আজ সকাল থেকেই খুব ব্যস্ত সরলা দেবী। রান্নাঘরে একের পর এক সুস্বাদু পদ রেঁধে চলেছেন। রাঁধবেন নাই বা কেন! চারমাস পর তাঁর একমাত্র ছেলে বর্ণক যে বাড়ি ফিরলো। না না… সে কোনো বিদেশ বিভূঁইয়ে আটকে পড়েনি, এরাজ্যেই ছিল। কিন্তু ওই করোনা! লকডাউনে সবাই যখন ঘরবন্দী, তখন ডাক্তারদের তো সেই হাসপাতালের সম্মুখ সমরেই লড়ে যেতে হয়েছে। বাবা মায়ের একাধিক কোমর্বিডিটি থাকায় আর বাড়ি ফেরার রিস্ক নেয় নি সে। এই চারমাস সরলা দেবী শুধু দুঃশ্চিন্তাতেই কাটিয়েছেন। টিভিতে যখনই খবর দেখেছেন তখনই ছেলের মুখটা ভেসে উঠেছে। ঠিক করে পি.পি.ই. পড়েছে তো? এই গরমে অতখন জল না খেয়ে থাকবে কিভাবে? ডিউটি থেকে ঘরে না ফেরা অব্দি খুব চিন্তায় থাকতেন। ফোনে না পেলেই একরাশ আতঙ্ক গ্রাস করতো। যদিও ফোনের ওপাশ থেকে বর্ণকের গলা ভেসে আসতো, “তুমি চিন্তা করো না মা, আমার কিছু হবে না।”
তিনিই একদিন জোর গলায় ছেলেকে বাড়ি আসতে বলেছিলেন। করোনা থেকে মুক্তি কবে মিলবে কেউ জানে না, কিন্তু মায়ের মন কতদিন আর ছেলেকে না দেখতে পেয়ে ঠিক থাকে! বাড়ির আলাদা একটা ঘর, সাথে অ্যাটাচড বাথরুম ঠিক করে রেখেছিলেন বর্ণকের কথামত। দূর থেকে শুধু খাবারটা দিয়ে আসেন। মাস্ক পরে দূরত্ব বজায় রেখে দু-চার কথা যা বলা যায় ওই সময়।যাক…চোখের দেখা তো হয়, সেটাই বড় শান্তি তাঁর কাছে। তাঁরও বয়স বাড়ছে…আর কতদিন ধৈর্য ধরবেন? তাই ছেলের বিয়ে দেবেন ঠিক করেছিলেন।
কিন্তু বিয়ের কথা তুললেই বৰ্ণক বলতো “এখন না, এমডি কমপ্লিট হোক আগে!” আর এমডি শেষ হতে না হতেই এই করোনার ঝামেলা।
তিনি একদিন বলেই ফেলেছিলেন, “যে হারে তোর মাথার চুল ফাঁকা হচ্ছে, কদিন পর আর কোনো মেয়েই তোকে পছন্দ করবে না!”
একগাল হেসে বর্ণক বলে উঠেছিল, “জানো মা! টাকে চুল গজাতে পি.আর.পি. ভালো কাজ করে। আমিও এবার নেব ভাবছি।”
–“পি.আর.পি! সেটা কি?”
–“প্লেটলেট রিচ প্লাজমা। মানে সেন্ট্রিফিউজ মেশিনে নিজের রক্ত থেকে অনুচক্রিকা আলাদা করে, সেটা স্ক্যাল্পের ওই জায়গাগুলোতে ইনজেক্ট করা হয়।”
বর্ণকের প্রিয় মটন কারির রান্না প্রায় সম্পূর্ণ হয়ে এসেছে, সুন্দর গন্ধ বের হচ্ছে। রান্না শেষ করে সব খাবার গুছিয়ে নিয়ে ছেলেকে দিতে গেলেন সরলা দেবী। ঘরের কাছে যেতেই শুনতে পেলেন খুব উত্তেজিত হয়ে ফোনে কারও সাথে কথা বলছে বর্ণক। কথা শুনে বুঝতে পারলেন কেউ নতুন সন্তানের জন্ম দিয়েছে। কিন্তু নিজের সন্তানের জন্ম হলেও তো কেউ এত উত্তেজিত হয় না! ফোন শেষ করেই মাকে দেখতে পেয়ে বর্ণক বলে ওঠে, “দারুণ ব্যাপার মা! স্পাইনাল কর্ড ইনজুরির পেশেন্ট মা হয়েছে। নির্বিঘ্নে সন্তানের জন্ম দিয়েছে।”
অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকেন সরলা দেবী।
বর্ণক বলে চলে, “কত প্রতিভা, কত স্বপ্ন কুঁড়িতেই ঝরে যেত… রিহ্যাব মেডিসিনের জন্যই আজ তারা বাস্তবের মুখ দেখছে। আনন্দ আর্নল্ডের নাম শুনেছো? ভারতের প্রথম হুইল চেয়ার বডিবিল্ডার…মিস্টার অলিম্পিয়া। আর হ্যাঁ, তোমার ঐ প্রিয় সিরিয়াল.. যেটার মূল চরিত্র একজন তরুণ ডাক্তার, ওটা কার লেখা গল্প জানো?”
রিহ্যাব স্পেশালিস্ট ডা. বর্ণক সেনের দৃশ্যপটে ফুটে ওঠে পুরনো দিনের ছবি।
ডা. বর্ণক তখন জুনিয়র রেসিডেন্ট। সেদিন আউটডোর প্রায় শেষের দিকে, এমন সময় ফোনটা এলো। রোগী ভর্তি হয়েছে পি.এম.আর. ডিপার্টমেন্টের বাইরে এক বিশেষ ওয়ার্ডে, সবাই জানে ওই ওয়ার্ডটাতে নেতা মন্ত্রীরাই ভর্তি থাকেন। কিন্তু ঘটনা হল সংস্কারের পর এই ওয়ার্ডটির চেহারা পুরো পাল্টে গেছে…যেকোনো কর্পোরেট হাসপাতালকে টেক্কা দিতে সক্ষম এখন। তবে ভি আই পি থেকে সাধারণ নাগরিক সবাইকেই দৈনিক মোটা বেড ভাড়া ও অন্যান্য চিকিৎসা বাবদ খরচ মেটাতে হয়। শুধু চিকিৎসকের পিছনে কোনো পয়সা গুনতে হয় না। তিনতলার কেবিনগুলো ছোট হলেও দোতলার গুলো প্রায় দ্বিগুণ সাইজের। কেবিন ভাড়াও ঘরের সাইজের মতই কম বেশি। কেবিন নাম্বার শুনে বর্ণক বুঝতে পারল দোতলার বড় কেবিনগুলোর একটাতে ভর্তি হয়েছেন রোগী।
দরজা খুলে ঢুকতেই বর্ণক অবাক হয়ে যায় নায়কোচিত চেহারার একজনকে বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখে। প্রায় তারই সমবয়সী হবে, উচ্চতাও তার মতই ছয় ফুট। জিজ্ঞেস করে জানতে পারে উনিই রোগী। নাম বিবেক দাস। সত্যি, দেখে বোঝা মুশকিল যে এই তরুণ তরতাজা ছেলেটি হাঁটতে বা দাঁড়াতে পারে না। এমনকি নিজে নিজে বিছানা থেকে উঠে বসতে অব্দি পারে না! ডা. বর্ণক একবার বিবেকের জায়গায় নিজেকে কল্পনা করতেই মাথাটা ঘুরে গেল। গোটা জীবনটাই এই বিছানাতে কাটাতে হলে…না সে আর ভাবতে পারছে না। চিকিৎসা করতে গিয়ে এত ইমোশনাল হলে চলে না!
সম্বিৎ ফিরলো বিবেকের বাবার গলায়, “ডক্টর, ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড…একটা প্রশ্ন করতে পারি?”
বড় রাশভারী গলা ভদ্রলোকের। বর্ণক সায় দিতেই শুরু করলেন, “সারভাইকাল স্পাইনে ইনজুরির পরই অপারেশন হয়েছিল। নিউরোসার্জেন বললেন অপারেশন সাকসেসফুল…কিন্তু তারপরও কেনো এই কন্ডিশন?”
— “আচ্ছা আপনাকে একটা এক্সাম্পল দিয়ে বোঝাচ্ছি। রেললাইনের ওপর দিয়ে যখন ফ্লাইওভার হয়, তখন দেখবেন রেল অথরিটি শুধু রেললাইনের ওপর ব্রিজ বানানোর দায়িত্ব নেয় আর রোড ডেভেলপমেন্ট অথরিটি অ্যাপ্রোচ রোড বানায়। দুটোই দেখুন সমান গুরুত্বপূর্ণ…একটাকে ছাড়া আরেকটা অসম্পূর্ণ। এই রেল অথরিটি হচ্ছেন নিউরোসার্জেন…ওনারা স্পাইনাল ফিক্সেশন করে দিয়েছেন। কিন্তু ওই অ্যাপ্রোচ রোড বানানোর দায়িত্ব আমাদের। বেড থেকে সমাজের মূল স্রোতে কিভাবে ফেরানো যায়, সেটাই একজন রিহ্যাব ফিজিসিয়ানের লক্ষ্য।”
সুইমিং পুলে এক দুর্ঘটনার শিকার হয় বিবেক। জলে ঝাঁপ দেওয়ার সময় বেকায়দায় ঘাড়ে চোট পায়। তারপর থেকেই হাত পা অবশ হয়ে যায়। তিন চারজন বন্ধু মিলে হাসপাতালে ভর্তি করে। নামকরা প্রাইভেট হাসপাতালে অস্ত্রোপচার হয়, তারপর দক্ষিণ ভারতের এক বিখ্যাত হাসপাতালে বেশ কয়েক মাস ভর্তি রাখা হয়। কিন্তু সেরকম উন্নতি লক্ষ্য করা যায় না। বাড়িতে ফিজিওথেরাপিস্ট নিয়মিত ব্যায়াম করায়, কিন্তু এরমধ্যে আবার কোমরের দুই দিকেই দুটো বড় বেডসোর হয়ে গেছে। জ্বরও প্রায়ই আসছে। মলমূত্র ত্যাগ স্বাভাবিক না। সুপ্রাপিউবিক ক্যাথিটার করা আছে। নিজে থেকে ওঠা বসা খাওয়া কিছুই করতে পারছে না। পরীক্ষা করে দেখা গেল এটা ইনকমপ্লিট স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি এবং নিউরোলজিক্যাল লেভেল সি -৫… অর্থাৎ কনুই ভাঁজ করার ক্ষমতা পুরোপুরি বর্তমান দুইদিকে, কিন্তু একদিকের কব্জি ও কনুই সোজা করতে সমস্যা হচ্ছে। দুই হাতের মুঠো করার ক্ষমতাও অনেকখানি কম। তবে হাতের এই পেশীগুলো এবং নিম্নাংশের পেশীগুলোর কার্যক্ষমতা একেবারে শূন্য নয়। কিন্তু একটা জিনিস খটকা লাগল বর্ণকের…সবকিছুই বিবেকের বাবা মা বললেন। বিবেকের যেন কোনো কিছুতেই উৎসাহ নেই, কথাও খুবই কম বলছে। অথচ সে যথেষ্ট উচ্চশিক্ষিত।
বাবার গলা ভেসে এলো, “প্লীজ ডক্টর কিছু করুন…আমার একমাত্র সন্তান। বুঝতেই পারছেন আমার বয়স হয়েছে…বিবেক নতুন চাকরি পেয়েছিল…কিন্তু এখন তো সবই বন্ধ!”
রাত তখন প্রায় একটা হবে, বর্ণকের চোখে ঘুম নেই। অবশ্য হোস্টেলের নিরিখে এটা এমন কিছু রাত না বরং সন্ধ্যা বললেও কেউ রাগ করবে না। কিন্তু বর্ণকের একটু আগেই ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যেস। কিন্তু আজ চোখ বন্ধ করলেই শুধু বিবেকের মুখটা ভেসে উঠছে। অগত্যা টেবিলে রাখা বিবেকের হিস্ট্রি শীটটা টেনে নিয়ে চোখ বোলাতে থাকে। পরদিন সকালেই স্যারের রাউন্ড আছে। পোস্ট অ্যাড ডে রাউন্ডে পুরো কেস হিস্ট্রি, এক্সামিনেশন থেকে প্ল্যান সব নিখুঁতভাবে প্রেজেন্ট করতে হয় জুনিয়র রেসিডেন্টদের। হাতে কলমে কাজ শেখার জন্য এটা অত্যন্ত জরুরী, এতকিছু শেখা যায় এই রাউন্ডের সময় যে সারা ডাক্তারী জীবনে অবিস্মরণীয় হয়ে থেকে যায় সেগুলো। যেহেতু বর্ণক রোগীকে দেখেছে তাই তারাই গুরু। বর্ণক অবশ্য আগেও বহুবার দক্ষতার সাথে প্রেজেন্ট করেছে কিন্তু শেষবার দু একটা ফাঁক ফোঁকর থেকে গেছিল। ওর গাইড স্যার সবসময় রোগীর আপাদমস্তক খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে দেখেন, তাই কোনো ভুলচুক থাকলে সহজেই ধরা পড়ে যায়। আর এক্ষেত্রে স্যার কোনো অপেশাদার মনোভাব একেবারেই বরদাস্ত করেন না। তাই সামান্য খুঁতও রাখতে চায় না বর্ণক। হঠাৎ খেয়াল হল রোগীর ‘রিক্রিয়েশন হিস্ট্রি’ তো নেওয়া হয় নি! কি করা যায়? অন্যমনস্ক হয়েই মোবাইলে ফেসবুক খুলে ফেলে সে…অনেকের মতই এটাও তার মনোরঞ্জনের সঙ্গী।
সেদিন সকালে বর্ণক গিয়ে জিজ্ঞেস করলো বিবেকের মাকে, “সব রেডি তো?”
–“হ্যাঁ ডক্টর! আপনার কথা মত ভায়োলিনটাও আনা হয়েছে।”
হঠাৎ বিবেকের গলা শোনা গেল,”ভায়োলিন! কেন?”
প্রশ্নটা মায়ের উদ্দেশ্যে ছিল। উনিই উত্তর দিলেন, “দেখ বাবা, আমি কিন্তু ডক্টরকে কিচ্ছু বলিনি। উনিই নিজে থেকে আনতে বলেছেন..”
বর্ণক বলে উঠলো, “ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে… এই সুরটা তো দারুণ বাজাও তুমি। তোমার পরিচিত কারও খুব পছন্দের…”
–“মা! তুমি নিশ্চয় বলেছো…নাহলে ডক্টর জানবেন কোথা থেকে?”
–“বিশ্বাস কর আমি কিছু বলিনি। তোর বাবাও এই কদিন আসতে পারেনি…”
–“ডক্টর, আপনি কি ভবানীপুরে থাকেন? আমার বন্ধু সৌরভের কাছে শুনেছেন?”
–“আরে না না…আমার বাড়ি কলকাতার বাইরে। এখানে হোস্টেলে থাকি। তোমার কোনো বন্ধুকেও চিনি না।”
“আসলে কি জানেন ডক্টর..”,ওর মা বলে উঠলেন,”ও প্রায়ই আমাকে বলতো যারা ভায়োলিন বাজায় তাদের জীবন খুব কষ্টের হয়!”
রুমাল দিয়ে চোখ মুছলেন ভদ্রমহিলা।
প্রসঙ্গ ঘোরানোর জন্য বর্ণক বলল,”তুমি তো ভালো অভিনয়ও করো…থিয়েটারও করেছো।”
বিবেক এবার সত্যি সত্যিই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল।
বর্ণক বলে চলে, “সেই সুযোগ আমাদের নেই। তবে তোমাকে আজ মিউজিক থেরাপিতে নিয়ে যাওয়া হবে, তুমি চাইলে সেখানে বাজাতে পারো…”
–“কিন্তু ডক্টর আপনি আমার সম্পর্কে এতকিছু জানলেন কি করে?”
–“ও নিয়ে ভেবো না! ডাক্তারদের সবকিছুই জানতে হয়।”
প্রথম দিন মিউজিক থেরাপিতে হাতের আঙ্গুলগুলোর জোর কম থাকায় ভায়োলিন ধরতেই পারলো না ঠিক ভাবে। বসাটাও ঠিক ভাবে হচ্ছিল না। কিন্তু কি আশ্চর্য! সাতদিনের মধ্যেই সে অনেক উন্নতি করে ফেলল। বিবেককেও বেশ চনমনে লাগছে এখন। কাপড় দিয়ে বো-স্টিকের গ্রিপটা মোটা করে দেওয়ায় ডান হাতে ধরতে পারছে। কিন্তু বামহাতে সমস্যাটা থাকছেই। কিছু টেকনিক শেখানো হল, যাতে ‘টেনোডেসিস ইফেক্ট’ এর জন্য ধরতে সুবিধা হয়।
প্রায় একমাস পর দেখা গেল বিবেক সত্যিই খুব ভাল বাজাচ্ছে… ভায়োলিন ব্রাদার্সদের যোগ্য শিষ্য হয়ে উঠেছে সে। এত বড় একটা ট্যালেন্ট দুর্ঘটনার পর শেষ হয়ে যেতে বসেছিল! মিউজিক থেরাপির পর সেদিন তখনও অ্যাটেনডেন্ট এসে পৌঁছয়নি। তাই পুরুষ ওয়ার্ডের পাশেই হুইল চেয়ারে বসে ছিল সে। হঠাৎ দেখল একটা ছেলে দুটো ক্র্যাচে ভর করে হেঁটে যাচ্ছে। তার একটা পা হাঁটুর নিচে থেকে বাদ গেছে। বয়স হয়ত দু এক বছর কমই হবে বিবেকের থেকে।
বিবেক জিজ্ঞেস করলো, “কি করে হল?”
ছেলেটি বলল, “ট্রেনে হকারি করতাম। চলন্ত ট্রেনে চাপতে গিয়ে হাত পিছলে যায়। পড়ে গিয়ে চাকার তলায় পা কাটা পড়ল।”
–“তোমার পা নেই তাও তো তুমি হাঁটছো। আর আমার পা থেকেও…”
–“ভাই আমার পরিবারের আমিই একমাত্র রোজগেরে। বাড়িতে মা আর বৃদ্ধ ঠাকুমা আছে। বাবার মৃত্যুর আগে চিকিৎসা করতে গিয়ে সব গেছে! আমাকে তো নিজের পায়ে দাঁড়াতেই হবে। কাঠের পা লাগিয়েই আবার রোজগারে বেরোব।”
ছেলেটির কথা শুনে বিবেক ভাবতে লাগল, সে কেন ছেলেটির মত হতে পারবে না… পারতেই হবে তাকে!
বর্ণক সকালে এসেই প্রথমে বিবেককে দেখতে গেল। প্রায় এক বছর ভর্তি থাকার পর তার আজ ছুটি হচ্ছে। এর মধ্যে তার প্রচুর উন্নতি হয়েছে। একাধিক ইন্টারভেনশনও করা হয়েছে। দুটো বেডসোরের মধ্যে একটাকে অপারেশন করে ঠিক করতে হয়েছে। অন্যটা বেশ কয়েকবার পি.আর.পি দেওয়ার পর আকারে একেবারে ছোট হয়ে গেছে এখন। ড্রেসিং করেই যেটা পুরোপুরি ঠিক হয়ে যাবে আশা করা হচ্ছে। স্পাস্টিসিটি ও স্পাজম থাকায় বটিউলিনাম টক্সিন ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে পায়ের পেশীগুলোতে। সুপ্রাপিউবিক ক্যাথিটার সরিয়ে শুরু করা হয়েছে ক্লিন ইন্টারমিটেন্ট ক্যাথিটেরাইজেশন বা সি.আই.সি.। অর্থাৎ বিবেক নিজেই নির্দিষ্ট সময় পর পর মূত্রনালী দিয়ে ক্যাথিটার ঢুকিয়ে মূত্রস্থলী খালি করতে পারবে।
কিন্তু দেখা গেল দিনে ছয়বার সি.আই.সি করেও মধ্যবর্তী সময়ে মূত্র বেড়িয়ে সব ভিজিয়ে দিচ্ছে, যেটা বেডসোরের জন্যও খারাপ। ওষুধের ডোজ সর্বোচ্চ করার পরও সমস্যা থাকছেই। মূত্র পরীক্ষায় কোনো সংক্রমণও ধরা পড়লো না। ইউরোডাইনামিক স্টাডি করে দেখা গেল মূত্রস্থলীর ডেট্রুসর মাংসপেশী অতিসক্রিয়। তাই মূত্রস্থলীর ভিতরের ওই পেশীতে বটিউলিনাম টক্সিন ইনজেকশন দেওয়া হল। এর মধ্যে অর্থোসিস ও ক্র্যাচে ভর করে নিজে নিজেই সে হাঁটতে পারছে। লেখা থেকে টাইপ…হাতের প্রায় সব কাজই নিজে থেকে করতে পারছে।
বর্ণককে দেখেই বিবেক বলে উঠলো, “গুড মর্নিং ডক্টর।”
–“তাহলে আজ বাড়ি যাচ্ছ?”
–“হ্যাঁ। কিন্তু একটা জিনিস এখনও জানতে পারলাম না।”
–“কি জিনিস?”
–“আপনি আমার সম্পর্কে এতকিছু জানলেন কিভাবে?”
–“না, আর সাসপেন্স রাখবো না। হঠাৎ ফেসবুক ঘাঁটতে গিয়ে তোমার প্রোফাইল খুঁজে পেলাম। আর সেখান থেকেই সব…”
হেসে উঠলো বিবেক, বললো,”সত্যি ডক্টর…আমি এগুলো ছেড়েই দেব ঠিক করেছিলাম। কিন্তু আপনি বলার পর…”
–“তুমি এত মাল্টি ট্যালেন্টেড…এসব বন্ধ করে দিলে আমরা অনেককিছু থেকে বঞ্চিত থেকে যেতাম।”
–“আসলে এগুলো আমার ভালো লাগে…এগুলো নিয়েই বাঁচি… এগুলো হারিয়ে গেলে আমি বেঁচে থেকেও মরে যাব। তাই যতটা পারি এগুলোকে এনজয় করি। যতই হোক…জীবন তো একটাই!”
একটু থেমে বিবেক আবার বলল, “কিন্তু একটা জিনিস মিস করে গেছেন। আমি শুধু অভিনয় না… গল্প, স্ক্রিপ্ট লিখি এবং পরিচালনাও করি।”
–“তুমি এত কিছু পারো?”
–“হ্যাঁ। এই তো দেখুন এরমধ্যেই একটা সিরিয়ালের জন্য গল্প লিখে ফেলেছি। স্ক্রিপ্টও রেডি, এটার শুটিংও শুরু হয়ে গেছে।”
কৌতূহলবশত স্ক্রিপ্টটা নিয়ে পড়তে পড়তে বর্ণক বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। এ কি পড়ছে?
চরিত্র, স্থান, কাল সব তো খুব চেনা। এক সদ্য এম.বি.বি.এস. পাস করা ডাক্তারের প্রেমিকার হঠাত জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয় তার বাবা। বিয়ের পর এক মারাত্মক দুর্ঘটনায় শিরদাঁড়ায় চোট লেগে নিম্নাংশ অসাড় হয়ে যায়। শেষে সেই ডাক্তারই তার শুশ্রূষার সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয়। এটা তো বর্ণকের নিজের জীবনকাহিনী! কিন্তু বিবেক জানলো কিভাবে?
——————————————
আসুন এবার স্পাইনাল কর্ড ইনজুরির রিহ্যাব নিয়ে দু চার কথা আলোচনা করা যাক। শিরদাঁড়ায় চোট লাগার পর রোগীকে স্ট্রেচারে শুয়ে ও যতটা সম্ভব কম নাড়াচাড়া করে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত। স্পাইনাল ফিক্সেশন সার্জারীর পর, রোগীকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক জীবনে ফেরানোর দায়িত্ব বর্তায় রিহ্যাব টিমের ওপর।
এই রোগীদের বেডসোর, স্পাস্টিসিটি, ইমমোবিলাইজেশন সিন্ড্রোম থেকে শুরু করে ডিপ ভেইন থ্রোমবোসিস, পালমোনারি এম্বোলিজম, অটোনোমিক ডিসরিফ্লেক্সিয়ার মত গুরুতর জরুরী অবস্থার সম্মুখীন হতে হয় রিহ্যাব ফিজিশিয়ানদের।
এই রোগীরা প্রথম দিকে অবসাদগ্রস্ত থাকে, তাই সেটার চিকিৎসা প্রথমেই করতে হয়। বিবেকের ক্ষেত্রে মিউজিক থেরাপি একদিকে যেমন মানসিক অবসাদ কাটিয়ে তুলতে সাহায্য করেছিল, অন্যদিকে সাধারণ হাতের ব্যায়াম বা হ্যান্ড ফাংশন ট্রেনিং এর একঘেয়েমী কাটিয়ে বৈচিত্র্য নিয়ে এসেছিল। আর. পি.আর.পি. -র তো অনেক গুণ…বেডসোর, পেশী ও লিগামেন্ট ছিড়ে যাওয়া, অস্টিওআর্থ্রাইটিসের চিকিৎসা থেকে শুরু করে টাকে চুল গজানো.. সবেতেই এর গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
এবার আসা যাক নিউরোজেনিক ব্লাডারে। কি ভাবছেন… ইউরোলোজির জিনিস নিয়ে আবার কেন টানাটানি করছি? আসলে রিহ্যাব জিনিসটাই হচ্ছে ‘সর্বঘটের কাঁঠালী কলা’র মত…ঝালে ঝোলে অম্বলে সবেতেই আছে। আর এই ইউরো রিহ্যাব হচ্ছে রিহ্যাবের মূল বিষয়গুলোর অন্যতম। মস্তিষ্ক থেকে শিরদাঁড়া…এক একটা জায়গার চোটের জন্য এক একরকম আচরণ করে মূত্রস্থলী। মূত্রস্থলীর ভিতরের ডেট্রুসর মাংসপেশির সংকোচন ও স্ফিংটার শিথিল হওয়ার জন্য স্বাভাবিক মূত্রত্যাগ সম্ভব হয়। মূত্র জমা হওয়ার সময় ঠিক উল্টোটাই হয়। এক্ষেত্রে সিম্পাথেটিক নার্ভ যেখানে মূত্র ধরে রাখতে কাজ করে, প্যারাসিম্পাথেটিক নার্ভ সেখানে মূত্রত্যাগে সাহায্য করে। সাধারণত বারোতম থোরাসিক ভার্টিব্রার ওপরে সুষুম্না কাণ্ডের চোটের ক্ষেত্রে (সুপ্রাস্যাক্রাল লেভেল) ডেট্রুসরের অতিরিক্ত সংকোচনের জন্য যেমন মূত্র ধরে রাখতে সমস্যা হতে পারে, সেরকম ডেট্রুসর ও স্ফিংটারের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে ডিসসাইনার্জিও হতে পারে। অর্থাৎ ডেট্রুসরের সংকোচনের সময় স্ফিংটার শিথিল না হওয়ার জন্য মূত্রত্যাগে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। ঠিক উল্টোটাই হবে ওর নিচের অংশের সুষুম্না কান্ডের চোটের ক্ষেত্রে, অর্থাৎ ডেট্রুসরের সংকোচনের অক্ষমতা…যার জন্য মূত্রত্যাগ অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।
রিহ্যাবের প্রধান লক্ষ্যই হল সোশ্যালি কন্টিনেন্ট ব্লাডার, অর্থাৎ যখন তখন মূত্র নির্গত হয়ে প্যান্ট ভিজিয়ে দেবে না, বা স্বাভাবিক কাজকর্ম ও ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাবে না। আবার কিডনির কোনো ক্ষতিও হবে না এবং সংক্রমণের রিস্কও থাকবে না। ইউরোডাইনামিক স্টাডি করে সঠিক সমস্যা নির্ণয়ের পর রিহ্যাব ফিজিশিয়ানরা খাবার ওষুধ থেকে শুরু করে বিভিন্ন থেরাপি, ইন্টারভেনশন বা সার্জারীর পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে সি.আই.সি. -র ভূমিকা অপরিসীম।
নির্দিষ্ট সময়ে রোগী নিজেই বা অ্যাটেনডান্ট মূত্রনালী দিয়ে ক্যাথিটার ঢুকিয়ে মূত্রস্থলী থেকে মূত্র বের করে দিতে পারে। এতে একদিকে যেমন ক্যাথিটার ছাড়া স্বাভাবিক জীবনযাপন করা যায়, আবার অন্যদিকে দীর্ঘদিন ইনডিয়ালিং ক্যাথিটার থাকার জন্য যে সংক্রমণের রিস্ক থাকে, সেটাও এক্ষেত্রে থাকে না বললেই চলে। পুরোপুরি স্টেরিলিটির প্রয়োজন হয় না এখানে, সাবান জলে হাত ও ক্যাথিটার ভালোভাবে ধুয়ে নিলেই হয়। তাই খরচও রোগীর সাধ্যের মধ্যেই। কিন্তু আমাদের দেশ তথা রাজ্যে খুব কম রোগীকেই সি.আই.সি. করতে দেখা যায়।
এখানে এসব রোগীদের বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই দেখা যায়… মৃত্যু সংবাদ ঘোষণার অনেক আগেই বেঁচে থাকার ইচ্ছেগুলো মৃত্যুবরণ করে। পরিকাঠামো, লোকবলের অভাব সত্ত্বেও এরজন্য সচেতনতার অভাবই সবচেয়ে বেশি দায়ী বলে মনে হয়।
দারুন লেখা।
পড়তে অসাধারণ লাগলো।
Excellent. I had no knowledge about this subject or treatment. Though we are, associated with NGO and working in the field of health, we never come across such treatment in West Bengal. It is really very much encouraging feature and treatment. I take a note of it. Thanks and regards.