আজ আপনাদের আজবপুরের গল্প শোনাবো। প্রায় হাজার বছর আগের কথা। আজবপুরের সিংহাসনে মহারাজা নরেন্দ্রনারায়ণ রায়। এককালে এ রাজ্যের বিরাট নাম ছিল। শিক্ষা, সংস্কৃতি, শিল্প, ইতিহাস ইত্যাদি সকল বিষয়েই আজবপুরের খ্যাতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। আজ আর তার চিহ্নমাত্র নেই। রাজা নরেন্দ্রনারায়ণ রায়ের বকলমে ধনী শেঠরাই রাজত্ব চালায়। রাজ্যের সম্পদ তারা এক এক করে কুক্ষিগত করে নেয়। অবশ্য রাজার কাছে নিয়মিত উপঢৌকনও পৌঁছে যায়। রাজা আবার খুব শৌখিন মানুষ। দেশের মানুষ না খেতে পেয়ে মরলে কী হবে, রাজার শখের অভাব নেই। এই ধরুন রাজার পাগড়ীটা; ওটার দাম এক লক্ষ মোহর। কৃষ্ণকেশ শেঠ ওটা উপহার দিয়েছেন। রাজা দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ান। শেঠেরা তার যাবতীয় আয়োজন করে দেন। দিনে মৃগয়া, রাতে নাচগানের মজলিশ; এই নিয়ে রাজা মেতে আছেন। এদিকে শেঠেরা সব লুটেপুটে খাচ্ছে। রাজার নজর নেই কিংবা দেখেও দেখেন না। রাজ দরবারে নিয়মিত উপহার পৌঁছে গেলেই হল।
রাজা সুশাসক না হ’লে দেশের মানুষ ভালো থাকতে পারে না। ঘরে ঘরে অনাহার, গ্রামে গ্রামে দুর্ভিক্ষ। রাজ্যের মূল জনপদ গুলোর অবস্থাও তথৈবচ। রাজ্যের পূর্বপ্রান্তে বিরাট জনপদ ব্যঙ্গনগর। বস্তুত, আজবপুরের সমৃদ্ধি বিস্তারে এই ব্যাঙ্গনগরের অবদানই ছিল সবচেয়ে বেশি। যজ্ঞের মন্ত্রোচ্চারণ, পুঁথিপত্র লেখা, ইতিহাস চর্চা, সামবেদের গান গাওয়া, অভিনয়, শারীরিক কসরত ইত্যাদি প্রতিটি বিষয়েই ব্যাঙ্গনগর শীর্ষস্থানীয় ছিল। একটা জনপদ থেকে এতজন গুণী মানুষের আবির্ভাব বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল। আসলে এটা শুধু একক কৃতিত্ব ছিল না। সময়টাই ছিল ওরকম। গ্রামের মানুষের গোলাভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ। নবান্নের ধানে, গৃহস্থের আলপনায়, সন্ধ্যেবেলার শাঁখের আওয়াজে প্রতি মুহূর্তে ব্যাঙ্গনগরের সমৃদ্ধি উচ্চারিত হ’ত।
তারপর বহুদিন কেটে গেছে। সে দিনও নেই, সে মানুষও নেই। ব্যাঙ্গনগরে পড়াশুনোর চল দ্রুত কমে আসছে। কী হবে ওসব করে? মোসাহেব না হ’লে রাজদরবারে কাজ জোটে না। কত বড় বড় সভাকবি একসময় ব্যাঙ্গনগর থেকে আজবপুরের দরবারে গিয়েছিলেন। আর আজ দেখুন! বর্তমান সভাকবির কবিতার নমুনা-
“এই যে আমার খাতা
গাধার মাথায় ছাতা
যতই বলো যা তা
পাবোই আমি ভাতা”
এসব কবিতা লিখেও তিনি ‘কবিরত্ন’ উপাধি পেয়েছেন। রাজবৈদ্যকে নাড়ি দেখতে দিলে মাথার চুল সরিয়ে উকুন বাছতে বসে। সভার প্রধান গায়কের সুর শুনলে এলাকায় সারমেয়-জলসা শুরু হয়ে যায়। প্রধান স্থপতিকে বাড়ি বানাতে দিলে বৃহদাকার হাঁড়ি বানায়। রাজা এদেরকেই মাথায় তুলে রেখেছেন। বিভিন্ন ধরনের রত্ন-টত্ন সবাই পেয়েছেন। ব্যাঙ্গনগরের মানুষের মন থেকে উচ্চাশাটাই হারিয়ে গেছে। জমিদারের নায়েবরা ছিটেফোঁটা ভিক্ষে দিলে ব্যাঙ্গনগরের মানুষের পেট চলে। তা বলে কী কিছুই নেই? আছে, আছে। ভয় আছে। কালান্তক ভয়। কেউ কথা বলে না। কথা বললেই রাতে কখন খড়ের চালে আগুন ধরে যাবে, জমির ফসল ভূতে তুলে নিয়ে যাবে; কেউ জানে না। ব্যাঙ্গনগরে শ্মশানের নীরবতা।
শুধু ব্যাঙ্গনগরের মোড়ল নির্বাচনের সময় তারা নীরবতা ভেঙে জেগে ওঠে। ব্যাঙ্গনগর জনপদের মোট ছাব্বিশটি গ্রাম। মোড়ল নির্বাচনের সময় এলেই সবাই সবার বিরুদ্ধে গা-গরম বক্তৃতা দিতে থাকে। বাড়ির চালে কাক-চিল বসতে পারে না। সবারই বক্তব্য মোটামুটি এরকম- আমার তুলসীপাতা গঙ্গা জলে ধোওয়া। ওর তুলসী পাতা গুয়ে ভরা। সবাই সবার মুখোশ খুলে দেওয়ার কথা বলে। বিভিন্ন রকম প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। গ্রামের ছেলে-ছোকরাদের হাতে কাজ নেই। একেকজন আলাদা আলাদা নেতার হয়ে জান লড়িয়ে দেয়। কোনোরকম অগ্র-পশ্চাৎ ভাবনা চিন্তা তখন তাদের মাথায় খেলে না। এমনকি নেতাদের কথায় ভুলে পাশের বাড়ির ছেলেকে খুন করতেও তারা পিছপা হয় না। সবাই জানে, এমনিতে সারা বছর খেতে পরতে পারার অন্য কোনও উপায় নেই। একবার মোড়ল হ’তে পারলে বা মোড়লের কাছাকাছি থাকতে পারলে বেশ খানিকটা অর্থাগম হ’তে পারে। রক্তের নেশায় মেতে ওঠে তারা। এই তো দু’বছর আগের মোড়ল নির্বাচনের সময় নিজেদের মধ্যে মারামারি করে ষাটজন অকালে মারা গেল। সেদিনই রাতে খবর এলো, ব্যাঙ্গনগরের পোড়ো মন্দিরের পাশের বটতলায় একটা সুড়ঙ্গের সন্ধান পাওয়া গেছে। কোন এক বুড়ো সাধুবাবা নাকি বলে গেছেন, ওর মধ্যে মোহর আছে। কিন্তু সমস্যা একটাই। সুড়ঙ্গের দরজা খুলতে গেলে ছাব্বিশটি গ্রামের সব নেতার হাতের ছাপ লাগবে। একজনও কম হ’লে দরজা খুলবে না। মুহূর্তের মধ্যেই যুযুধান নেতারা এক জায়গায় জড়ো হলেন। গলাগলি, কোলাকুলি হলো। তারপর আর কী? সব নেতা একসাথে গিয়ে মোহর উদ্ধার করে আনলো। তারপর ভাগ বাঁটোয়ারাও হয়ে গেল। ওদিকে তখনও নেতাদের অনুগামীরা মারামারি করে মরছে।
শোনা যায়, আজবপুরের রাজা নিজেই নাকি পুরো ব্যবস্থাটা করেছিলেন। শেঠদের বলতেই তারা ব্যাঙ্গনগরে একঘড়া মোহর রেখে আসে। তারপর খবরটা চাউর করার জন্য এক মোসাহেবকে বুড়ো সাধু সাজিয়ে পাঠিয়ে দেয়। রাজার উদ্দেশ্য সফল। এই নেতাদের একটু মাতিয়ে রাখতে পারলে উটকো বিদ্রোহ করে বসে না। শান্তিতে মজলিশে বসা যায়। নেতারাও মোহর পেয়ে খুব খুশি। সবাই এখন গলায় গলা মিলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। একদিন সবাই মিলে বিকেলে ঘুরতে বেরিয়েছ, এমন সময় রাস্তার সামনে ক্ষ্যাপা জগাই। ক্ষ্যাপা জগাইকে সব নেতাই এড়িয়ে চলে। এ ব্যাটার মাথার ঠিক নেই। নেতাদের সমীহ করে না। যখন তখন যা খুশি বলে বসে। এক নেতা চিৎকার করে বলেন-
– তুই এখানে কী করছিস রে জগাই?
– কী আর? তোমাদের গান শোনাবো। শুনবে শুনবে?
– ভাগ এখান থেকে। আমাদের খেয়ে দেয়ে কাজ নেই ভেবেছিস?
– উঁহু। গান শুনতেই হবে। ওইখানে সবাই মিলে চুপটি করে বসো।
নেতারা জগাইকে খুব বেশি ঘাঁটায় না। এমনিতেই ব্যাটার গোটা গায়ে কালিঝুলি, গোবর মাখা। এসে জাপটে ধরলে সাদা পোশাকটা এক্ষুনি নোংরা হবে। ভয়ে ভয়ে সবাই বসে পড়ে। মাটির হাঁড়ি বাজাতে বাজাতে জগাই গান ধরে-
“সব শালা হারামি, কথাটা তো সাচ্চা
দেখো হে নেত্য করে, শুয়োরের বাচ্চা”
জগাই গলা চড়ায়। তার আওয়াজ গ্রামের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে যায়। স্বজন হারানোর ব্যথায় তখন গ্রাম থমথমে। তবু গুঞ্জন উঠতে শুরু করেছে- “সেই যদি আমে-দুধে মিশে যাবি, সবাই মিলে মোহর পাবি, মোহর নিয়ে রাজসভায় যাবি; তাহলে আমাদের ছেলেগুলোর মাথা কেন খেলি বল? ফিরিয়ে দিতে পারিস এতগুলো জীবন?”
গুঞ্জন বাড়তে থাকে। এক এক করে গ্রামের মানুষ ভয় ভুলে ক্ষ্যাপা জগাইয়ের পেছনে এসে দাঁড়ায়। দাবী ওঠে-
“খাবার চাই, পুঁথি চাই, ধানের জমি চাই। যারা ভালো কাজ করবে তারাই রাজসভায় যাওয়ার সুযোগ পাবে। অযোগ্য রাজা, অযোগ্য সভাসদ, অযোগ্য রাজবৈদ্য, অযোগ্য সভাকবি মানি না, মানি না, মানি না।”
মুষ্টিবদ্ধ হাত আকাশ ছুঁয়ে যায়।