“আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা হয় যদি!
আবার বছর কুড়ি পরে—
হয়তো ধানের ছড়ার পাশে
কার্তিকের মাসে—
তখন সন্ধ্যার কাক ঘরে ফেরে— তখন হলুদ নদী…” – জীবনানন্দ দাশ
…..রাম্ভীবাজারে ফিরে এসে আর মন টিঁকছিল না। শুচিশ্মিতা সন্তান-সম্ভবা। কলকাতা ফিরে গেছে। খুব চিন্তা হচ্ছে। এখান থেকে খবর কিচ্ছু পাচ্ছি না। হাসপাতালের ফোনটা আবার খারাপ হয়ে গেছে। রাম্ভী দার্জিলিং থেকে বেশ কিছুটা নীচে। হাল্কা গরম। দখিনা হাওয়া। শীত কাটিয়ে জঙ্গল আস্তে আস্তে ডানা মেলছে।কচি কচি পাতা আসছে গাছে।
আউটডোরে রোগীর সংখ্যা আবার বাড়ছে। ইনডোরেও। অর্ধেকের বেশী বেড ভর্তি থাকে এখন। দৈনন্দিন কাজকর্মে জড়িয়ে থাকলে জীবনের বড়বড় দুঃখকষ্ট, দুশ্চিন্তা ভুলে থাকা যায়। রাম্ভীতে ইদানিং নতুন কিছু মানুষের আনাগোনা শুরু হয়েছে। সরকারী গাড়ি, অফিসার, ইঞ্জিনিয়ার। এখানে নাকি তিস্তা প্রকল্পের বাঁধ তৈরী হবে। কুমারী তিস্তা ও তার জঙ্গলের যে কি হাল হবে ভবিষ্যতে- তা ভেবেই আতঙ্ক হয়।
শিলিগুড়িতে তখন আর বিশেষ আসি না। প্রধান নগরের ভাড়াবাড়ি তালাবন্ধই পড়ে থাকে। অনেকদিন পরে একদিন শিলিগুড়ি ফিরে দেখি ঘরে চুরি হয়ে গেছে। বেশ কিছু জিনিসের সাথে খোয়া গেছে আমার সাধের টেপরেকর্ডার আর বিয়ের আংটিটা। প্রধাননগর পুলিশ ফাঁড়িতে গেলাম অভিযোগ করতে। পাত্তাই দিল না।
‘ডাক্তার মানুষ, এইটুকু সামান্য চুরির জন্য অভিযোগ করতে এসেছেন?’
ঠিক বুঝলাম না। ডাক্তার হওয়া-টা অপরাধ? ডাক্তারের বাড়িতে চুরি হওয়াটা ডাক্তারের নিজের অপরাধ? নাকি, ডাক্তার মানেই সে এত বড়লোক যে এইসব ছোটখাটো চুরি যাওয়া নিয়ে পুলিশকে বিব্রত করা তার শোভা পায় না? কোনটা?
বুঝতে না পেরে বাধ্য হয়ে ঘরে ফিরে এসে অশোকবাবুকে সঙ্গে নিয়ে যেতে হল। অশোকবাবু জলপাইগুড়ি জেলার আইবি তে কাজ করতেন। তাঁর পরিচয় পেয়ে প্রধাননগরের সাব-ইন্সপেক্টর লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে স্যালুট মেরেটেরে একশা’। পারলে নিজের দুকান ধরে আর কি! কেস লেখা হল। তবে জিনিস ফেরত পাওয়া গেল না।
ততদিনে পোষ্টিং অর্ডার বেরিয়ে গেছে। আরজিকর মেডিক্যাল কলেজে আরএমও এবং ক্লিনিক্যাল টিউটর। রাধাগোবিন্দ করের নামাঙ্কিত কলেজ। বাড়ি থেকে কাছে। মধ্যবিত্ত পরিবেশ। এমবিবিএসে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছে ছিল। রেজাল্ট অনুযায়ী পেয়েও যেতাম। কিন্তু সবকিছু তো সবসময় নিজের ইচ্ছামতো হয় না। তাই কলেজ জীবন শুরু হয়েছিল এলিট কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে। এতদিন বাদে আরজিকরে পড়ানোর সুযোগ পেলাম। তার থেকেও অনেক বড় কথা- আমায় যেতে হবে না সামতাহারের অজ্ঞাতবাসে।
রাম্ভী থেকে দ্রুত শিলিগুড়ি ফিরে জিনিসপত্র বাঁধাছাদা করতে হল। ভীষণ বিরক্তিকর কাজ। কিন্তু ঘরে ফেরার স্বস্তিতে সে কষ্ট মালুম হল না। স্বস্তিই শুধু, আনন্দ নয়। আবার এনজেপি। আবার দার্জিলিং মেলের লাগেজ কম্পার্টমেন্ট। জিনিসপত্র নিয়ে ফিরলাম বারাসাতের বাড়িতে। বাড়ি অর্ধশূন্য, প্রাণহীন। বাগানে আগাছা গজিয়েছে। ফুলের গাছগুলো মরে গেছে অযত্নে। পুকুরে কচুরিপানা। ভাইয়ের হাতে লাগানো সফেদা গাছটায় একলা একটা শালিখ চুপ করে বসে থাকে।
রাইটার্স থেকে পোষ্টিং অর্ডার হাতে নিয়ে দেখা করতে গেলাম আর জি করের অর্থোপেডিক্স বিভাগে। অধ্যাপক সমীরগোপাল সেনরায় বিভাগীয় প্রধান। খুব খুশী হলেন। স্নাতকোত্তরে আমার পরীক্ষক ছিলেন তিনি। অত ভালো অথচ প্রচারবিমুখ অর্থোপেডিক সার্জেন কম দেখেছি। আমাকে তখুনি নিজের ইউনিটে নিয়ে নিলেন স্যার। কিন্তু আমি তো নতুন চাকরী পাই নি। আগে থেকেই হেল্থ সার্ভিসে আছি। আমাকে সেখান থেকে রিলিজ নিয়ে তবে এমইএসে যোগ দিতে হবে। এই রিলিজের প্রক্রিয়াটা যথেষ্ট জটিল।
রিলিজ আনতে ছুটলাম রাম্ভী। বিএমওএইচ লিখে দিল সহজেই। কিন্তু আসল খেলা তো দার্জিলিংয়ে। বিএমওএইচ বলল, ‘খুব কঠিন হবে তোমাদের রিলিজ পাওয়া। পাহাড় থেকে চারজন পেয়েছে। হিল কাউন্সিল কিছুতেই একসাথে চারজনকে ছাড়বে না।
দার্জিলিংয়ে গিয়ে দেখা ডাক্তার কমলেশ মজুমদারের সাথে। কালিম্পং-এর রেডিওলজিষ্ট কমলেশদা আছে ওই চারজনের লিষ্টে এবং পোষ্টিং হয়েছে আরজিকরে। কমলেশদা আমার থেকে অনেক সিনিয়ার মেডিক্যাল কলেজে। কিন্তু এত অমায়িক এবং মাটির মানুষ যে, সেই দূরত্বটা থাকে না। গৌতমদা বলল, ‘ডিজিএইচসি তোদের ছাড়বে বলে মনে হয় না। তবু চেষ্টা কর।’
গৌতমদা-র অনেক যোগাযোগ ছিল। সুভাষ ঘিসিং বাদে প্রায় বাকী সব খুঁটি নাড়িয়ে দেখা হল। কিছুতেই কিছু হল না। সিএমওএইচ কিছু সাহায্য করতে পারলেন না। জয়েনিং-এর ডেডলাইন ক্রমশঃ এগিয়ে আসছে। আমরা হতাশ হয়ে পড়ছি। রোজ এ অফিস সে অফিস ঘুরে বেড়াই। কাজের কাজ কিছু হয় না। কমলেশদা আমাকে নিয়ে মহাকাল মন্দিরে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকে। আমার যদিও এসবে বিশ্বাস নেই। মন্দিরের সিঁড়িতে বসে চা-চানাচুর খাই। আর দুদিন মাত্র বাকি আছে।
কমলেশদা বলল,’শেষ চেষ্টা করা যাক। একবার প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারীর কাছে চলো।’
‘চলো। যা হওয়ার হবে।’
অনেকক্ষণ বসে থাকার পরে ঘরে ঢুকতে পেলাম। প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারী ভদ্রলোক দক্ষিণ ভারতীয়। নাম প্রশান্ত্। ব্যাপারটা শুনেই বললেন, ‘হিল কাউন্সিল কেন ছাড়ছে না? এটা তো ক্যান্ডিডেটদের ক্যারিয়ারের ব্যাপার। বসুন দেখছি।’
ওখান থেকেই উনি ফোন করলেন সিএমওএইচ এবং সি কে প্রধানকে। সি কে অর্থাত চন্দ্র কুমার প্রধান তখন হিল কাউন্সিলের হেল্থ কাউন্সিলর। আধ ঘন্টার মধ্যে রিলিজ অর্ডার তৈরী হয়ে গেল।
দ্রুত গাড়ি জোগাড় করে আমরা দার্জিলিং ছাড়লাম। আবার সেই পেশক হয়ে তিস্তাবাজার। এবারে স্বস্তি,আনন্দ,বিষাদে মেশানো সম্পূর্ণ অন্যরকম এক অনুভূতি। অনেক লড়াইয়ের পরে শেষ পর্যন্ত কলকাতা ফিরতে পারছি। কিন্তু তিস্তানদী, ঝর্ণা, জঙ্গল, পাহাড় ঘেরা এই রাম্ভীবাজার রয়ে গেল স্মৃতির ক্যানভাসে।
বাস এল। কমলেশদা চলে গেল কালিম্পং। সাবডিভিশন হাসপাতাল থেকে ফাইনাল রিলিজ আর এলপিসি নিতে।
‘আর জি করে দেখা হবে।’
‘নিশ্চয়ই।’
দেখা তো হয়েছিলই। একসাথে কাজ করেছিলাম আট বছর। মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ পর্যন্ত। সে অন্য কাহিনী।
রাম্ভী পৌঁছে অফিস থেকে কাগজপত্র নিলাম। আউটডোরটা নির্জন, ধূ ধূ করছে। চাবি বুঝিয়ে দিলাম কোয়ার্টারের। অরুণের দাদার হোটেলে শেষ বারের মত লাঞ্চ। দেখা হল জয়ন্তদার সাথে।
‘ভালো থাকবেন। দরকার হলে যাব কিন্তু আর জি করে। চিনতে পারবেন তো?’
‘কি যে বলেন!’
পাহাড়ের খাঁজ বেয়ে, ব্রীজের তলা দিয়ে রাম্ভীঝোরা বয়ে চলেছে আগের মতই। আরো কত হাজার বছর ধরে বয়ে যাবে কে জানে! আমার মত কত অর্বাচীন আসবে, আবার চলে যাবে অতিথির মত।
শিলিগুড়ি পৌঁছে অশোকবাবুর বাড়ি থেকে বিদায় নিলাম। টাকা মিটিয়ে দিয়ে বাড়ি ছেড়ে দিলাম পাপিয়া-দি আর মুকুলদা কে। ওদেরও মন খারাপ। আমারও।
‘ভালো থেকো। শিলিগুড়ি বেড়াতে এসো আবার।’
‘ডুয়ার্সে যাব এবার তোমরা এলে।’ অশোকবাবু আর দোয়েল-কোয়েল আব্দার করল।
বাসষ্ট্যান্ডে প্রবল ভীড়। বহুকষ্টে কলকাতাগামী অর্ডিনারী প্রাইভেট বাসে একটা টিকিট পেলাম। মে মাস। প্রবল গরম। বাস ছাড়ল দেরিতে। ডালখোলার কাছে অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে রাস্তা বন্ধ। বড় রাস্তা ছেড়ে ছোট রাস্তা ধরে বিহারের ভেতর দিয়ে চলল বাস। চাঁদনী রাত। গা ছমছম। অচেনা রাস্তায় ডাকাতের ভয়। সেই ভয়ে খারাপ রাস্তার তুমুল ঝাঁকুনির কথা তখন ভুলে গেছে সবাই। কিন্তু আশঙ্কাজনক কিছুই ঘটল না। মালদা, বহরমপুর পেরোলাম। উত্তেজনায় ঘুম আসছে না। শেষ অবধি ভোরের আলো ফুটল। কৃষ্ণনগর। মাটির পুতুল, সরভাজা। এক কাপ চা খেয়ে আবার উঠে বসলাম বাসে।
বারাসাতে নেমে রিক্সা ধরে পৌঁছে গেলাম বাড়ী। অভ্যাসবশতঃ খবরের কাগজ খুলতেই মর্মান্তিক খবরটা পড়ে মাথাটা ঘুরে গেল। দীঘার সমুদ্রে দার্জিলিংয়ের হোমিওপ্যাথি ডাক্তার সুদীপ ঘোষের মৃত্যু। সুদীপদা দুদিন আগেই কলকাতায় এসেছিল। আমাদের বাড়িতেও আসার কথা ছিল। রাম্ভীতে ফোন করতেই বিএমওএইচ জানাল যে খবরটা সত্যি। সপরিবারে দীঘা বেড়াতে গিয়ে সুদীপদা ও তার থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত বোন সমুদ্রতটে ছবি তুলছিল। হঠাৎ ছুটে আসা ঢেউয়ের ধাক্কায় দুজনেই সমুদ্রে তলিয়ে যায়।
রাম্ভী বিপিএইচসি-তে মৃত্যু তার দ্বিতীয় থাবা বসাল। কোত্থাও যেতে ইচ্ছে করছিল না। তবু যেতে হবে। ভারাক্রান্ত মনে ডেডলাইনের শেষ দিনের বিকেলে গিয়ে আর জি করে জয়েন করলাম। শুরু হল জীবনের অন্য অধ্যায়।
(শেষ)
শেষকথা
————
মহামারী কালে হাতে কাজকর্ম কম আর হতাশা বেশী। তাই হতাশা কাটাতে ফাঁকা সময়ে এসব ভুলে যাওয়া দিনের কথা লিখে ফেলেছি। যা কিছু লিখেছি, তা একান্ত আমার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা। অন্যের দৃষ্টিকোণ থেকে তা অন্যরকম হতেই পারে। অনেক মানুষের কথা এখানে এসেছে, আবার অনেকের কথা আসা হয়ত উচিত ছিল, কিন্তু আসেনি। তাদের কারও যদি মনে দুঃখ, রাগ, অভিমান বা সবক’টা অনুভুতি একসাথে হয়ে থাকে, আমাকে নিজগুণে মার্জনা করবেন। ধরে নেবেন যে সময়ের ছাইচাপা এই অধ্যায়টা কোনোদিন ঘটেই নি। আমিও একান্তে ভাবি, যদি কোনো মেহের আলী মধ্যরাতে নিস্তব্ধতা খান্ খান্ করে চিৎকার করে বলত-
“সব ঝুট হ্যায়”
“সব ঝুট হ্যায়”
“সব ঝুট হ্যায়”