পর্ব-৩-এর পর…..
………আমাকে না বলতে চাইলেও বেড়াল ঝুলির ভেতরে চুপচাপ লুকিয়ে থাকবেই এমন আশা করাটা বাড়াবাড়ি। বেড়াল নড়ে উঠল। মানে, পুলিশ আমাকে দেখা করতে বলল।
অষ্টম আশ্চর্য! আমি নিজে তো বটেই, ডিপোর্টমেন্টের সিনিয়ররাও বেশ ঘাবড়ে গেল। কেউ কখনও এমনটা ঘটতে দেখে নি। কত শত রোগী দুর্ঘটনায় হাড় ভাঙা নিয়ে ভর্তি হয়। এমন সিরিয়াস পুলিশি তদন্ত তো হয় না!
বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য ও পরামর্শ নানা দিক থেকে এসে আমাকে একেবারে বিভ্রান্ত করে দিল।
‘যা, কিন্তু একদম কথা বলবি না। শুধু শুনবি।’
‘তোর হয়ে গেল! এবারে কোর্টে দৌড়তে দৌড়তে জীবন কয়লা হয়ে যাবে।’
‘পুলিশ কিন্তু খুব হ্যারাস করে।’
ভাবলাম, কী কুক্ষণেই না সেই রাতে কেস-টা আমার ঘাড়ে পড়েছিল !
ইনভেস্টিগেটিং অফিসারের সাথে দেখা হল। খুবই ভদ্র ও অমায়িক ব্যবহার। আমার কাজ ও পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটানোর জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন। কথা হল এম সি এইচ বিল্ডিং এর নীচে পুলিশ ফাঁড়ি-তে বসে।
‘আমি জানি আপনি সেদিন অনেক রাতে রোগীকে প্রথমে দেখেছিলেন। ইনজুরি রিপোর্টও লিখেছেন।’
‘ইনজুরি রিপোর্ট আমি লিখিনি, ওটা এমার্জেন্সিতে লেখা হয়েছে।’
‘যাই হোক। ওঁর কী কী চোট হয়েছে?’
‘ফিমার ফ্র্যাকচার।’
‘আর কিছু নেই?’
‘মাথায় সামান্য চোট ছিল।’
‘আপনাদের কি মনে হয় না যে দোতলার জানলা থেকে নীচে পড়লে এর থেকে বেশি চোট হওয়ার কথা?’
‘হ্যাঁ, মাথায় একটু তো চোট ছিল। আর তাছাড়া উনি বলেছিলেন যে, নিচে একটা আবর্জনার স্তূপ ছিল। উনি তার উপর পড়ার ফলে তত চোট লাগে নি।’
‘রোগী কী মদ খেয়ে ছিলেন?’
‘হ্যাঁ, ইনজুরি রিপোর্টে তাই লেখা আছে।’
‘আপনি তো প্রথমে ওনাকে ওয়ার্ডে দেখেন। মদের গন্ধ পেয়েছিলেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘জঞ্জালের গন্ধ পাননি তো?’
‘না না।’
‘কিন্তু জঞ্জালের উপর পড়ে কেউ পা ভাঙলে তার গা থেকে জঞ্জালের গন্ধ পাওয়া কথা। পা ভেঙে কেউ তো আর স্নান করে হাসপাতালে আসে না! তাই না?’
ভাবলাম, তাও তো ঠিক। জঞ্জালের গন্ধ তো পাই নি!
পুলিশ অফিসার বললেন, ‘আমরা তদন্ত করে দেখেছি, ওনার জানলার নিচে কোনো জঞ্জালের ভ্যাট নেই, শুধুই ফুটপাথ।’
‘অ্যাঁ?’
‘আরো আছে। চিরঞ্জিৎ বাবুর ভাই ওনার বিরুদ্ধে ওদের পারিবারিক হীরের পেন্ড্যান্ট চুরির মামলা করেছেন।’
আমার হাঁ মুখ হাঁ হয়েই রইল। পুলিশ অফিসার চলে গেলেন।
হাসপাতালের কাজকর্ম কখনোই পুরোপুরি বন্ধ থাকেনা- সে দুর্গাপুজো, স্বাধীনতা দিবস, ঈদ, সরস্বতী পুজো- যাই হোক। সরস্বতী পুজোর দুপুরে কাজ শেষ করে ফিরছি। খাওয়া হয়ে গেছে, তাড়া নেই। একটা টেলিফোন করার দরকার বলে এসটিডি বুথের দিকে যাচ্ছি। এমন সময় দেখি শাড়ি পরে খোঁপায় ফুল গুঁজে সেজেগুজে দুটো মেয়ে যাচ্ছে। আমাকে দেখে হাত নাড়ল। সরস্বতী পুজোর দিন তরুণী মেয়েদের এমন সাজ স্বাভাবিক। তবু কাছাকাছি আসতেই আমার মাথায় দুষ্টুবুদ্ধি চাগাড় দিল।
‘কাকে খুঁজতে যাচ্ছেন? অর্ঘ্যকে?’
‘হ্যাঁ’ সঞ্চিতা বলল।
‘হোস্টেলে গেছিলাম। নেই।’
দুই বোনের এই আপাত সারল্য আমাকে চমৎকৃত করে।
‘পাবেন না। অর্ঘ্য গত পরশু বিলেতে চলে গেছে।’
‘মানে? কবে ফিরবে?’
আমি ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানিনা, এমন মুখ করে বললাম,
‘তা জানিনা। তবে মে মাসে তো ফিরতে হবেই। ফাইনাল পরীক্ষা।’
মুখ কালো করে কবিতা জিজ্ঞেস করল, ‘অর্ঘ্যদার কোর্স শেষ হয়ে গেছে?’
‘হ্যাঁ, আপনাকে বলে নি?’
‘না।’ বলেই দুজন হনহন করে কলেজ গেট এর দিকে হাঁটা দিল।
গাইনি-র পিজিটি বর্ণালী-দি জিজ্ঞেস করল ‘কারা রে এরা?’
‘পেসেন্টের বাড়ির লোক।’ শুনেই ঠোঁট উল্টালো।
এই পর্যন্ত ঠিকই ছিল। গোল বাঁধলো কিছুক্ষণ পরে। ফোন করে টেলিফোন বুথ থেকে বেরিয়েই যেন ভূত দেখলাম!
কবিতার পাশে পাশে হেঁটে টেলিফোন বুথের দিকে আসছে- অর্ঘ্য!
এই দেখে আমি কোথায় লুকোবো খুঁজছি। উপায় না দেখে আবার টেলিফোন বুথেই ঢুকে পড়লাম। কিন্তু এভাবে কী পালানো যায় ! ধরা পড়ে গিয়ে কবিতার মুখে ‘ফাজিল’ ইত্যাদি নানা বিশেষণ শুনতে হল।
এরপর একদিন হোস্টেলের বন্ধুরা মিলে হাতিবাগানের মিনার সিনেমা হলে ফিল্ম দেখে চাচার হোটেলে খেতে ঢুকেছি। দেখি কোনার একটা টেবিলে বসে আছে- অর্ঘ্য। আমাদের দেখেও দেখতে পেল না। কারণ সঙ্গে বসে ছিল কবিতা। এরপর স্বাভাবিক ভাবেই সারা কলেজে রটে গেল যে অর্থো-র পিজিটি-রা সব দলে দলে পেসেন্ট-এর বাড়ির লোকের সাথে প্রেম করছে। এই অপবাদের জন্য একমাত্র অর্ঘ্যই দায়ী ছিল।
স্বপনদা ছিল অর্থোপেডিক ডিপার্টমেন্টের মুশকিল আসান। অবশ্য জিডিএ থেকে প্লাস্টার টেকনিসিয়ান পদে উন্নীত স্বপনদার জ্বালায় আমরা পিজিটি – হাউজস্টাফরা ছিলাম জর্জরিত। গিজগিজে ভিড়ে ভর্তি আউটডোরে স্বপনদা কী কায়দায় যে এত রোগীর প্লাস্টার করে দিত! তাও আবার দোকানে কিনতে পাওয়া প্লাস্টার অফ প্যারিসের রোল নয়- সিনথেটিক প্লাস্টার তো তখন স্বপ্ন- এগরোল তৈরির কায়দায় পাতি ব্যাণ্ডেজে প্লাস্টারের গুঁড়ো ভরে। আবার কখনো কখনো আউটডোর রিডাকশন রুমে কোন রোগীকে অজ্ঞান করে ফ্র্যাকচার সেট করে প্লাস্টারের জন্য রাখা আছে, অ্যানাস্থেটিষ্ট দিদি রেডি হয়ে বসে আছে, এমন সময় স্বপনদা জল ঝরতে থাকা একটা এক্সরে প্লেট নিয়ে এসে বলত, ‘দেখুন স্যার, কেমন হয়েছে?’
দেখতাম বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ফ্র্যাকচার ম্যাজিক-এর মতো সেট হয়ে গেছে- অজ্ঞান না করেই।
রোগী হয়তো খানিক চেঁচিয়েছে। কিন্তু ফ্র্যাকচার সেট হয়ে গেছে, আর আমাদের হাতে কলমে শেখার সুযোগের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। এই ছিল প্লাস্টার রুমের রোজকারের রুটিন। এ হেন স্বপনদা দেশের বাড়িতে মারকাটারি কোয়াক প্র্যাকটিস করবে- সে আর আশ্চর্য কি? সেই প্র্যাকটিসের রেশ মাঝে মাঝে মেডিক্যাল কলেজেও এসে পৌঁছতো।
চিরঞ্জিত লাহিড়ীর যেদিন প্লাস্টার হয়, সেদিন প্লাস্টার রুমে সময় মতো পৌঁছেও দেখলাম কাস্ট ব্রেসিং এর জন্য হাঁটুর দুদিকে প্লাস্টিকের জয়েন্ট লাগিয়েও প্লাস্টার করা প্রায় শেষ। সৌজন্যে স্বপনদা আর অর্ঘ্য! প্লাস্টারের উপরে তখন পালিশ করে চকচকে করা চলছে।
সিনিয়র আরএমও পাশ দিয়ে যেতে যেতে বললেন, ‘কর কর, আসল জায়গায় চকচকে কর !’
আমি বললাম, ‘একটা এক্সরে করে দেখা যাক।’
চিরঞ্জিতবাবু প্রায় আঁতকে উঠল, “না না কালকেই তো এক্স রে হয়েছে।আজ আর দরকার নেই।’
এক্স রে হল না এবং রোগী বাড়ি চলে গেল। সিনিয়ররা ও কেউ কিছু বলল না। তারা রোগীর সংখ্যা কমাতে ব্যস্ত।
পুলিশের ইনভেষ্টিগেটিং অফিসার একদিন আবার এলেন। আমাকে পাকড়াও করলেন শিবুদার ক্যান্টিনে। ‘রোগীকে ছেড়ে দিলেন?’
‘হ্যাঁ, কেন?’
‘পাখি উধাও।’
‘মানে?’
‘বাড়িতে তালা। বাবা-মা, দুই মেয়ে কেউ নেই।’
‘তারপর?’
‘পালাতে পারবে না। ঠিক ধরা পড়বে।’
‘ওনার ভাই কী বলছে?’
অফিসার আমার কথার উত্তর না দিয়ে বললেন, ‘চিরঞ্জিত লাহিড়ী যে হোমিওপ্যাথি ডাক্তার সেটা জানতেন?’
আমি মাথা চুলকে বললাম, ‘সেই জন্য…উনি থাইয়ের অ্যানাটমি আর অন্যান্য মেডিক্যাল পরিভাষাগুলো বেশ ভালো জানেন। তখন বুঝিনি।’
‘ওনার দাদু কুমোরটুলি পাড়ায় বেশ নামডাক-ওলা অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তার ছিলেন। নাম অনাদিচরণ লাহিড়ী।’
‘তাঁর পরের প্রজন্মে এই?’
‘গল্পের এখনো অনেক বাকি। ডাক্তার অনাদিচরণ-এর পসার ছিল বিশাল। কিন্তু হলে হবে কি, তিনটি ছেলেই অপদার্থ। বাপের পয়সায় বাবুয়ানি করে জীবন কাটিয়েছে আর উত্তর কলকাতার সম্পত্তি বিক্রি করে করে খেয়েছে। তবে ছোটো ছেলের ঘরে দুই নাতি হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার- বড়জন বিশ্বজিৎ। ভালো প্র্যাকটিস। খাটিয়ে মানুষ। কিন্তু ছোটজন চিরঞ্জিৎ অলস, মাথাগরম। প্র্যাকটিস জমাতে পারেনি। শরিকী সম্পত্তির উপরে ভরসা।’
‘আপনার তদন্তের কী হল? ওই হীরের পেন্ড্যান্ট?’
‘এখন তো ভোট এসে গেছে। পুলিশ ডিপার্টমেন্টের আর সময় কোথায় এসব নিয়ে ভাবার? তবে আমি আমার প্রাইমারি রিপোর্ট দিয়ে দিয়েছি।’
‘এবার তো তাহলে আমাকে বারবার কোর্টে দৌড়তে হবে।’
‘ না না, আপনার কিছু হবে না। হয়তো একবার ইনজুরি রির্পোট পড়ার জন্য ডাকবে। তবে আপনাদের সব ডাক্তারদের সম্বন্ধে এমন কথা বলা যাচ্ছে না।’
‘অ্যাঁ? তাই নাকি? কে কে?’
‘এর থেকে বেশী বলা যাবে না।’
‘ও’
‘প্লাস্টারটা আপনি নিজের হাতে করেননি তো?’
‘ নাঃ, সুযোগই পাই নি।’
‘বেঁচে গেছেন। বাই দ্য ওয়ে, যেটা বলতে পারি- পেন্ড্যান্টটা পাওয়া যাবে মনে হয়। আর তারপরেই কেসটা এগোবে।’
অর্ঘ্য বিপদের গন্ধ পেয়ে প্ল্যাব দিয়ে খুব দ্রুত বিলেতে পাড়ি দিল- এখানে ডিগ্রী শেষ না করেই। কিছু আঁচ করেছিল বোধহয়।
অর্ঘ্য-র খোঁজে হস্টেলে একদিন পুলিশ এলো। সেখানে না পেয়ে ওর বাড়িতেও গিয়েছিল। কিন্তু ততক্ষণে সে পগার পার।
তারপর নানান কারণে ঘটনাটা ধামাচাপা পড়ে গেলো। এই সব ছোট খাটো কেসে যা হয় আর কি! আমিও পাশ করে চাকরি পেয়ে চলে গেলাম। কোর্টে আমার ডাক পড়ে নি। প্রথম প্রথম মনে হত- কী ঘটেছিল সেই রাত্রে! কেনই বা ঘটেছিল? তারপর সময়ের ধীরে ধীরে একদিন সব ভুলেই গেছিলাম।
প্রায় বারো বছর পরে হায়দ্রাবাদে গেছি অর্থোপেডিক কনফারেন্স-এ। কনভেনশন সেন্টারে লাঞ্চ করে হাত ধুচ্ছি। এমন সময় বেসিনের আয়নায় দেখলাম আমার প্রায় সমবয়সী এক ভদ্রলোক আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। গলায় ঝোলানো পরিচয়পত্র। এই কনফারেন্সের ডেলিগেট। মানে অর্থোপেডিক সার্জেন।
‘ডাক্তার নাথ, মেরা নাম উদয় মুথা। ম্যায় নাসিক সে হুঁ। মেরা ওয়াইফ আপকা সাথ মিলনা চাহতি হ্যায়।’
আমি এতে যার পর নাই অবাক হয়ে বললাম, ‘আপকা ওয়াইফ মুঝে ক্যায়সে জানতি হ্যায়?’
‘উও কলকাত্তা কী হ্যায়। বেঙ্গলি। আপকো পহলে সে জানতি হ্যায়।’
‘আচ্ছা।’
পিছনে ঘুরতেই একজন সুশ্রী ও তন্বী ভদ্রমহিলা হাসিমুখে এগিয়ে এলেন। ‘আমায় চিনতে পারছেন? আমার বাবা মেডিক্যাল কলেজে আপনাদের ইউনিটে ভর্তি ছিলেন।’
চেনা চেনা লাগছিল। এই কথায় এক লহমায় মনে পড়ে গেল।
চিরঞ্জিৎ লাহিড়ীর ছোট মেয়ে।
‘মনে পড়েছে। কী নাম যেন?’
‘ভুলে গেছেন? সঞ্চিতা। এখন সঞ্চিতা মুথা।’
‘এখানে আপনার সাথে দেখা হবে ভাবতেই পারিনি। হাজব্যান্ড মারাঠি, তাই তো?’
ডাঃ উদয় বলে উঠল, ‘আমি বাঙালি জানি।’
সঞ্চিতা বলল, ‘চলুন চলুন, অনেক কথা আছে । কফি খেতে খেতে বলা যাবে।’
হাইটেক সিটির কফিশপে বসে কফি খেতে খেতে গল্পের শেষ অংশটা শুনলাম সঞ্চিতার মুখে।
‘আমার বাবা আর আমার জেঠু দুজনেই হোমিওপ্যাথি পাশ ডাক্তার। বাবার দাদু অ্যালোপ্যাথি ডাক্তার ছিলেন। জেঠু সেই প্রাকটিস কিছুটা পেয়েছিল। কিন্তু কেন জানি না বাবা কোনোদিন প্র্যাকটিস করেনি। সম্পত্তি আর শেয়ার বাজার করে জীবন কাটিয়েছে। বাবার দাদুই এই সব সম্পত্তি করেছিল। পরের প্রজন্মের তেমন কোনো অবদান নেই। দাদু আশা করেছিল, তার পরের প্রজন্মে কেউ নিশ্চয়ই ডাক্তারি পড়বে। তাই তার জন্য উনি, মানে ডাক্তার অনাদিচরণ একটা হীরের পেন্ড্যান্ট রেখে যান, যার বাজারদর এই মুহুর্তে বেশ কয়েক লক্ষ টাকা। যদিও আমি বা আমার দিদি, আমরা কেউ ডাক্তার হই নি। আমি জার্নালিজম পড়েছি, দিদি ইংরেজিতে এম এ।
এই পর্যন্ত ঠিকই ছিল। গোল বাঁধল জেঠুর মেয়ে অলকা-দির বিয়ে ঠিক হতে। অলকা-দি স্কুল টিচার। পাত্র ডাক্তার। সরকারি চাকরি করে। কিন্তু সেসব জেনে আমার বাবার মাথা খারাপ হয়ে গেল। পাত্র ডাক্তার, সুতরাং হীরের পেন্ড্যান্ট সে পাবে!
বাবা তখন উঠে পড়ে লাগল এই বিয়ে ভাঙতে। লোক লাগিয়ে ভাংচি দিয়ে, বেনামী চিঠিপত্র দিয়ে। যখন তাতে সফল হলো না, তখন বিয়ের দিন মদ খেয়ে প্রচণ্ড গন্ডগোল করল। ধাক্কাধাক্কির মাঝে সিড়িতে পড়ে বাবার পা ভাঙলো। তারপর তো আপনি জানেন!’
‘সব জানিনা। যেমন হীরের পেন্ড্যান্ট। আর তোমার দিদির সাথে অর্ঘ্যর সম্পর্ক।’
‘প্রথমে দিদির কথায় আসি। বাবা জোর করে নানা প্যাঁচ কষে দিদিকে দিয়ে এটা করাতে চেয়েছিল। মাঝখান থেকে অর্ঘ্য দিদিকে এক্সপ্লয়েট করে কেটে পড়ে। আমাকে নিশ্চয়ই আর বিস্তারিত বলতে হবে না।’
‘না না, আমরা সবাই জানতাম, ও অত্যন্ত বাজে ধান্দাবাজ ছেলে। কিন্তু পেন্ড্যান্ট?’
সঞ্চিতা একটা বিরাট দীর্ঘশ্বাস ফেলে আস্তে আস্তে বলল, ‘ওটা বাবার কাছেই ছিল। বিয়ে বাড়ি থেকে বাবা চুরি করেছিল’
আমি বললাম, ‘তারপর?’
‘হাসপাতালের ওয়ার্ডেও ওটা বাবার কাছে ছিল। হাসপাতালে বিশেষ খোঁজখবর হয় নি। তারপর বাবা অর্ঘ্যকে পেন্ড্যান্ট-এর লোভ দেখিয়ে আর টেকনিসিয়ানকে ঘুষ দিয়ে পায়ে প্লাস্টার করার সময় ওটা প্লাস্টার এর মধ্যে গেঁথে নেয়।’
কথাটা শুনে এত বছর বাদেও চমকে উঠলাম।
‘হুম্, সেই জন্যেই প্লাসটার করার সময়ে আমাকে কাছে ঘেঁষতে দেওয়া হয় নি। প্লাস্টারের পরে এক্সরেও করানো হয় নি। এক্সরে করলেই পেন্ড্যান্ট ধরা পরে যেত।’
সঞ্চিতা মাথা নীচু করে বলল, ‘হুঁ, কিন্তু শেষরক্ষা হয় নি।‘
‘কি রকম?’
‘হাসপাতাল থেকে বাড়ি না গিয়ে আমরা নৈহাটিতে আমাদের একটা অন্য একটা বাড়িতে গিয়ে উঠি। কিন্তু পুলিশ সেখানেও ঠিক খুঁজে বের করে আমাদের। জেঠু কেস করেছিল বাবার বিরুদ্ধে পারিবারিক গয়না চুরির। বাবা জেঠুর বিরুদ্ধে -অ্যাটেম্ট টু মার্ডার। দুজনেই অ্যারেষ্ট হয়। বাবার পায়ের প্লাষ্টার খুলিয়ে পেন্ড্যান্ট পাওয়া যায়। অবশ্য অনেক পরে সব মিটমাট হয়ে গিয়েছিল।’
‘আমি এসব জানতেই পারি নি!’
‘আপনি বুঝবেন না, আপনাকে আমরা, এমনকি বাবাও কতটা শ্রদ্ধা ও সম্মান করতাম এবং এখনো করি। তাই আপনাকে এসবে জড়াতে চাই নি।’
‘আর তোমার গল্প?’
‘আমি পুরো ব্যপারটা থেকে পালাতে চেয়েছিলাম। তাই স্কুলেই বায়োলজি ছেড়ে দিই, যাতে বাবা-মা আমাকে ডাক্তার হওয়ার জন্য চাপ দিতে না পারে। জার্নালিজম পাশ করেই বম্বে চলে গেছিলাম। একটু আধটু মডেলিং আর অ্যাঙ্করিং-ও করতাম। সেখানেই ডাঃ মুথার সঙ্গে আলাপ হয়। আলাপ থেকে প্রেম। প্রেম থেকে বিয়ে- যেরকম হয়। আমাদের দুটো ছেলেমেয়ে আছে।’
‘আর তোমার দিদি?’
‘দিদির বিয়ে হয়েছিল একজন ইঞ্জিনিয়ারের সাথে। মানাতে পারেনি। সেপারেশনের পরে এখন মায়ের সাথে থাকে।’
‘তোমার বাবা কেমন আছে?’
‘বাবা চলে গেছে দু-বছর আগে।’
(সমাপ্ত)
ছবি: ইন্টারনেট
(প্রায় সব চরিত্রই কাল্পনিক। কেউ এতে কোনো মিল খুঁজে পেলে তা নেহাতই কাকতালীয়।)