“মিলতো যদি চাঁদের বুকে সজনে ডাঁটার চচ্চড়ি
আর্মস্ট্রং কি সেখান থেকে আসতো ফিরে সত্বরই
অক্লেশে সব তুচ্ছ করে
রকেটটারই পুচ্ছ ধরে
মহাকাশে চলতো ঘুরে হয়তো কয়েক বচ্ছরই।“
এটা আমার লেখা নয়, কল্পবিশ্ব ম্যাগাজিনে কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা। ভদ্রলোককে আমি চিনি না, কিন্তু ডাঁটা চচ্চড়ি দিব্যি চিনি।
সারাদিন সময় পাইনা। তবে বেশিরভাগ রাতে আমি আর রূপালী এক সাথে খেতে বসি। ডাঁটা চচ্চড়ি হলে জমে যায়। ডাঁটা চেবাতে চেবাতে ঘণ্টাখানেক কাটিয়ে দিই। ইংরাজি নতুন দিন শুরু হয়ে যায়। আমাদের কাফে কফি ডে নেই, লাজিজ নেই, বারবিকিউ নেশন নেই। কিন্তু আমাদের ডাঁটা আছে- সজনে ডাঁটা, কাটোয়ার ডাঁটা, ডাঁটা শাক। আমি হলে লিখতাম
শাওন রাতে সজনে ডাঁটা থাকলে ডালে অম্বলে
দম্পতীর সারাদিনের প্রেমালাপের সম্বল-এ
দীর্ঘক্ষণের অদর্শনে
শীতল ধারা বর্ষণে
মুখোমুখি চর্বণে আর কাজের কথা কম বলে।
কিন্তু আজকের গল্প দাম্পত্য নিয়ে নয়। আজকের গল্প বড় মেয়ে সানাইকে নিয়ে। যার ডাঁটা চিবানোতে একেবারেই আগ্রহ নেই।
রাতে বাড়ি ঢোকার সাথে সাথে ছোটো মেয়ে রানী নাচতে নাচতে ছুটে আসে। এবং দিদি সম্পর্কে এক গাদা নালিশ করে। বাড়ি ফিরে স্কুটার গ্যারেজে ঢুকাচ্ছি, রানী বেরিয়ে এসেছে। রূপালীর একটা চটি পায়ে গলিয়ে এসেছে। হোঁচট খেতে খেতে কোনরকমে সামলে বলল, বাবা, দিদি কিন্তু খুব খারাপ একটা কাজ করেছে।
বললাম, তুই চটিটা পালটে আয়, তারপর শুনব। না হলে এখুনি পিছলে পড়বি।
রানী বলল, পড়লে কোনো সমস্যা নেই। তাছাড়া আমি এতো সহজে পড়বোও না। তুমি আগে দিদি কী করেছে শোনো। দিদি আজ ডাঁটা চুরি করছে।
আমি রানীর উদ্ভট নালিশ শুনে অভ্যস্ত। তবে ডাঁটা চুরির কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম। আমরা ছোটো বেলায় পেয়ারা চুরি করেছি, আম- জাম- জামরুল- লিচু সব চুরি করেছি। কিন্তু ডাঁটা কোনোদিনও চুরি করিনি। বললাম, সে কী রে, সত্যি সত্যি ডাঁটা চুরি করেছে?
হ্যাঁ বাবা। আজ দুপুর বেলায়। মা যখন হাসপাতাল থেকে ফিরে ঘুমিয়ে পড়েছিল।
রানী বড্ড নালিশ করে বটে, একটু বাড়িয়েও বলে। তবে মিথ্যা কথা খুব একটা বলে না। ও বলছে যখন তখন সানাই কিছু একটা করেছে। কিন্তু কোথা থেকে ডাঁটা চুরি করবে। সজনে গাছই বা কোথায়। আমাদের উল্টোদিকে ডিউকদের বাড়ি একটা সজনে গাছ আছে বটে, কিন্তু সেটাতো অনেক উঁচু। সানাইয়ের মতো অলস ঘুমকাতুরে মেয়ে গাছে উঠে ডাঁটা চুরি করবে… অসম্ভব। রানীকে বললাম, ডাঁটা কোথা থেকে চুরি করেছে? ডিউকদের বাড়ি থেকে?
রানী অবাক হয়ে বলল, ডিউককাকুদের বাড়ি থেকে কেন করবে। আমাদের বাড়ি থেকেই করেছে।
আমাদের ছাদের টবে বেশ কিছু ডাঁটা গাছ হয়েছে বটে, সানাই তাহলে সেগুলোরই সর্বনাশ করেছে। বললাম, কিন্তু ও ডাঁটা চুরি করল কেন?
কেন আবার, খেলার জন্য।
অনেক নস্টালজিয়া হুড়মুড় করে চোখের সামনে ভেসে এলো। আমরাও তো তলোয়ার চালানো শিখেছিলাম এই ডাঁটা দিয়েই। বললাম, বেশ করেছে, সানাই ডাঁটা চুরি করেছে। তুই দিদির নামে নালিশ করা বন্ধ কর।
রানী আহত স্বরে বলল, তুমি দিদিকে কিছু বলো না, শুধু আমাকেই বকো। মায়ের সব ডাঁটা শেষ করে দিয়েছে। মা এখন কী করবে? মা তো খুব রেগে গেছে।
মানে? ফ্রিজ থেকেই ডাঁটা সরিয়েছে নাকি? বললাম, এতে রাগারাগির কী আছে। অন্য কিছু রান্না হবে। ডাঁটা ছাড়াও অনেক কিছু রান্নার জন্য আছে। অসুবিধা হওয়ার কথা না।
রানী রীতিমতো অবাক হয়ে বলল, বাবা, তুমি কী সব আবোল তাবোল বলছো? তুমি কিচ্ছু বুঝতে পারোনি। আমাদের স্কুলের মোবাইল- যেটাতে আমরা অন লাইন ক্লাস করতাম, স্কুল খুলে যাওয়ার পর সেটাতো আর রিচার্জ করা হয় না। দিদি করেছে কী- মা ঘুমিয়ে পড়লে মার মোবাইলের হটস্পট অন করে ডাটা চুরি করে ওটাতে নানা খেলা ডাউনলোড করেছে। মার মোবাইলের সব ডাটা শেষ করে দিয়েছে। এখন মা কিচ্ছু করতে পারছে না। মায়ের অফিসের কাজ আছে। তোমার মোবাইলটা দাও। মা এখন তোমার মোবাইল থেকে ডাটা নেবে।
বুঝলাম আমি যুগের সাথে মোটেই তাল মিলিয়ে চলতে পারছি না। এখনও সেই আর্কিয়ান যুগেই পড়ে আছি। আমার কাছে ডাটা মানে ডাঁটা চচ্চড়ি।
বেশ ভালো লাগলো স্যার