অবশেষে দিনরাত এক করে বিভিন্ন বিরল অসুখের একদম মলিকুলার লেভেল অবধি আত্তীকরণ করে এমডি পাশ করলাম। পোস্টিং পেলাম পানিহাটি স্টেট জেনারেল হাসপাতালে। এবং অল্প সময়ের মধ্যেই বুঝতে পারলাম এমডি’র জ্ঞানভাণ্ডার শীঘ্র বিস্মৃত না হলে খবর আছে।
কদিন আগেও মেডিকেল কলেজে এক-একজন রোগীর পাশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়েছি। রোগের ইতিহাস ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের ইতিহাসের চেয়েও বিস্তারিত লিখেছি। আর পানিহাটিতে ঢুকে দেখলাম মেডিসিন বিভাগে দেড়শো রোগী ভর্তি। আমিই একা ফিজিশিয়ান। আমার একটাই কাজ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রোগীদের সুস্থ বা অর্ধেক সুস্থ করে বাড়ি পাঠানো। যাতে বিছানা খালি হয় ও নতুন রোগী ভর্তি হতে পারে। অর্থাৎ আমার কাজ খানিকটা ঝাড়ুদারের মতো। সেই কাজে হ্যারিসনের বইয়ের থেকে উপস্থিত বুদ্ধি বেশী সহায়ক।
ভর্তি থাকা দেড়শো রোগী দেখলেই ছুটি মেলে না। সপ্তাহে দুদিন আবার মেডিসিন আউটডোর। প্রতি আউটডোর পিছু প্রায় চারশো সুগার, প্রেশারের রোগী ওষুধ নিতে আসেন। অসুখ যাই হোক, তাঁদের একটাই দাবী, ‘ডাক্তারবাবু প্রেশারটা একটু দেখে দিন।’
একদিন আউটডোর শেষ করে সান্ধ্যকালীন রাউন্ড দিচ্ছি। মেজাজ ভিসুভিয়াসের মত। কারণ আউটডোর শেষ করার পর পরই আমি একটি ‘প্রেম পত্তর’ পেয়েছি। হাসপাতালের সুপার শো কজের চিঠিতে জানতে চেয়েছেন, কেন আমি আজ সকালে রাউন্ডের সময় অধিকাংশ রোগীর বিস্তারিত ক্লিনিক্যাল নোটস দিইনি।
এর জন্য শোকজ লেটার না দিয়ে ভোর সাড়ে ছটা থেকে উনি ওয়ার্ডে থাকলে বুঝতে পারতেন তিন ঘণ্টার মধ্যে দেড়শো রোগী দেখে, সত্তরটা ছুটি লিখে সাড়ে নটার আগে আউটডোর শুরু করতে হলে ঠিক কতখানি ক্লিনিক্যাল নোটস লেখা যায়।
মেয়েদের ওয়ার্ডে রোগী দেখছিলাম। মনটা বড্ড চা চা করছিল। এসময় মেল ওয়ার্ডের আয়া নারানদা চায়ের যোগান দেয়। নারানদা দুদিন ধরে আসছে না, অসুস্থ। মেজাজটা তাই আরও খিঁচরে রয়েছে।
সিস্টাররা মায়ের জাত। আমার মুখ দেখেই বুঝে গেলেন সমস্যা কি। আমাকে বললেন, ডাক্তারবাবু, চা করেছি। আগে চা খান, তারপর রাউন্ড দেবেন।’
সবে স্ট্যান্ড ফ্যানের পাশে বসে গরম চায়ে আয়েশ করে চুমুক দিয়েছি, ফিমেল এক নম্বর ওয়ার্ড থেকে কল-বুক এসে হাজির। ওখানকার আয়া মাসি একগাল হেসে জানাল, ‘ডাক্তারবাবু কমলা পালের মুক্তি হইছে। এখন আপুনি গিয়ে ডেথটা কনরফম করে আয়েন।’
উঠতে যাচ্ছিলাম, সিস্টারদিদি ধমক লাগালেন, ‘ডাক্তার ভৌমিক চা’টা শেষ করে যান। কমলা পালের মৃত্যু এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যপার নয় যে পাঁচ মিনিট পরে গেলে মহাভারত অশুদ্ধ হবে।
বিভিন্ন মানুষের মৃত্যুর গুরুত্ব বিভিন্ন রকম। সময় থাকলে এই নিয়ে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখতাম। কারো মৃত্যু দুঃখের, কারো মৃত্যু রাগের জন্ম দেয়। কমলা পালের মৃত্যুটা অনেকটা হাঁপছাড়া টাইপের। ‘যাগ, মরে গিয়ে বেঁচে গেল।’
গত দুমাস ধরে এই বুড়ি আমাদের হাসপাতালের একটি অমূল্য বেড আটকে রেখেছিলেন। তিন চারবার স্ট্রোক হওয়ার পর তাঁর হাত, পা, মস্তিষ্ক, চোখ, কান ইত্যাদি কোনও অঙ্গ প্রত্যঙ্গই ঠিক ঠাক কাজ করে না। বিছানায় শুয়ে শুয়ে রাইলস টিউবের মাধ্যমে খাওয়া দাওয়া। ক্যাথেটারের মাধ্যমে বহ্য নিষ্ক্রমণ। আস্তে আস্তে ঘায়ে সারা দেহ ভরে যাচ্ছিল। গন্ধে পাশের বেডের রোগী দিনের দিনই ছুটি নিত।
অনেকবার ওনার বাড়ির লোককে বলেছি, ‘বিশেষ কিছু করার নেই। বাড়ি নিয়ে যান। যা হওয়ার বাড়িতে সবার মাঝে হোক।’
ওনার বড় ছেলে সুপারের কাছে নালিশ করেছেন, ডাক্তারবাবু দায়িত্ব এড়ানোর চেষ্টা করছেন। ওনার অসুস্থ মাকে চিকিৎসা না করেই ছুটি দিতে চাইছেন।
তবু যতই হোক একজন মারা গেছেন। রোগীর মৃত্যু একজন চিকিৎসকের সার্বিক পরাজয়। চিরতার জল গেলার মত বিদঘুটে মুখ করে গরম চা দুই চুমুকে শেষ করলাম। তারপর ফিমেল ওয়ার্ডে গিয়ে ডেথ কনফার্ম করলাম। আয়া মাসিকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ফোন করে বাড়িতে জানিয়েছেন?’
‘ফোন করেছি। কেউ ধরে নাই। আমার ফোন নাম্বার চিনি নেছে। শেষ দু সপ্তাহের টাকা দেয় নাই। তাই আমার ফোন আর ধরে নে।’
আমি বললাম, ‘নাম্বারটা বল। আমি একবার করে দেখি।’
‘হ্যালো, পানিহাটি হাসপাতাল থেকে বলছি।’
ওপাশে যেন ঝড় বয়ে গেল। “অফেন্স ইস দ্য বেস্ট ডিফেন্স” এই কথাটা ফোনের ওধারে থাকা ব্যক্তি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন। ‘কি পেয়েছেন কি আপনারা, আমি তো কতবার বলেছি মা সুস্থ না হলে হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ করব না। আপনাদের ঐ ভৌমিক ডাক্তারের বিরুদ্ধে আমি সুপারকে জানিয়েছি। দরকার হলে মানবাধিকার কমিশনে যাব। শালা… সরকারি হাসপাতাল। ডাক্তার এমন ভাব করছে যেন বাপের জমিদারী।’
এসব অপমান আর আমায় স্পর্শ করে না। সম্ভবত আমি দিনে দিনে মহামানব হয়ে উঠছি। শান্ত গলায় বললাম, ‘শুনুন, আমি ডাক্তারবাবুই বলছি। আপনার মা একটু আগে মারা গেছেন। চার ঘণ্টা বাদে এসে দেহটা নিয়ে যাবেন।’
একটু নিস্তব্ধতার পর আওয়াজ পেলাম, ‘সরি ডাক্তারবাবু, মিস্টেক হয়ে গেছে। আজ যেন কত তারিখ?’
‘জুনের দুই।’
‘যাহ্… পেনশনটা গত কালই এক তারিখে তুলে ফেললে হত। এখন তুলতে গেলে হাজার ঝামেলা।’
রোগী মরলে বাড়ির লোক সম্পত্তি পাবে । ডাক্তারের কপালে শুধু পড়ে থাকে বদনাম । আর অপমান । কতো বড়লোক দেখলাম । মা বাবাকে ফেলে রাখে সিঁড়ির তলায় – চিলেকোঠার প্রেসার কুকারের থেকে গরম ঘরে । বলো না । এতোদিনে আমার মুক্তি ঐ আকাশে কথাটার মানে বুঝেছি ।