‘তবে যে ওরা বলল- আপনি ওদের ছাত্র!’
‘ঠিক-ই বলেছে।’
‘মানে, ওরা তো আপনার চেয়ে বয়েসে অনেক ছোট মনে হল।’
আমার চেম্বারে উল্টোদিকের চেয়ারে বসে খুব অবাক হয়ে বললেন বয়স্ক ভদ্রলোক। তিনি রোগী নন। বাড়ির লোক। যুবক রোগী তখন তার পাশে দাঁড়িয়ে বাধ্য ছাত্রের মত আমার দেখিয়ে দেওয়া কব্জির ব্যয়াম করে চলেছে।
আমি বললাম, ‘দেখুন, আমি সবার ছাত্র। যতদিন বাঁচব, ততদিন শিখব। আর যতদিন শিখব, ততদিন-ই ছাত্র। আমার সমস্ত রোগী আসলে আমার শিক্ষক। প্রতিটা রোগ, প্রতিটা ফ্র্যাকচার, প্রতিটা অপারেশন আমাকে নতুন কিছু শিখিয়ে যায়।’
এই রোগীর বাড়ির লোক দুদিন আগে আমার সহকারীদের ফোন করে মাথা খারাপ করে দিয়েছে। আমাকে পায় নি। আমি বিদেশে ছিলাম।
মাস দুয়েক আগে দুর্ঘটনায় কব্জি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়ায় অপারেশন করে দিয়েছিলাম। তবে সরকারি স্কীমে। বিনামূল্যে। সরকার নির্ধারিত প্লেট-স্ক্রু দিয়েই। স্বভাবতঃই সেরা মানের যন্ত্রপাতি দেওয়া যায় নি। আপস করতে হয়েছে। কিন্তু এরা বেশ গরীব। কিছু করার নেই। এদের বাড়ির আরো দুজন আমার রোগী। আমি এদের আর্থিক অবস্থা মোটামুটি জানি।
প্লেট ততটা ভালো না হওয়ায় বেশীদিন প্লাষ্টার রাখতে হয়েছে। হয়ত তাই কব্জি এখনো কিছুটা শক্ত রয়েছে। তখন ভয় পেয়ে তাদের পাড়ায় বসবাসকারী কলকাতার এক সরকারি মেডিক্যাল কলেজের ষ্টাফের শরনাপন্ন হয়ে সেই মেডিক্যাল কলেজের অর্থোপেডিক আউটডোরে গেছিল।
নতুন করে এক্সরে করালাম। হাড় সঠিক অবস্থানে সুন্দর জুড়ছে। তবু সেখানকার কয়েকজন ডাক্তার নাকি বলেছে- কি অপারেশন করিয়েছেন? হাতটা তো একেবারে শেষ করে দিয়েছে! এইসব। অথচ রোগীকে একবার ছুঁয়েও দেখে নি। নতুন একটা এক্সরেও করায় নি।
ফোনে অনেক তর্ক-বিতর্কের পরে রোগী ও তার বাড়ির লোকেরা আজ আমার চেম্বারে এসেছে। খানিকক্ষণ আলোচনার শেষে উত্তেজনা প্রশমনের পরে এই সব কথা হচ্ছিল।
‘তবে আসল কথা কি, খাতায় কলমে আমার যারা শিক্ষিক-শিক্ষিকা- সে স্কুলেই বলুন বা মেডিক্যাল কলেজ- তাঁরা হয় অবসরজীবন যাপন করছেন বা অথবা ইহজগতের মায়া কাটিয়েছেন। তাঁরা প্রায় কেউই আর সরকারী চাকরি দূরের কথা, বয়সজনিত কারনে নিয়মিত ডাক্তারী করেন না।’
‘এরা এরকম বানিয়ে বানিয়ে বলে কেন?’
‘এ তো তবু কোনো একটা মেডিক্যাল কলেজের একজন ডাক্তার বলেছে! বহু ডাক্তার আছে কোনো মেডিক্যাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ধারে কাছে কোনোকালে ছিল না, শুধুমাত্র প্র্যাকটিস করে। তারাও রটিয়ে থাকে- অমুক আমার ছাত্র ছিল, তমুক আমার ছাত্রী, ইত্যাদি। এমনকি ওষুধের দোকানদার পর্যন্ত বলে থাকে- অমুক ডাক্তারকে তো আমিই তৈরি করে দিলাম!’
‘বুঝলাম। কিন্তু আপনাদের মধ্যেও এরকম ঈর্ষা আছে?’
‘ঈর্ষা তো থাকবেই। মানুষ তো! ছাড়ুন ওসব, এ হল পেশাগত সমস্যা।’
এক্সরে ভিউ বক্সের উপরে ফ্রেমে বাঁধানো আমার একটা ছবি আছে। ২০০৫ সালের। মুম্বাই কনফারেন্সে তোলা।
সেটা দেখিয়ে ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওই সময় নিশ্চয়ই আপনি ছাত্র ছিলেন?’
বয়সটা বেশ কমই ছিল। চুল-ও ছিল মাথায়। তখন আমি মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে। তবে সহকারী অধ্যাপক।
‘বললাম না, আমি এখনও ছাত্র-ই আছি!’
তারপর, রোগীর দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোমার অসুবিধাটা ঠিক হচ্ছে এখন?’
‘মাঝে মাঝে একটু ঝিলিক দিচ্ছে। আর হাতটা ডান হাতের মত পুরো ভাঁজ করা যাচ্ছে না।’
এই ‘ঝিলিক দেওয়া’ বা ঝিলিক মারা’ ব্যপারটা যে কি, এত বছর অর্থোপেডিক সার্জারি করেও বুঝে উঠতে পারলাম না!
বললাম, ‘একটু সময় লাগবে তো! সবে তো প্লাষ্টার খোলা হয়েছে।’
‘আপনাকে দেখাতে পারলাম না। আপনি সিঙ্গাপুরে চলে গেছেন। তাই ভয় পেয়ে গেলাম।’
বনবাসে গেলেও রোগীদের ট্যাঁকে বেঁধে নিয়ে যেতে হবে দেখছি!