(পূর্ব প্রকাশিত-র পর……)
শিলিগুড়ির দিকের আটকে পড়া গাড়িগুলো পেরিয়ে প্রায় দেড় মাইল হেঁটে পৌঁছে গেলাম গ্রাউন্ড জিরোতে। রাস্তা এমন ধসে গেছে যে, গাড়ি তো দূরের কথা, জায়গাটা হেঁটে পেরোতে গেলেও কলজের জোর লাগবে। প্রচন্ড পিছল দুটো পাথর। তার মাঝখান দিয়ে জলের ধারা বয়ে চলেছে প্রবল গতিতে। পা পিছলে গেলে একেবারে একশ’ ফুট নীচে।
তখন বয়স নেহাৎ কম ছিল। তাছাড়া মাঠাবুরুতে নেওয়া মাউন্টেনিয়ারিং ট্রেনিং-এর টেকনিকগুলো পুরোপুরি ভুলে যাইনি তখনো। যা থাকে কপালে – এই ভেবে ব্যাগটা ছুঁড়ে দিলাম অপর পারে একটা লোকের দিকে। তারপর জুতো খুলে পাথরের খাঁজ ধরে ধরে পেরিয়ে গেলাম জায়গাটা। এতবছর বাদে যত সহজে লিখলাম,ব্যপারটা আদতে মোটেই তত সহজ ছিল না।
সোনাদা টয়ট্রেনের একটা ষ্টেশন। কখন ট্রেন পাওয়া যাবে সেই অপেক্ষায় না থেকে দার্জিলিং-গামী এক ট্রেকারে চেপে বসলাম। কুয়াশায় মোড়া ‘ঘুম’ পেরিয়ে আবার নীচে নেমে গাড়ি ঢুকে পড়ল ঘিঞ্জি, স্যাঁতস্যাঁতে, বর্ষাভেজা দার্জিলিংয়ে।
বাসষ্ট্যান্ড থেকে উপরে গৌতমদার আস্তানা। সেখানে গিয়ে হাজিরা দিতেই পাহাড়ের মত চেহারা আর সিংহের মত হৃদয়ের গৌতমদা খপ করে ধরে বসিয়ে দিল ওর পাশের চেয়ারে। সামনে তার আল্ট্রাসোনোগ্রাফি মেশিন।
‘চপ-মুড়ি খা।’
ব্যাগটা কোনোমতে পায়ের কাছে গুঁজে গরম চপ-মুড়ি তে মনোনিবেশ করলাম। পেটে ছুঁচোয় ডন দিচ্ছে ততক্ষণে। ডাক্তার গৌতম নিয়োগীর স্নেহের পাল্লায় যে পড়েনি, সে কোনদিন বুঝবে না তার কি মজা।
‘আজ স্নান খাওয়া-দাওয়া সেরে রেষ্ট নে। কাল সিএমওএইচ অফিসে যাওয়া যাবে।’
‘আজ হবে না?’
‘আরে মোলো যা! পোষ্টিং তো একটা জুটিয়েছিস কোন্ ধ্যাদ্ধেড়ে গোবিন্দপুরে চায়না বর্ডারে।’
‘চায়না বর্ডারে?’
‘ওই হ’ল। কালকে যা, দাওয়া তোকে ভাল করে বুঝিয়ে দেবে।’
দাওয়া লামা। সিএমওএইচ অফিসের বড়বাবু। অনেক বছর ধরে প্রায় একাই চালাচ্ছে অফিস। দার্জিলিং জেলার ম্যাপ, মানুষ, ভাষা ও ভূপ্রকৃতি নাকি তার মুখস্থ। আধঘন্টা বসে থাকার পরে ডাক পড়ল দাওয়া দাজু-র টেবিলে। আমার পোষ্টিং অর্ডারটা দেখে হাঁ করে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল আমার মুখের দিকে। যেন আমি কোনো গ্রহান্তরের জীব।
‘সামথার-সামালবং এ জয়েন করবেন আপনি?’
‘হ্যাঁ।’
‘খাওয়া-দাওয়া সেরে তিনটের সময় আসুন।’
খুব ইচ্ছা করছিল কেভেন্টার্সে খেতে। কিন্তু পকেট গড়ের মাঠ। আর তাই চকবাজারের ছোট্ট মোমোর দোকানটাতে গেলাম লাঞ্চ করতে। গিয়ে ভুল করিনি। বাঁধাকপি দিয়ে তৈরি গরম মোমোগুলো মুখের মধ্যে যেন গলে গেল। অথচ খুব সস্তা।
একঘন্টার জন্য আস্তানায় ফিরে লাভ নেই। সরু সিঁড়ির ধাপ নেমে গেছে ম্যালের দিকে। সেই রাস্তায় শর্টকার্ট নিয়ে ম্যালে বেড়িয়ে এলাম। লোকজন নেই। মেঘলা আবহাওয়া, চারদিক ফাঁকাফাঁকা। ঝিরঝিরে বৃষ্টি নামতেই ছাতা খুলে আবার ফিরে চললাম সিএমওএইচ অফিসের দিকে।
তিনটের সময় আমি ফায়ার প্লেসের পাশে দাওয়া লামা-র উল্টোদিকের চেয়ারে। অফিস প্রায় ফাঁকা। এখানে দুপুর দুটো বাজতেই সবাই বাড়ি ফেরার পথ ধরে। তারপর ধীরে ধীরে আঁধার নেমে আসতে থাকে চারিদিকে। বর্ষা ভেজা, কুয়াশা ঢাকা পাহাড়ি পথে অন্ধকারে চলাফেরা করা আর মৃত্যুকে চুম্বন করা প্রায় একই ব্যাপার।
‘আমার চাকরিজীবনে সমতলের কোনো ডাক্তারকে সামথারে জয়েন করতে দেখি নি। মাঝেসাঝে পোষ্টিং হয় অবশ্য কারো কারো। কিন্তু কেউ আসে না।’
‘এখন কোন্ জিডিএমও আছে ওখানে?’
‘কেউ না। ওটা আসলে সাব হেল্থ সেন্টার। কোনো বেড নেই, শুধু আউটডোর। এখন নামকে-ওয়াস্তে নিউ পি এইচ সি হয়েছে। তাছাড়া ডাক্তার থাকবে কোথায়? কোয়ার্টার নেই। কাছাকাছি ছোট্ট আদিবাসী বস্তি। সেখানে কয়েক ঘর মানুষ থাকে। তবে বাংলা ছেড়ে দিন, তারা নেপালীও ভালো বলতে পারে না। লোকাল একজন ফার্মাসিষ্ট আছে। সে-ই ওষুধপত্র দেয় প্রয়োজন মত।’
‘এখান থেকে সামতাহার যাব কি করে?’
‘ভুতুড়ে জায়গা। গিয়ে কি করবেন?’
‘কেন, ভুতুড়ে কেন?’
‘নিজেই দেখতে পাবেন।’
‘ও।’
সিএমওএইচ অফিসে কাগজ, খাতাপত্রে সইসাবুদ করে জয়েন করা গেল। রাম্ভীবাজারের বিএমওএইচ-কে একটা চিঠি করে দিল দাওয়া দাজু।
‘রোজ এসএনটি-র একটা বাস ছাড়ে দার্জিলিং বাসস্ট্যান্ড থেকে। ওটা তিস্তাবাজার হয়ে গ্যাংটক যায়। তিস্তাবাজারে নামতে হবে। ওখান থেকে কালিম্পং আঠেরো কিলোমিটার।’
‘এসএনটি মানে কি?’
‘সিকিম ন্যাশন্যালাইজড ট্রান্সপোর্ট। সারা দার্জিলিং আর সিকিম জুড়ে ওরা বাস চালায়।’
‘বুঝলাম। তারপর কালিম্পং থেকে কিভাবে যাব?’
‘কালিম্পং থেকে সামথার ছ’ঘন্টার রাস্তা। রাস্তা মানে, অর্ধেকপথ পাকা রাস্তা, বাকিটা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বোল্ডার ফেলা পায়ে চলা পথ – রাস্তার কোনো অস্তিত্বই নেই। তবে কিসে যেতে হবে, তা এখান থেকে বলতে পারব না।’
‘অ্যাঁ, বলেন কি?’
‘অবশ্য সেসব গৌতম দাজু আপনাকে ব্যবস্থা করে দেবে। এবার চলুন, আপনাকে হাসপাতালে পৌঁছে দিই। সব ডাক্তার-রা এখন ওখানেই আছে।’
যেসব তথাকথিত শুভানুধ্যায়ীরা আমার জন্য এরকম একটা পোষ্টিং খুঁজে বের করেছে তাদের প্রনাম জানাতে ইচ্ছে করছে!
দাওয়া দাজুর সাথে মারুতি জিপসি চেপে দার্জিলিং টিবি স্যানাটোরিয়াম পেরিয়ে হাসপাতালের গেট দিয়ে ঢুকে পড়া গেল। জিপসি চড়ার সখ মিটল এর সাথে।
‘সামথারের আগে আপনাকে যেতে হবে রাম্ভী। ওটাই আপনার ব্লক, বিপিএইচসি। এলপিসি এবং মাইনে ওখান থেকেই হবে।’
এল পি সি মানে, লাস্ট পে সার্টিফিকেট।
‘নিন, এবার এসে পড়েছি। কাল আসবেন, কথা হবে।’
গাড়ি থেকে নেমে জেলা হাসপাতালের অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেলাম।
(চলবে)
অপেক্ষায় রইলাম… পরের কিস্তির জন্য