ভালোবাসার জন্য আমি পাহাড় ডিঙাতেও পারব না অথবা একাই ছয়জন ভিলেনকে পিটিয়ে পাট পাট করতে পারব না।
ভালোবাসার জন্য ঝর্ণার জলে ভিজে ভিজে গানও গাইতে পারব না। সে চেষ্টা করলে ভালোবাসা আমার আঠারো হাত দূর দিয়ে পালাবে।
তবু জানি শুধু ভালোবাসার জন্যই আমি বেঁচে আছি। আমার সেই সামান্য ভালোবাসার গপ্পো আমি আপনাদের শোনাতে পারি।
বুধবার সকালে ঘুম ভেঙে যদি দেখি সাতটা বেজে গেছে তাহলে প্রথম যে কথাটি মনে হয় তাহলো, “ যা শালা, এবারে কি হবে।”
কোনো রকমে শক্ত দুটি রুটি রসগোল্লার রস মাখিয়ে গলায় চালান করে স্কুটার বার করলাম। ভগবান আবার বিট্রে করেছে। তেল তলানিতে। কদিন আগেও দুশো টাকার তেলে সপ্তাহ চলে যেত। এখন তিনশ টাকার তেলে পাঁচদিন যাচ্ছে।
পেট্রোল পাম্পে লম্বা লাইন। তেল ভরতে আরও পনের মিনিট নষ্ট। অবশেষে যখন হাসপাতালে পৌছালাম তখন ঘড়ির কাটা প্রায় আটটা ছুঁই ছুঁই।
ছেলেদের ওয়ার্ড দুটো রাউন্ড দিয়ে আউটডোরে বসব। আমার কাজ অনেকটা ঝাড়ুদারের মত। গত চব্বিশ ঘণ্টায় এমারজেন্সি থেকে যত সংখ্যক রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, আমার কাজ প্রায় সম সংখ্যক অপেক্ষাকৃত সুস্থ্য রোগীকে ছুটি দিয়ে বাড়ি পাঠানো।
এই একটি চরম একঘেঁয়ে ভারসাম্য রক্ষার কাজ আমি নিষ্ঠা ভরে করে যাচ্ছি দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। এবং যত দিন যাচ্ছে তত আমি ঝাড়ুদারের কাজে আরও বেশী পারদর্শী হয়ে উঠছি।
যাই হোক, নিজের ঢাক পেটানোর জন্য আমি এটা লিখতে বসিনি। আর আমি ভালো ঝাঁট দি, নাকি ভালো বাসন কোসন মাজি, সেসব জানার ইচ্ছেও আপনাদের থাকার কথা নয়। আমি বরঞ্চ সরাসরি গল্পে চলে যাই।
ঘেমে নেয়ে মেল ওয়ার্ড দুটি রাউন্ড দিয়ে ছুটলাম আউটডোরের দিকে। সাড়ে নটা বেজে গেছে।
মেডিসিন আউটডোরে থিক থিক করছে ভিড়। টিকিটের লাইন হাসপাতালের সীমানা ছাড়িয়ে রাস্তায় চলে গেছে। আমি এদিক ওদিক না তাকিয়ে মাথা নিচু করে রোগী দেখা শুরু করলাম।
ঝড়ের বেগে রোগী দেখছি, কিন্তু মনের মধ্যে একটু খচ খচ করছে। হঠাৎ মনে পড়ল, কাল অনেক রাতে মিন্টু ফোন করেছিল, “ডাক্তারবাবু, প্রবীরদা আর নেই। আজ সন্ধ্যেয় মেডিকেলে মারা গেছে।”
প্রবীরদা একজন মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টিভ বা সংক্ষেপে এমআর।
ডাক্তার একজন এমআর কে নিয়ে লিখছে মানেই ঘাপলা আছে। নির্ঘাৎ বিদেশ অথবা অন্তত উটি-কোয়াম্বাতুর ঘুরে এসেছে ওই ওষুধ কোম্পানীর পয়সায়। এরকম ভেবে আপনারা যদি মানসিক শান্তি পেতে চান, আমি নাচার। কিন্তু আমার ভালোবাসার গল্পের প্রথম পাত্র প্রবীরদা।
প্রতিটি দূর্গা পুজোয় আমার ডিউটির সময়ে প্রতিদিন হাসপাতালে এসে বসে থেকেছে। আমি বারবার বলেছি, “পুজোয় কেন শুধু মুধু হাসপাতালে বসে থাকবে?”
প্রবীরদা শুধু হাসত। মুখে কিছু বলত না। আসলেই প্রবীরদা কথা বলত খুব কম আর হাসত বেশী। মাঝে মাঝেই ব্যাগ থেকে বের করত, না কোনো দামী উপহার বা ক্যাশ টাকা নয়, দুটাকা দামের অগ্নি জেল পেন।
আমরা প্রবীরদার কাছ থেকে সেই পেন নিতাম। একে আপনারা উপঢৌকন বা ঘুষ যা ইচ্ছে বলতে পারেন।
হাসপাতালে ততদিনে ন্যায্য মূল্যের দোকান চালু হয়েছে। সব ডাক্তারবাবুরাই জেনেরিক নামে ওষুধ লিখছেন। অন্যান্য এমআর’রা মুখ কাঁচুমাচু করে ঘুরছে। ব্যবসা পত্তর লাটে উঠেছে। চাকরি নিয়ে টানাটানি চলছে। শুধু প্রবীরদার মুখেই হাসি।
আমি বাইরে প্র্যাকটিস করতাম। প্রবীরদার দু একটা প্রোডাক্ট লিখে দিতাম। এভাবেই চলছিল। হঠাৎ করে বাপ্পাদার মুখে শুনলাম, প্রবীরদার নন হজকিন্স লিম্ফোমা নামক একটি ক্যানসার ধরা পড়েছে। অবস্থা খুব খারাপ।
বাপ্পাদাও একজন এমআর। তাঁর কাছ থেকেই প্রবীরদার শারীরিক অবস্থার আপডেট পেতাম। একদিন সকালে হাসপাতালে গিয়ে দেখলাম বাপ্পাদা ডক্টর রুমের সামনে উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
বলল, “কাল রাত থেকে প্রবীরের খিঁচুনি হচ্ছে। হাসপাতালে ভর্তি করেছি।”
সে যাত্রায় প্রবীরদাকে একটু সুস্থ করে মেডিক্যাল কলেজে অঙ্কোলজিতে পাঠানো হোল। কিন্তু শেষরক্ষা হোল না।
আমার ভালোবাসার গপ্পোর দ্বিতীয় চরিত্র বাপ্পাদাই। প্রবীরদা যখন অসুস্থ, বাপ্পাদা আমার কাছে আসত। বলত, “আমার প্রোডাক্ট লিখতে হবে না। আপনি যদি পারেন প্রবীরের দু চারটে ওষুধ লিখে দেন। এখনও ওর ছেলে দুটো ছোট। মিসেস কিছু করেন না। ভগবান জানে ওদের কি হবে।”
এমন বন্ধুত্ব, এমন ভালোবাসা আমি খুব কম দেখেছি। বিশেষ করে এমআর এর চাকরির মত একটি ভয়ংকর টার্গেট ওরিয়েন্টেড চাকরিতে নিজের ক্ষতি করে বন্ধুকে সাহায্য করার মানসিকতা খুব কম জনের থাকে।
ও হ্যাঁ, বাপ্পাদাও আমায় গিফট দেয়। কাজের সুত্রে বাপ্পাদা মাঝে মাঝেই উত্তরবঙ্গ যায়। সেখান থেকে আমার জন্য দার্জিলিং টি নিয়ে আসে। এটাকেও আপনারা যা খুশি বলতে পারেন। কিন্তু উপহারটা আমায় বেশ ভালই লাগে।
আমি একজন চা’তাল। সারাদিনে জলের চেয়ে চা বেশী খাই। হাসপাতালে নারানদা আমার চায়ের জোগান বজায় রাখার দায়িত্ব নিয়েছে। নারানদাকে নিয়ে পরে লিখতে হবে।
আপাতত রাজীবের কথা দিয়ে শেষ করি। রাজীব এক বেসরকারি কলেজ থেকে ফার্মাসী পাশ করে আমাদের হাসপাতালে ইনট্রানশিপ করতে এসেছিল। তখন থেকেই আমার সাথে কি করে জমে গেল, ভগবান জানে।
আউটডোরে আমার সাথে থাকে। প্রেশার মেপে দেয়। ওষুধের স্লিপ বানিয়ে দেয়। রোগীদের ওষুধ কিভাবে খেতে হয় তাও বুঝিয়ে দেয়।
রাজীবের ইনটার্নশিপ অনেকদিন শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো আমার আউটডোরে ও হাজির হবেই। কিসের টানে কে জানে? আমার জন্য নাকি রোগীদের জন্য টান? তবে কোনও গোপন স্বার্থ জড়িত নেই এটুকু বলতে পারি। রাজীব সাহায্য না করলে মেডিসিনে আউটডোর পিছু চারশ রোগী দেখা আমার একার পক্ষে অসম্ভব ছিল।
দুশো রোগী দেখার পর থেকেই আমার মাথা গরম হতে শুরু করে। রোগীরা সামান্য গণ্ডগোল করলেই ঝাড় খায়। রাজীব কিন্তু তখনও হাসিমুখে বুঝিয়ে চলে, “বুঝলে দাদু এই কালো রঙের ট্যাবলেটটা সকালে আর রাত্রে খাবে। আর এই ছোট্ট বড়িটা রাত্রে খাওয়ার পর।”
এই বুধবার দেখি এক বুড়ি খবরের কাগজে মোড়া কি একটা রাজীবের হাতে গুঁজে দিচ্ছে। বলছে, “পুজো দিয়েছিলাম, প্রসাদ আছে। আর বাড়ির একটা বেল আছে। খেও।”
আমি তাকিয়ে আছি দেখে রাজীব বলল, “ডাক্তারবাবুরটা কই বুড়িমা?”
ময়লা কাপড় পরা খুনখুনে বুড়িটা অম্লানবদনে বলে দিল, “তুমি ভালোবেসে দুটো কথা বল। আর ঐ ডাক্তার বড় খ্যাঁক খ্যাঁক করে বাপু। অমন খেঁকুড়ে মানুষকে আমার ভগবানের প্রসাদ খাওয়ানোর ইচ্ছা নাই।”
তারপর থেকেই খ্যাঁক খ্যাঁক একটু কম করার চেষ্টা করছি।
দারুন।