— স্যার, আপনিও খুলুন আমিও খুলছি।
চমকে উঠেছে অনিমেষ। চেম্বারে উল্টোদিকে বসা পেসেন্ট যে এমন একটা কথা বলবে অনিমেষ ভাবতেও পারেনি। অমন যে চিড়বিড়ে অ্যাসিস্টান্ট নয়না তারও চোখ গোলাকার।
একটু খুলে বলছি স্যার, –সাথে আসা ঝকঝকে তরুণ সাথী সরব। (কাঞ্চন-শোভিত এ রাজ্যে স্বামী না বলে সাথী বলাই ভাল)।
রক্তিম অনিমেষ চুপচাপ।
স্যার, প্রেগনেন্সীর শুরু থেকে আপনার কাছে এই নিয়ে প্রায় ছ’বার এলাম, একবারও আপনাকে দেখতে পেলাম না।
অনিমেষ একটু ধাতস্থ হয়েছে ।
পিয়ালি ততক্ষণে বলতে শুরু করেছে, কাল স্যার আপনি আমার সিজার করবেন আর আমি আপনাকে চিনলামই না। আর সত্যি কথা বলতে, আপনিও আমায় চেনেন না। পুরো মুখ না দেখলে কি চেনা যায়।
ঠিক কথা। মাথা, মুখ, নাক, ঠোঁট ঢাকা থাকলে শুধু চোখ দেখে মহিলাদের চিনে রাখার বয়েস অনিমেষ অনেক দিনই পেরিয়ে এসেছে।
–হ্যাঁ মা, এটা তুমি ঠিকই বলেছ। ইদানীং পেসেন্টদের চিনতে পারছি না বটে। সেদিন নার্সিং হোমে একটা পেসেন্ট দেখার সময়, সিস্টার দিদিমণি ছুটে এলেন, স্যার এটা তালুকদার স্যারের পেসেন্ট,আপনার নয়। আপনার পেসেন্ট ঐ দিকে।
আগে তো এমন হতো না। অল্প গুটিকয় পেসেন্টকে নামেও যেমন চিনতো, ওয়ার্ডে দশটা পেসেন্টের মাঝে তাকে খুঁজে পেতে কোনোই অসুবিধে হতো না।
-নাও নাও, শুভ দৃষ্টিটা তাহলে হয়েই যাক দাদু, –নয়নার ফিচকেমি যথারীতি।
অনিমেষ কিন্তু ভেবে চলেছে — শুধু কী আজকের মহামারী আর মুখঢাকা অবস্থা। পেসেন্ট ডাক্তার চেনাচেনির গল্প তো কোন কালেই শেষ হয়ে গেছে।
ডাক্তারি জীবনের গোড়ার দিকের একটা মজার কথা মনে পড়ে গেল। এক ডেন্টিস্ট বন্ধু এক মজার কথা বলেছিল। –তোদের কি মজা।তোরা এম. টি. পি. (অ্যাবরসন) করিস আর টেবিল থেকে উঠেই পেসেন্ট তোদের ভুলে যায়। একটু আধটু ব্লিডিং হলেও রা কাড়ে না।
আর আমি শালা একটা দাঁত তুললাম আর বিয়েবাড়িতে চিকেন তন্দুরিতে কামড় দিতে যাব, –এই যে ডাক্তার, তোমাকেই খুঁজছিলাম। কী দাঁত তুললে যে তার পর থেকেই একটু একটু ব্লিডিং হয়েই চলেছে। ওনার প্লেটে তন্দুরির ঠ্যাংটা কিন্তু অর্দ্ধভুক্ত অবস্থায়, শেষ পরিণতির অপেক্ষায়।
অবশেষে ঢাকনাবিহীন মুখদর্শন হলো। এবার আবার এক চমক। –এক মিনিট স্যার, দ্রুত অঙ্গুলি সঞ্চালনে স্মার্ট ফোন একটা ছবিতে স্থির হলো ।এবং ছবিটি অনিমেষের। — স্যার, একটু মিলিয়ে নিলাম। আমার এক বান্ধবীর আপনার কাছে ডেলিভারি হয়েছে, তার রেফারেন্সেই আসা। সে রোজই জিজ্ঞেস করে, স্যারের সাথে দেখা হয়েছে? আজ বলতে পারব — হ্যাঁ দেখা হয়েছে, চেনা হয়েছে। ছবিটা ঐ পাঠিয়েছে।
চেনা হয়েছে কথাটা খট করে অনিমেষের কানে লাগল। সত্যিই কি পেসেন্টরা এখন ডাক্তারকে চেনে? কিন্তু একসময় তো চিনত। কত বছরই বা আগের কথা। বছর পনেরো-কুড়ি হবে। মফস্বলের এক হাসপাতালের অপারেশন ঘর। অপারেশন টেবিলে লাইগেশন অপারেশন। রুগীর কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট ও মৃত্যু। সমস্ত হাসপাতালে দমবন্ধ করা অবস্থা। অনিমেষের আহ্বানে সব ডিপার্টমেন্টের ডাক্তাররা ওটিতে হাজির। ফিসফিসানি উঠেছিল পুলিশে খবর দেবার, কেউ কেউ রাজনৈতিক নেতাদের কথাও বলেছিল। কিন্তু ডাক্তাররা ঠিক করেছিল আমরা এতোদিন এখানে কাজ করছি, আমরাই ফেস করব। ততক্ষণে ভিজিটিং আওয়ার্স শুরু হয়ে গেছে। এই সময়ে আগুনের মতো খবর ছড়িয়ে গণ্ডগোলটা শুরু হয় হয়।
সমস্ত ডাক্তার সেদিন ওটি সংলগ্ন ঘরে বসার পর পেসেন্টের বাড়ির লোকদের ডেকে পাঠানো হলো। বলা বাহুল্য বাড়ির লোকের চেয়ে সাথীর সংখ্যা অনেক বেশি। ঘটনাক্রম ও পরিণতি জানানো হলো। খানিক স্তব্ধতার পর গুঞ্জন উঠলো। অনেক প্রশ্ন, অনেক জিজ্ঞাসা, অনেক কর্কশ কন্ঠ।
উত্তর একটাই, –আমরা চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু পারি নি।
আস্তে আস্তে অনেকে আমাদের চিনতে শুরু করলেন।
অর্থোপেডিক ডা সোমের দিকে তাকিয়ে একজন বললেন, আপনি স্যার ছিলেন? আমার মার ঐ রকম ভাঙা পা কত বড় অপারেশন করে ঠিক করেছিলেন।
ওপাশে তখন কেউ কেউ মেডিসিনের মহাপাত্র স্যার কে ঘিরে ধরেছে, -স্যার, আপনি থাকতেও কিছু করা গেল না?
কি আর করা যাবে আমাদের ডাক্তারবাবুরা চেষ্টা করেছেন। সবই নসীব।— হ্যাঁ, এমন কথাও শোনা গেল।
অনিমেষের কেন জানি না মনে হয়, তখনও রুগী ডাক্তারবাবুকে চিনত।
এদিকে নয়না ততক্ষণে পেসেন্টকে মোক্ষম প্রশ্নটা করে ফেলেছে, ম্যাডাম আপনি যে বললেন আপনি আমার স্যারকে চিনলেন, তা কতটুকু চেনেন? উনি কাউকে মেরে ফেলতে পারেন বিশ্বাস করেন?
ততক্ষণে মাস্ক যথাস্থানে। রুগীর অভিব্যক্তি বোঝা গেল না।
অনিমেষের মনে হলো, এ কোভিড মহামারীর অনেক আগেই অবিশ্বাসের এক মহামারী ডাক্তার আর রুগীর মাঝে অচেনার মাস্ক হয়ে এঁটে বসেছে। মহামারী একদিন সরে যাবে কিন্তু আদৌ কি রুগী আর ডাক্তারের মাঝের আবরণ সরবে? স্বার্থ তো অনেকের।