(আগের পর্বে যা ছিল- সুধাংশু শেখরের পানিহাটির বাড়িতে মাদরির খেল দেখানো লছমির একবছর থাকা হয়ে গেল। তাকে স্কুলে ভর্তি করানো নিয়ে সুধাংশু চিন্তিত হয়ে পড়ল। লছমি দিব্যি আছে এখানে)
কয়েকদিন ধরে এক নাগাড়ে বেশ বৃষ্টি হয়ে গেল। তবে আজ আকাশটা পরিষ্কার। শনিবারের অফিস, এক বেলা ছুটি। তাই আজ স্ট্র্যান্ড রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে সুধাংশু বাবুঘাটের দিকে গেলেন । এরকম বিকেলে গঙ্গার ওপারে সূর্য ডোবার দৃশ্য দেখতে সুধাংশু শেখরের খুব ভালো লাগে। কয়েকদিনের বৃষ্টির পরে চারপাশটা কেমন অদ্ভুৎ পরিচ্ছন্ন মনে হয়। আজ আকাশটাও ভীষণই উজ্জ্বল। ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে বেশ কিছুটা এগিয়ে সুধাংশু ফোর্ট উইলিয়ামের কাছাকাছি গেলেন । এরকম মায়াময় বিকেলে গঙ্গার ওপারে সূর্য ডোবার দৃশ্য দেখতে কার না ভালো লাগে ?
নোঙ্গর করা স্টীমার, দলবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা গাধাবোট, মেছো জেলে ডিঙি আর ভেসে যাওয়া পালতোলা নৌকার সারির পিছনে একটা অস্তায়মান সূর্য ধীরে ধীরে ডুবে যাওয়ার পথে লাল আবিরের মত আলোকচ্ছটা বিকেলের আকাশটাকে অকৃপণ হাতে রক্তাভ করে দিচ্ছে।
তিনি বসলেন একটা বাঁধানো ঘাটের কাছে লোহার চেয়ারে। উপভোগ করছিলেন এই দৃশ্য । তিনি শিল্পী নন কিন্তু প্রকৃতির এই চিরায়ত শিল্প কলা তাকে অপ্রতিরোধ্য ভাবে আকর্ষণ করে ।
নদীর পাড় ঘেঁষা একটা চায়ের দোকানের বেঞ্চে দুজন লোক কথা বলছে, খুবই গ্রাম্য কথা। তাদের কথার টানে আর উচ্চারণে পূঁথিগত হিন্দির কোন নামগন্ধ নেই। দেহাতের টান। ঠেলাওলা,মুটে , কচৌড়ি পুরি বিক্রেতা বা গড়ের মাঠের চা ফেরিওয়ালাদের মতো বাচনভঙ্গি।
আড় চোখে একবার দেখে নিলেন সুধাংশু। এই অভ্যাস যদিও ভদ্রোচিত নয় তবু তাকালেন। এক দেখাতে উল্লেখযোগ্য কিছু নজরে পড়ল না। কিন্তু একটা কথা কানে আটকে গেল ।- ওহি দেখো শহীদ মিনার, উধার-ই থি ।
কিছুই নজরে পড়ছে না এখান থেকে। শহীদ মিনারের চূড়া হয়তো আটকে গেছে গাছ পালার আড়ালে। যেহেতু সেটাও সুধাংশুর প্রিয় অবসর যাপনের জায়গা এবং ঐ মিনারের সাথে যে ‘লক্ষ্মীর পাঁচালি’-ও জুড়ে আছে। তাই শব্দটায় বিদ্ধ হল তাঁর কান।
লোক দু’জনকে ভালো করে দেখার জন্য চা পানের অজুহাতে দোকানের কাছাকাছি গিয়ে দোকানীকে এক কাপ চা দিতে বললেন। দেহাতি দুজনের মধ্যে রোগা পাতলা গড়নের লোকটার আছে মোটা গোঁফ এবং গোঁপের সূঁচালো প্রান্তগুলো উপরে ধনুকের মতো ওঠানো, কোটরে বসা চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। সঙ্গের লোকটির নিপাট ভালোমানুষের মতো চাহুনি এবং গোলাকার বড় মাথায় কাঁচা পাকা কদম ছাঁট চুল,একটু চৌকো মতো চেহারায় শান্তশিষ্ট ভাব ।
পাকানো চেহারার কৃশকায় লোকটা দেহাতি ভাষায় বোঝানোর চেষ্টা করছে একটা কিছু যার সাথে ওই খাম্বা মিনারের কিছু সম্পর্ক আছে। ওদের কথাবার্তায় কোতোয়ালি শব্দটা ঘুরে ফিরে আসছে। সুধাংশু তাঁর সহজাত সৌজন্যের সীমানা অতিক্রম করে তাদের আরো কাছে গিয়ে বসলেন চায়ের ভাঁড়টা হাতে নিয়ে। প্রায় দুর্বোধ্য আঞ্চলিক ভাষায় কথোপকথনে কান পেতে তিনি বুঝতে পারলেন এদের কোন কিছু জিনিস হারিয়েছে তাই তারা এখানে আলোচনা করছে কিভাবে তা পাওয়া যায়। খটকা লাগলো শহীদ মিনারের প্রসঙ্গ আসায়।
বাইরে থেকে যারা এই শহর কলকাতায় ঘুরতে আসে তাদের কাছে অবশ্য-দ্রষ্টব্য স্থান এই শহীদ মিনার। সুধাংশু শেখরের নিজেরও প্রিয় সাময়িক অবসর কাটানোর ঠিকানা এই স্থানটি । এই ষোলতলা বাড়ির সমান দেড়শো বছর আগের তৈরি অক্টারলোনি মনুমেন্টের নতুন করে নামকরণ হয় শহীদ মিনার এবং স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়। সেটা উনিশশো উনসত্তর সালে প্রথম বাম যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমলে।
আমাদের লছমী ওখানে মাদারির খেল দেখাত তার পালক বাবার সাথে। নাঃ, আর ঔৎসুক্য চেপে রাখা রাখা যাচ্ছে না। কিন্তু কিভাবে তিনি আলাপ করবেন? অল্প অল্প করে সময় নিয়ে চুমুক দিচ্ছেন চায়ে।
অযাচিতভাবে সুযোগটা এসে গেল, অবশ্যই ঐ তরফ থেকে।
কদমছাঁট চুলের লোকটা খুব বিনীত ভাবে বলল – বাবু এ শহর কা কোতোয়ালি কিধার হ্যায়?
কোতোয়ালি মানে এরা একটা থানার খোঁজ করছে। এই বড় শহরের আইন কানুন দেখভাল করার জন্য বেশ কয়েকটা থানা নিযুক্ত আছে। এরা ঠিক কোনটার খোঁজ চাইছে? কোনটাতে এদের প্রয়োজন?
– এতনা বড়া নগরমে কোতোয়ালি তো বহুত সারা হ্যায়, অলগ অলগ এলাকামে কোতোয়ালি ভি অলগ অলগ হ্যায়।
এই ভাবেই কথা বার্তা শুরু হল এবং বেশ খানিকটা আলাপচারিতা এগিয়ে গেল। আর ঘটল অদ্ভূৎ এবং কাকতালীয় ব্যাপার। তিনি বুঝতে পারলেন, রোগা এবং পাকানো চেহারার লোকটাই সেই মাদারির খেল দেখানোর ওস্তাদ।
সেদিনের গল্পটাকে ওস্তাদ এই কদমছাঁট চুলের লোকটার কাছে অন্য ভাবে পেশ করেছে। লছমীর ওস্তাদ বা দেখভাল-এর মালিক এই ঘাসিরাম পারিহার, শারীরিক ক্রীড়ায় বিশেষ পারদর্শী। সে জীবিকার প্রয়োজনে আগে সার্কাস পার্টিতে খেলা দেখাত । একদিন সেই সার্কাস পার্টিটা উঠে যায়। পেটের দায়ে সে দেহাতে খেতোয়ালির কাজকর্মে লেগে যায়। এদের বাড়ি বিহারের সাসারাম- এ, রেল স্টেশন থেকে অনেকটা দূরে একটা প্রত্যন্ত গাঁয়ে, রুক্ষ সুক্ষ্ম জায়গায়। সেখানে না হয় চাষ ভাল , না আছে অন্য কোন জীবন ধারনের উপায়। ঘাসিরাম নিজের জমির সাথে চাষ আবাদি করত এই দুখিরাম দুবে-জীর কিছু পতিত জায়গা। চাষ আবাদের জন্যই দুবেজী অল্প পয়সায় তাকে লিজে দিয়ে রেখেছিল । দুবেজীর অনেকগুলি ভৈঁস ও অন্যান্য অনেক ব্যবসা আছে।
ঘাসিরামকে দুবেজী বিশ্বাস করত। তবে নিমক হারাম ঘাসিরাম সেই বিশ্বাসের যথাযথ মর্যাদা দেয়নি। আসলে দুবেজির ছোট ঘরওয়ালীর সাথে এই সার্কাসের খেলোয়াড়ের কিছু গভীরতর সম্পর্ক হয় এবং একদিন পাঁচ বছরের কন্যা সন্তান সমেত তারা বেপাত্তা হয়ে যায়।
দুবেজীর নানান কারবার, তার অনেক ঝামেলা। আর অনেক ঝামেলার মধ্যে এই ক্ষুদ্র ঘটনা দুবেজীর মনে কিছু হেল দোল ঘটাতে পারেনি।
মানুষটাই বোধহয় একটু নির্লিপ্ত এই সামাজিক ও সাংসারিক ব্যাপারে। কারবার ও কামাই তার জীবনে আসল ব্যাপার। নয় নয় করে পাঁচ ছয় বছর হয়ে গেলো সেই নিরুদ্দেশের। থানা পুলিশ হয়েছিল । থানার লোকজন বিশেষ পাত্তা দেয়নি। এই ধরনের ঘটনা তাদের দেহাতে হামেশাই ঘটে। অত ধ্যান দিতে গেলে থানা পুলিশের চলে না।
দুবেজীকে ঘাসিরাম বলে বুঝিয়েছে, তাও বছর চারেক বাদে ফিরে গিয়ে যে তার দ্বিতীয় স্ত্রী মারা গেছে কিন্তু লেড়কি গায়েব হয়ে গেছে।
লেড়কির শোকটাই দুবেজীকে ধাক্কা দিয়েছে। দুবেজীর আগের পক্ষের সন্তান দু’টি সন্তানই ছেলে। তারা বড় হয়ে ব্যবসা সামলাচ্ছে। কিন্তু লছমী বেটিয়া তার এক মাত্র মেয়ে।
সুধাংশু প্রমাদ গুনলেন। তাঁর কি করণীয় বুঝতে পারলেন না।
– ঘাসিরাম আপ তো শহীদ মিনার যো হ্যায় উহ পহেচান্তা হ্যায় না?
– হ্যাঁ জি, হাম তো ওহি পর খেল দেখাতে থে। লেকিন….।
– লেকিন কেয়া। তুম সাহি বাত বতাও। তুম তো বড়া মাষ্টর হো।লেকিন তুম ঝুট বতাতা হ্যায়। তুম জান বুঝকে উস লেড়কিকো ছোড় দে কে চলা গিয়া থা ।
ঘাসিরাম এই ধরনের পাঞ্চ আশা করেনি।
সাময়িক বিহ্বলতার পরেই সেই প্রাক্তন ট্রাপিজের খেলা দেখানো ঘাসিরাম, দুবেজীর পায়ে পড়ে একবারে পাকা অভিনেতার আদলে হাউ মাউ করে কিছু বলল। যার কোন শব্দই সুধাংশুর বোধগম্য হল না।
তিনি শুধু দেখলেন আশপাশে কিছু উৎসুখ মুখের ভিড় জমে গেছে। চা ওয়ালাকে পয়সা মিটিয়ে দিয়ে বললেন।
– চলিয়ে দুবেজী, পহেলে তো ওহি মিনারকে পাশ যানা চাহিয়ে।
তারা কোন কথা মুখ থেকে বার করল না। সুধাংশুর পিছু পিছু নদীর পাড় ছেড়ে বাস রাস্তায় চলে এল। তার পর ফোর্ট উইলিয়ামের পাশ দিয়ে তিন জনে শেষ বিকেলের অনুজ্জ্বল আলোতে শহরের প্রাণকেন্দ্র ধর্মতলার দিকে এগিয়ে চলল।
সুধাংশু অফিসের ক্লাবে নাটক করেন এবং ভালোই করেন। সবাই প্রশংসা করে তাঁর অভিনয়ের। তাঁর হঠাৎ অভিনয় করার শখ হল । আসলে তিনি যে একটা বড় নাটকের চরিত্র হয়ে গেছেন। অন্ততঃ এক বছর আগে থেকে । কুশীলব অন্য আরো কয়েকজন থাকলেও তিনিই নটপ্রধান যার মুখে এই নাটকের যবনিকা উত্তোলনের সাথে সাথে প্রথম ‘সার্চ লাইটের’ আলোটা এসে পড়ে। নবতম সংযোজন এই ঘাসিরাম ও দুবেজী। নটদ্বয় এই মুহুর্তে মঞ্চের সিঁড়িতে পদার্পণ করেছে ।
শহীদ মিনারের নীচে আসার পর ঘাসিরামের মুখে অদ্ভুত একটা পরিবর্তন এল । এই পরিবর্তন প্রমাণ করে দেয় সে সেই কু-নাট্যের সাথে একান্ত ভাবে জড়িয়ে আছে।
সেই পরিচিত চা ওয়ালা হাতে কেটলি নিয়ে এগিয়ে এল । তিনি আদা এবং মশালা চা দিতে বললেন। চা দিয়ে সে পয়সা চাইল।
– তুই একটু ঘুরে আয় আমি দিচ্ছি। পালাব না।
– বাবু কি যে বলেন, আপনি কত পুরোন খরিদ্দার।
– তুই আমাকে চিনিস? আরো একজনকে চেনাবো তোকে। একটু ঘুরে আয়।
আড় চোখে ঘাসিরামের দিকে তাকালেন সুধাংশু, সে মাথা নিচু করে অত্যন্ত আড়ষ্টতার সাথে শব্দ করে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। নাটকের শুরুটা এখনই করতে হবে। না হলে দেরি হয়ে যাচ্ছে। রাত বেশি হলে রাস্তায় জ্যাম শুরু হয়ে যাবে। বাড়ি পৌঁছতে দেরি হয়ে যাবে। আজ লছমি তার বড়দাদাকে তাড়াতাড়ি ফিরতে বলেছে। কারণ সে তার মাইয়া-জীকে নিয়ে ডাক্তারের চেম্বারে যাবে।
– দুবেজী, আপ বতাইয়ে.. তারপর ভাঙা হিন্দি বাংলা মিলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন যে পাঁচ বছরের মেয়েটাকে দেখলেও কি তিনি চিনতে পারবেন?
– না বাবু গুড়িয়া পাঁচ বছরের ছিল যবে তখন এই হারামি ওর মাকে আর ওকে নিয়ে ভেগে যায়। ওর মা একটু ছিটিয়াল ছিল লেকিন গুড়িয়া খুব খুবসুরৎ আর মিঠা ছিল । পুরা লছমী মাইয়া য্যায়সা।
– লেকিন ও তো আভি দশ গারো সাল কি হো গি না। কি করে চিনবেন?
– বাবু, উসকি ফেস কাটিং উসকি মা কি পুরা কপি থা। আউর এক ভি নিশানা থা।
– বতাইয়ে দুবেজী?
তাঁর মাথায় কি নাটক চেপেছে আজ, কে জানে? পকেট থেকে পোষ্টাল ডিপার্টমেন্টের আই কার্ডখানা বার করে দুজনের সামনে ধরলেন।
– দেখো ইধার দেখো, সবসা নাজদিক যো কোতয়ালি হ্যায়, ম্যায় উঁহাকা অফসার হুঁ। ঐ যে রাস্তা পেরিয়ে নিউ মার্কেট ওখানে আমার থানা। আর এটা আমার এরিয়া।
মিথ্যে বললেন সুধাংশু- দুবেজী বতাইয়ে কেয়া পহেচান হ্যায়?
দুবেজী যা বলল, ওর মা একটা রুপোর কানের দুল বাঁ কানে বিঁধিয়ে দিয়ে দেয়। যেটা না কাটলে খোলা যাবে না। সেই দুলটাতে হিন্দিতে, মানে দেবনাগরীতে ‘ল’ লেখা আছে, লছমীর আদ্যক্ষর।
প্রায় স্তব্ধ হয়ে গেলেন সুধাংশু। আসলে প্রথম যখন লছমী বাড়িতে যায়, তার মা বিভাবতীর চোখে পড়ে কানের অলঙ্কারটা ৷ দুল রহস্যের সাথে জড়িয়ে থাকা এই সত্য উদ্ঘাটনের পর সুধাংশু বুকে একটা কোথাও শুন্যতার আভাস পেলেন ।
চা ওয়ালা ছেলেটা আবার ফিরে এল তাঁদের কাছে।
তিনি চা ওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলেন,- আচ্ছা তোর মনে আছে একটা বাচ্চা মেয়ে মাদারির খেলা দেখাত, ঐ কোণে গড়ের মাঠের দিকটায়।
– হ্যাঁ দাদা এই তো সে দিনের ঘটনা। বাচ্চা মেয়েটাকে দড়ির ওপরে খেলাত ওর বাপ।
– বাপ নয় রে! সে একটা আস্ত শয়তান, তাকে জেলে পুরবো আজ। দেখত এই বদমাশটার মুখের দিকে ভাল করে। চিনতে পারছিস?
চাওয়ালা বেশ মজা পেল , তার গতানুগতিক চা বিক্রির জীবন, নির্দিষ্ঠ চক্রের সীমানার বাইরে ঘটমান এই নাটকে জড়িয়ে পড়ল ।
প্রায় হাত জোড় করে থর থর করে কাঁপছে ঘাসিরাম।- বাবু মাফ করে দিন। আমার ভুল হয়েছিল ।
ঘাসিরামও আগে থাকতে চা ওয়ালাকে চিনতে পেরেছিল। চাওয়ালা ঘাসিরামের মুখের দিকে চেয়ে বিস্মিত হয়ে বলল,- আরে এই তো সেই ওস্তাদ লুচ্চা বদমাশ। মেয়েটাকে ফেলে পালিয়ে যায়। আমি ভেবেছিলাম মেয়েটাকে থানায় হেফাজতে দিয়ে আসব। কিন্তু ফিরে এসে আর তাকে দেখতে পাইনি। আমাকে চাচা বলত আর চা পাঁউরুটি খেতে চাইত। এই হারামি ওস্তাদ পয়সা দিত না। আমিই ওকে এমনি খেতে দিতাম।
– তুই ঘটনাটা হিন্দিতে বল দুজনকে।
সে পূর্বাপর ঘটনার বৃত্তান্ত দুজনকে বলল। দুবেজীর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। ঘাসিরাম প্রায় পাগলের মতো একবার সুধাংশু আর একবার দুবেজীর পায়ে ধরতে লাগল।
– ঠিক আছে তুই যা। চাওয়ালাকে বিদায় করে দিল সুধাংশু।
দুবেজী কলকাতায় এই প্রথম। সবে সকালে নেমে স্টেশনের কাছাকাছি একটা সস্তার হোটেলে উঠেছে।
বিভ্রান্ত সুধাংশু স্বরচিত নাটকের পরের অঙ্কের জট আর কিছুতে খুলতে পারছেন না।
সন্তান শোকে বিহ্বল হলেও দুবেজী ব্যবসায়ী মানুষ। কোন জিনিসে কতটা মুনাফা হয় তিনি জানেন। হঠাৎ সুধাংশুর হাত ধরে তিনি হাই মাউ করে কেঁদে ফেললেন। পারলে পায়ে পড়ে যায়।
– ঠিক আছে, ঠিক আছে। কাঁহা হ্যায় মেরে বেটিয়া, মেরে গুড়িয়া?
সুধাংশু বুঝেছেন সরকারি স্কুল হলেও স্কুলে ভর্তি হতে একটা বাবা চাই, বাবার সই চাই এবং একটা পদবি চাই। লছমীর মানে লক্ষ্মীর স্কুল ভর্তির ব্যাপারে সুধাংশু খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। এবার কি কোন আলোর দিশা দেখতে পেলেন?
– কাস্টডি সমস্তা হ্যায়, উহ আভি চাইল্ড কাস্টডি হোম মে হ্যায়।
– বাবু লেকে চলো। যেতনা পয়সা লাগে হাম দে দেগা।
সন্ধ্যার সময় কলকাতায় ট্যাক্সি জোগাড় করা একটা ভয়ানক কঠিন কাজ। আর তিনি অভিনয় করছেন একজন পুলিশ অফিসারের। ট্যাক্সি তাকে জোগাড় করতেই হবে।
ভাগ্যক্রমে একটা হলুদ ট্যাক্সি পেয়ে গেলেন। হয়ত অনেকটা ভাড়া বেশি, তা হলেও তিনজনে চেপে বসলেন।
– চলো পানিহাটি।
নাটকের শেষাঙ্কের আগের অঙ্কে ঘাসিরামকে আর চিন্তিত মনে হল না। পুলিশের সাথে এই বাবুকে মেলাতেও সে রাজি হয়। ড্রাইভারের পাশে বসে সে ড্রাইরের সাথে একটু খৈনি বেটে নিল । দুবেজীকে ও দিলো।তার স্নায়ু যে বরফের মতো ঠান্ডা সেটা মালুম হল সুধাংশুর।
বাড়ির দরজায় খট খট আওয়াজ করতেই সেই চঞ্চলা লক্ষ্মী এক ছুটে বেরিয়ে এসে দরজায় তাদের দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল ।
অস্ফুটে দুবেজী বলে উঠল,- মেরে গুড়িয়া, মেরে লছমী মাইয়া ।
বড়দাদার পেছনে পেছনে সে মাইজির ঘরে গেল এবং এক ছুটে মাইজির কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল।
তখন রাত এগারোটা বাজে। দুবেজী, ঘাসিরাম খেতে বসেছে। পরিবেশন করছে এ বাড়ির লক্ষ্মী।
দুজনেই বেশ তৃপ্তি করে অনেকগুলো করে রুটি খেল। সব্জি খেল ।
– বড়িয়া খানা, বড়িয়া খানা।
লছমীর দেয়া সব খানাই তার কাছে অমৃত সমান মনে হচ্ছে দুবেজীর। বার বার বলতে লাগল একই প্রশংসাসূচক বাক্য। ঘাসিরাম চুপচাপ। তবে কোন চিন্তার ভাঁজ তার মুখে চোখে নেই। মনে হচ্ছে সে জায়গা পেলেই কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমিয়ে পড়বে।
সুধাংশু দু’দিনের ছুটি নিলেন অফিস থেকে। পরদিন সকাল দশটায় বিভাবতী লক্ষ্মী রানীকে সাজিয়ে দিলেন মাথায় দুই বিনুনী করে। একটা টিপ দিলেন কপালে। নতুন পোশাকে এবং স্কুলের ব্যাগে লক্ষ্মীকে খুব বিজ্ঞ মনে হচ্ছিল। বড়দার হাত ধরে বেরিয়ে পড়ল । পিছু পিছু দুবেজী এবং ঘাসিরাম পারিহার একটু দূরে চললো। লছমি রানী স্কুলে ভর্তি হবে।
কাছাকাছি স্কুল, পৌরসভার অধীনে। আশপাশের কলকারখানা,জুটমিল এবং মিউনিসিপালিটির কর্মচারীদের ছেলেমেয়েরা এই স্কুলে পড়ে। হিন্দি প্রথম ভাষা। হেড মাস্টার নিজের চেয়ারে বসে আছেন। ঘাসিরাম ভিতরে ঢুকল না। দুবেজী নমস্তে করার পর এটা জেনে খুব খুশী হলো যে ‘পরধান শিকছক’ হিন্দি ভাষী। কথায় কথায় জানা গেল তিনি মুঙ্গের জেলার আদি বাসিন্দা। খুব খুশি হলেন তিনিও। দুবেজীকে খুব খাতির করলেন, দেশোয়ালী ভাই বলে ।
লছমীর নাম ঠিকানা লেখা হল। বাবার নাম দুবেজী বেশ গর্বের সঙ্গে বললেন।
বর্তমান ঠিকানা লেখা হলো পানিহাটির। আর লোকাল গার্জেনের নাম দেয়া হলো বিভাবতী বসুর।
সই সাবুদও হল ফর্মে। তারপর লক্ষ্মীর হাত ধরে ক্লাসের দিকে এগিয়ে দিয়ে এলেন সুধাংশু।
ফিরে এসে দরজার বাইরে থেকে দেখতে পেলেন দুবেজী এবং মুঙ্গেরের আদি বাসিন্দা দেশওয়ালী ভাই প্রধান শিক্ষক খুবই খুশি। নিজেদের রসিকতায় নিজেরা খুব হো হো হাসছে।
আনন্দে আতিশয্যে দুবেজী একটিপ খৈনি টিপতে শুরু করেছে।
– উহ তো মেরা বড়া বহীন য্যায়সা। বহুৎ জান পহেচান। মেরা লছমী তো আভি এঁহি রহেগি। আপ উসকি ঠিকসে ধ্যান দেকে পড়হা লিখা ঠিকসে করয়াইয়ে। আগলা মাহিনা মে যব হম আয়েঙ্গে তব এক টিন ঘিউ লেকে আয়েঙ্গে। মেরে ঘর মে বনা হুয়া ভৈঁসা ঘিউ।
এক চিমটি খৈনি তুলে হেড মাস্টারকে দিল দুবেজী এবং নিজে এক টিপ মুখে পুরল।
হাত ঝাড়তে ঝাড়তে দুবেজী মুখ নীচু করে পিক ফেলার চেষ্টা করতেই হেডমাস্টার মশাই হৈ হৈ করে উঠল,-এ্যায়সা মত কিজিয়ে দুবেজী ইয়ে ইস্কুল হ্যায়।
বাইরে থুক ফেলতে এসে দুবেজী সুধাংশুকে দেখে যার পর নাই লজ্জা পেল।
পরদিন বিকেলে হাওড়া স্টেশন থেকে সন্ধ্যায় ফেরার ট্রেন। কোন রকমে সুধাংশু দুটো রিজার্ভ টিকিট জোগাড় করেছেন। যদিও দুবেজী ও ঘাসিরাম বলছিল এসবের কোন দরকার নেই। তারা জেনারেল কোচে ঠিক সওয়ারী হয়ে যাবে।
ওদের ট্রেনে তুলে দিতে এসেছেন সুধাংশু এবং সঙ্গে তাঁর লক্ষ্মী। লক্ষ্মীর হাতে একটা স্টিলের ডিব্বা সে তার আপন কিন্তু প্রায় অপরিচিত পিতার কোলের কাছে নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। সকালে স্কুল থেকে ফিরে এসে সে নিজে হাতে এই পরোটাগুলো বানিয়েছে। ট্রেনে পিতাজী ও ওস্তাদজীর রাতের খাবার। গার্ড পতাকা তুলে হুইসিল বাজিয়ে দিলে। জানালায় যতক্ষণ দুবেজীর মুখ দেখা যায় ততক্ষণ লছমী তাকিয়ে রইল এবং তার রোগা ছোট ছোট হাতটা নাড়তে লাগল। আস্তে আস্তে ট্রেনটা ওভার ব্রিজের নিচের রেল পথের বাঁক পেরিয়ে মিলিয়ে গেল।
(শেষ)