম দেশে নাকি ভাইরাস বাঁচে না।
পুষ্পিতা কলেজে পড়ায়। ফ্ল্যাটে একাই থাকে। স্বামী সুজন উইপ্রোতে। মিউনিখে থাকে, বি এম ডব্লিউ প্ল্যান্টে দু-বছরের প্রোজেক্ট। সামনের জুনে শেষ হবে। ছেলে ব্যাঙ্গালোরে ডাক্তারি পড়ে। সুতরাং অন্য সময় ঝাড়া হাত-পা। কিন্তু এখন খুব চিন্তা হচ্ছে সবার জন্য। জার্মানিতে তো খুব ছড়িয়েছে। কিন্তু সুজন এখন আসতে পারবে না। সব ফ্লাইট বাতিল। তবে রোজ যেতে হচ্ছে না অফিসে। বেশিরভাগটাই ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’।
‘ও দিদি, হাতটা পাতুন।’ মিলিদি-র কথায় সম্বিত ফিরতেই হাতটা বাড়িয়ে দিল সে।
দু-তিন ফোঁটা হ্যান্ড স্যানিটাইজার ঢেলে দিল মিলিদি।
ফিরতে ফিরতে পুষ্পিতা দেখল মদের দোকানে লাইন। চিকেন কেনার জন্য ভীড়।
৩
সন্ধ্যা সাতটা। চারদিক শুনশান। শনিবার এই সময় মারিয়ান প্লাৎজে গিজগিজ করে লোক। মারিয়ান প্লাৎজ মিউনিখের এসপ্ল্যানেড। এখন সেখানে প্রায় সব দোকানপাট বন্ধ। শুধু রেভে সুপার মার্কেট খোলা আছে। গোটা ইউরোপের সঙ্গে করোনা আতঙ্কে কাঁপছে মিউনিখ। অগাষ্টিনিয়ার বিয়ার পাব অবধি বন্ধ! ফোরটিনথ্ সেঞ্চুরির পাব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও যেটা বন্ধ হয় নি। একটু ভয় ভয় করছে সুজনের। গতকাল থেকে ওয়ার্ক ফ্রম হোম করছে। বি এম ডব্লিউ ভেল্টে আর যেতে হচ্ছে না।
মিউনিখের সাথে গোটা ব্যাভেরিয়াই নাকি কালকে লকডাউন হয়ে যাবে। রেভে-তে ঢুকে দেখল কিছু খদ্দের আছে। শেল্ফ গুলোর সামনে তিনফুট দূরে দূরে লাল লাইন টানা। কেউ সেটা ক্রশ করছে না। পরস্পরের থেকে দূরত্ব বজায় রাখছে। শেল্ফে প্রচুর জিনিস। যা যা দরকার নিয়ে লাইন দিয়ে পেমেন্ট করল। পেমেন্টের লাইনেও তিনফুট দূরে দূরে দাগ টানা। জার্মানরা ডিসিপ্লিনড্ জাত। ওরা বেঁচে যাবে।
গ্রুনওয়াল্ডার স্ট্রাসে-তে ওর বাড়ির সামনেই মেট্রো ষ্টেশন। অন্য সময় মেট্রোতে যাতায়াত করলেও আজ রিস্ক নেয় নি। নিজের কিয়া এসইউভি টা নিয়ে বেরিয়েছে। বি এম ডব্লিউ তে চাকরি করলেও সুজন নিজে কিয়া-র গাড়ি ব্যবহার করে। বাড়ির কাছেই হাসপাতাল। শোন ক্লিনিক। যদিও প্রাইভেট হাসপাতাল। কিন্তু ওদের অফিসের সাথে চুক্তি আছে। একবার করোনার টেস্ট হয়ে গেছে তার, নেগেটিভ এসেছে। দু-সপ্তাহ বাদে আবার টেস্ট হবে। পুষ্পিতা খুব উদ্বিগ্ন। রোজ সকাল-বিকেল ফোন করে। একা থাকে না সে অবশ্য। কুশল নামে মহারাষ্ট্রের একজনের সাথে বাড়ি শেয়ার করে। কিছু হলে ও-ই ভরসা। এইসব ভাবতে ভাবতে গাড়ি স্টার্ট দিল সে।