শহর থেকে একটু দূরে এক আধা শহরে অনেক বছর ধরে প্র্যাকটিস করতে যাই। চাকরিতেও আমার প্র্যাকটিসিং পোস্ট ছিল। ডিউটি অনুযায়ী চেম্বারের সময় বদল হত। চাকরি ছাড়ার পর, গত দশ বছর ধরে এক শিডিউল।
তা সেই আধা শহরে যে চেম্বারে বসি –আদ্যিকালের ঘর। একটু অভাবী মানুষ আসে। যাতায়াতের ধকলে না পোষালেও ছাড়তে পারিনা -বহুবছরের রুটিন।
একদিকের দেয়ালের অনেক উঁচুতে একটা ছোট চৌখুপি– না জানলা না ঘুলঘুলি। দেয়ালের ওপাশে কি আছে দেখা জানার উপায় নেই। সম্ভবতঃ একটু সরু গলি ছেড়ে কারো বাড়ি। চৌখুপি দিয়ে একটা অ্যাসবেস্টসের ছাদ আর এক ফুট মতো রঙচটা দেয়াল দেখা যায়। এদিকের সঙ্গে তার কোন যোগাযোগ নেই।
কিন্তু বাতাস তো আসে। ওই ছোট্ট ফোকর দিয়ে বাতাস কখনো আনে ডাল সম্বরার গন্ধ, কখনো রসুন ফোড়ন দিয়ে কিছু রান্না হয় —বোধহয় শাক ভাজা। কোনদিন আলু ভাজা। কালে ভদ্রে মাংস কষার গন্ধ। শিলনোড়াতে মশলা বাটা হয় –বোধহয় পোস্ত। সর্ষেও হতে পারে। কোনদিন আটার রুটি সেঁকার সুবাস। রান্নার শব্দ গন্ধে বোঝা যায় সংসারে একটা প্রাণ আছে। একটা সুন্দর ছিরিছাঁদয়ালা নিম্নবিত্ত পরিবার।
ক্যাসেট প্লেয়ারে পুরোনো আধুনিক গান বাজে –মায়াবতী মেঘে এল তন্দ্রা, এই রাত তোমার আমার —
আর আসে কিছু টুকরো কথাবার্তা।। রাস্তার এমন বিন্যাস যে এদিক আর ওদিক কানা গলি –দেখাসাক্ষাৎ , যোগাযোগের কোন উপায় নেই।
খ্যানখেনে এক মহিলা গলা বলে–বাবু, ছাতাটা নিলি? খুব রোদ কিন্তু।
–বাবু, এক প্যাকেট মুড়ি আনিস।
–বাবু, আর একটা চপ নিবি?
–বাবু, ফের জুতো পায়ে ঘরে ঢুকেছিস -কত রাজ্যের ধুলো আনলি
–বাবু, দুটো মিষ্টি আনিস তো, ঠাকুরকে দেবো আজ লক্ষ্মীবার —
–বাবু, তোর বাবার প্রেসারের ওষুধ ফুরিয়ে গেছে কাল বললাম না -কবে আনবি?
রোগী দেখি। ডান কানটা বন্ধ রাখার চেষ্টা করি। কিন্তু কোনো এক ‘বাবু’-কে ঘিরে এক মহিলার যে সংসার চক্র আবর্তিত হয়, তার ছিটেফোঁটা কর্ণকুহরে প্রবেশ করবেই। চেম্বারের পুরোনো ফ্যানের একটানা ঘড়ঘড়ে আওয়াজের মতো এসব কথা শুধু অর্থহীন শব্দ হয়েই আমার কানে ঢোকে।
–বাবু, অফিস থেকে ফেরার পথে মণিমামার বাড়ি হয়ে আসিস কিন্তু মনে করিয়ে দিলাম।
রোগী দেখি। ওহ–তার মানে বাবু চাকরি করে কিছু একটা।
–বাবু, পরোটা আলুভাজা দিয়েছি টিফিনে। চাউমিন রোল ওসব ছাইপাঁশ খাস না।
–বাবু, ছাতা নিলি -মেঘ আছে আকাশে। বৃষ্টি হবে। আজ নতুন তাঁতটা ভাঙলি? সিন্থেটিক শাড়ি পরলেই পারতিস —
আমার হাতের কলম থমকে যায়! এতদিন মনে ‘বাবু’ এক শার্ট প্যান্ট পরা যুবক ছিল –ঝট করে তাকে তাঁতের শাড়িতে কল্পনা করা মুশকিল।
বাবু বেরিয়ে গেল নিশ্চই। ওদিকে চুপচাপ। আমিও পরে ভাবব। রোগী দেখি।
–বাবু, আজ কি অফিস না গেলেই হত না, বিকেলে ওরা দেখতে আসবে -যদি তার মধ্যে ফিরতে না পারিস
–ফিরতে পারব না, ইন ফ্যাক্ট ফিরব না। আমি তো বার বার বলেছি, ওদের আসতে বারণ করে দাও —
এই প্রথম খ্যানখেনে গলার এপারে এক তরুণ তেজী গলা শুনলাম। আর ‘বারণ করে দাও’ এর পেছনে একটা গল্পও সলতে পাকাচ্ছে।
তারপর কি যে হল কে জানে। সব চুপচাপ। মেয়েটার কি কোনো প্রেমিক ছিল? আমি তো সপ্তাহে একদিন যাই, গল্পের পুরোটা পড়ার সুযোগ নেই –ছোটবেলার কাগজের ঠোঙাতে পাওয়া গল্পের মতো।
অনেকদিন কোনো সাড়াশব্দ নেই। আমিও ঘাড় গুঁজে প্রেসক্রিপশন লিখি -‘-বাবু’ কে দেখতে আসার কথা ভুলে যাই।
হঠাৎ একদিন পাশের গলিতে লোকজন, হাসি গল্প, হৈ চৈ শুনি। নতুন কাপড়ের খসখস, গয়নার টুংটাং। উলু, শাঁখ, চন্দনগন্ধ। ‘এই তত্ত্বে কি এল –দেখ দেখ’ এসব উড়ো বাক্য। তাহলে কি ‘বাবু’ র বিয়ে লাগল? কার সঙ্গে? প্রেমিক না ‘তাকে দেখতে আসা’ সেই পাত্র? উদাসীন থাকতে চাই। অথচ একটা পরকীয়া আকর্ষণে কানটা ওদিকে থাকে। বিয়ের পর বাবু কি চাকরি করছে? সুখে আছে না দুঃখে?
ক্লু আছে তেমন কোনো শব্দ, বাক্য আসে না।
কয়েক বছর কেটে যায়। একদিন খেয়াল হল সেই খ্যানখেনে গলাও তো আর শুনি না। মেয়ে শ্বশুরবাড়ি থাকে বলে হয়তো কথা বলার লোক নেই।
শুধু সেই চেনা ডাল ফোড়নের গন্ধটা একইরকম ভাসে বাতাসে।
একদিন গলি জুড়ে অন্যরকম শব্দের ঘোরাফেরা –কয়েকজন ছেলে ছোকরার গলা । “অ্যাম্বুলেন্স এসে গেছে । স্ট্রেচারটা ধর ভালো করে । মাথার নীচে একটা বালিশ দে , গলাটা কেমন ঘড়ঘড় করছে, অক্সিজেন পেলে বেঁচে যাবে মনে হয় ” –এই সব আমাদের চেনা বাক্যবন্ধ । কার শরীর খারাপ হল ?
এখনো কি সেই বাবুর মা-ই থাকে ওই বাড়িতে ? নাকি অন্য কেউ ?
দিন যায় মাস যায়। ফি বিষ্যুদবার ওখানে যাই। রোগী দেখি। দেয়ালের ফোকর দিয়ে মশা মাছি আসে। কিন্তু, ওদিক থেকে ডাল সম্বরার গন্ধ আর আসে না। কার অসুখ করল –সে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরল কিনা আর জানা হয় না।
কতগুলো বছর গেল দেয়ালের ঘুলঘুলি জানে। এখন একটা বাচ্চার কান্না শুনি রোজ। দুঃখশোকের কান্না নয় –পৃথিবীর সঙ্গে প্রথম আধো পরিচয়ের কান্না। কার আবার খোকা হল? এখন কারা থাকে —
এখন প্রেসার কুকারে সিটি বাজে মাঝে মাঝে। শিলনোড়ার শব্দ শুনিনা আর। দ্বিতীয়, তৃতীয় ইন্দ্রিয় তৃষিত হয়ে থাকে কোনো শব্দ, ফোড়নের গন্ধের জন্য। নাহ –কোনো গন্ধ আসে না। ওরা কি রোজ ভাতে ভাত খায় বা ওটস, ডালিয়া!
দরজা বন্ধ খোলা, চেয়ার টানাটানি–এই সব ধাতব শব্দ ইশারায় একটা পার্শ্ববর্তী গৃহস্থালী যাপনের অস্তিত্ব ঘোষণা করে।
দুই তিনজন মহিলা গলার মামুলি কথা শুনি।
কবে যেন কচি গলা কথা বলে। রাইমস শোনা যায়–হাম্পতি দাম্পতি ছ্যাত অন আ ওয়াল –ভেসে আসে,
কিন্তু অদেখার দেয়াল সরে না। একদিন এল একটা কমবয়সী বউ তার ছেলেকে দেখাতে। সস্তার স্লিভলেস টপ আর লেগিংস। তিন বছরের ছেলের হাত ধরে যাওয়ার সময় গলা চড়িয়ে বলল–আমরা কিন্তু ওই গলির ওই ঘরটায় থাকি ভিজিট কম নেবেন।
আচ্ছা সে হবেখন। ব্যস্তসমস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম –বাবুকে চিনতে? ওই বাড়িতে একটা মেয়ে থাকত? আচ্ছা কার অসুখ করেছিল ও বাড়িতে?
বৌটি কিছু বুঝতে পারে না।
আমি মরিয়া হয়ে বলি –এই ধর পঁচানব্বুই ছিয়ানব্বুই সালে ও বাড়িতে যারা থাকত, চিনতে?
বৌটি হাত উল্টে মুখ বেঁকিয়ে বলে –আমরা তো বিয়ের পর মোটে চার বছর হল ভাড়া এসেছি। আমি জন্মেছিই তো দু’হাজার সালে।
বাবুর খবর কোনদিন আর পাব না বুঝে যাই। হতাশ লাগে।
–আচ্ছা তোমরা ডাল সম্বরা দাও না? কোন রান্নার গন্ধ পাই না তো।
টেরা ব্যাঁকা চাউনি হেনে বৌটি বলে –রান্নাঘরে বাপু ঢুকি না আমি –যা আরশোলা! হোম প্যাক খাই।
ওহ! আচ্ছা।
বৌটি চলে যায়।
হঠাৎ উপলব্ধি হল –আমি যেন সেই ‘রিপ ভ্যান উইনকিল’ — একই জায়গায় ঘাড় গুঁজে বসে রোগী দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে আছি –চৌত্রিশ বছর!