আপনারা শুনে থাকবেন, জাপানে একটি জঙ্গল আছে , যেখানে ঢুকলে মানুষ আর ফিরে আসে না !
না, সেখানে কোন জেলখানা নেই, বিদেশী শক্তি নেই, কোন ফাঁদ নেই!
ফাঁদ নেই বলা ঠিক নয়, তবে আপাতদৃষ্টিতে সে ফাঁদ কোন পাখি বা মানুষ ধরার ফাঁদের মত নয়। দেখাও যায় না। সেখানে রয়েছে প্রকৃতির অবারিত সবুজ, নৈঃশব্দ্য, আর এখনো অব্দি না জানা এক অজানা রহস্য। শোনা যায়, এক অদ্ভুত ধরনের শৈবাল আছে সেখানে, যা থেকে নির্গত হয় এক মোহময়ী আলো।
কি হয় সে ফাঁদে পা দিলে?
না, এমনি কেউ সে ফাঁদে পা দেয় না। যে মানুষটি সমাজ সংসার সব কিছু ছেড়ে চিরতরে হারিয়ে যেতে চায় প্রকৃতির কোলে, যে মানুষটির কাছে পৃথিবীর এই বাস ট্রেন সভা সমিতি রাজনীতি সাজনীতির ধুলোবালিছাই মাখার আর কোন অর্থ নেই, এক অপার্থিব শান্তির খোঁজে হৃদয়ের সমস্ত শক্তি এক করে নিয়ে, সকল আত্মীয় পরিজন ছেড়ে দিয়ে সেই মানুষটি ঢুকে পড়ে এই জঙ্গলে।
ঢোকার আগে সরকারি বিধিনিষেধ আছে বটে। তবু ও মানুষ সেখানেই যায়।
যায় বটে! কিন্ত আর ফেরে না!
সেখানেই সে আত্মহত্যা করে নেয়! এবং জাপানের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ এখানেই এসে আত্মহত্যা করেন। এভাবেই একদিন জীবন শেষ করে দেন। সে জঙ্গলের নাম Aokigahara বা ‘সুইসাইড ফরেস্ট’।
কোন আলাদা ফাঁদ না থাকলেও, বরং প্রকৃতির অঢেল সৌন্দর্যের মাঝেই তাই পড়ে থাকে অসংখ্য মানুষের লাশ। যাঁরা একবার ঢোকেন ওই জঙ্গলে, তাঁরা কেউ ই ফিরে আসেন না বলে, সত্যি সত্যি কি ঘটে ওখানে কেউ ঠিক করে জানেন না। তৈরি হতে থাকে মিথ!
একটি হলিউডি সিনেমা ও তৈরি হয়েছিল এই জঙ্গল নিয়ে। যাক সে কথা।
আরেকটি জায়গা আছে হাতের কাছেই। আপনারা হয়তো অনেকেই গিয়েছেন। গ্যাংটক মল থেকে হাঁটতে হাঁটতে শেষ প্রান্ত হয়ে যে ঢালু রাস্তা চলে গেছে ডানদিকে, পাঁচশো মিটার বা তার একটু বেশি হবে, খানিকটা উপরে উঠতে গেলেই বাম দিকে একটা বাঁক। তার ঠিক ডান দিকেই রয়েছে এমনই এক জায়গা। দু’টো বেঞ্চ আছে দেখেছি যখন। বেড়া দিয়ে ঘেরা। সামনের দিকে তাকালে দেখা যায় পাহাড়ের খাদ, সবুজ উপত্যকার অনির্বচনীয় সৌন্দর্য। গাছপালা, আর নানা রকম ফুল ফুটে থাকে। এই উপত্যকা আর পাহাড়ি খাদের সৌন্দর্য দেখার জন্য আমরা ছুটে যাই সবাই। অথচ আপাতদৃষ্টিতে আর দশটা খাদের সাথে কোন পার্থক্য নেই। শুধুই সৌন্দর্য। সে সৌন্দর্য হয়তো মৃত্যুর চেয়ে ও বেশি বলেই, তাই মানুষ এড়াতে পারে না তার অমোঘ টান। তাই পার্থক্য আছেও! ওই জায়গাটির নাম ‘সুইসাইড পয়েন্ট’।
জানি না কে কবে কেন ওখানে গিয়েই সুইসাইড করেছিলেন। কিন্ত করেছিলেন, এটুকু জানা যায়।
আরেকটি ছোট্ট চোখে দেখা ঘটনা বলি : একটা অজপাড়াগাঁয়ের। সে গ্রামের মানুষের কাজ বলতে নিজের বা অন্যের জমিতে চাষাবাদ করা। অন্য পেশা বলতে কেউ কেউ মাছ ধরে, ভ্যান চালায়, কেউ সব্জি বিক্রি করে। মাত্র কয়েকজন মানুষ একটু উপরি ইনকামের লোভে মাঝে মাঝেই পাড়ি দেয় অন্য রাজ্যে। কি পায় জানি না, তবে শেষ অব্দি ফিরে আসে। জীবন সেখানে ধীর লয়ে চলতে থাকে। বড় বড় গাড়ি ঘোড়া নেই। মাটির রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে দুপাশের ধানের ক্ষেত, ছড়ানো ছিটানো কয়েকটি বাড়ি। নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষই প্রায় সবাই। তাই জীবনের চড়াই উতরাইও কম। পড়াশোনা নামকাওয়াস্তে কেউ কেউ চেষ্টা করে। বাকিরা চেষ্টা ও করে না বা করতে পারে না। মাধ্যমিক পড়ুক আর উচ্চ মাধ্যমিক যাই পড়ুক, শেষ অব্দি পরিণতি জমিতে চাষাবাদ।
এরকম অসংখ্য গ্রাম, বাংলার সব জায়গায় আছে। আলাদা কিছু নয়। একদিক থেকে দেখলে জীবন সেখানে সুন্দর। কেউ কেউ অনাহারে অর্ধাহারে থাকে বটে মাঝে মাঝে, কিন্ত তাতে খুব বড় একটা ব্যাঘাত ঘটে না স্বাভাবিক জীবন যাপনে। চাহিদা কম থাকলে মানুষ ভালো থাকে, এটাই বোধহয় সেই গ্রামের আসল রহস্য।
যেটা বলার জন্য এই গল্প তা হলো: এই গ্রামের একপাশে মাঠের ধারে রয়েছে একটি শ্মশান। না, বৈদ্যুতিক চুল্লি নেই। একটা খোলা চাতালের মত জায়গা, গোটা তিনেক অশ্বত্থ গাছ। একটা বটগাছ। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে চাষের জল আনার জন্য একমাত্র খাল। দুইপাশে কাশফুল ফোটে অনেক। এছাড়া জংলী অনেক ফুলও ফোটে। যাঁরা গ্রামের মানুষ, তাঁদের কাছে এইসব জিনিস কখনো সৌন্দর্য হিসেবে ধরা দেয় না সাধারণতঃ। অথচ, অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার ইত্যাদিতে পরিপূর্ণ মানুষ কেন জানি না, সেই শ্মশানকে মোটেই ভয় পায় না! বরং খুব ভালোবাসে। তাঁদের বিশ্রামের জায়গা ওই বট গাছের নিচে। তাঁদের কাজের ফাঁকে ওখানে বসেই খাওয়া দাওয়া। গ্রামের ছেলেরা ওখানেই আড্ডা মারে।
কিন্ত, এই শ্মশানের ই একটি অশত্থ গাছের ডাল, যেটি মাটি থেকে হাত দশেক উপরে সমান্তরাল ভাবে চলে গেছে পাশের সবুজ ধানের মাঠের উপরে, উপরে বিশাল আকাশ, যেখানে বসে মনের আনন্দে গান গাওয়া যায়, কবিতা লেখা যায়, সিনেমার শুটিং করা যায় এতোটাই সুন্দর দৃশ্য , সেটিই হয়ে দাঁড়িয়েছে সুইসাইডাল ব্রাঞ্চ!
কি জানি কেন, তবে সেখানে মাঝে মাঝেই ঘটে আত্মহত্যা। শুধু ওই গ্রামের নয়, পাশের গ্রাম থেকেও এসে মানুষ ওখানে আত্মহত্যা করেছে, এমন নজির আছে। হয়তো আত্মহত্যার জন্য নিরিবিলি পরিবেশ বা মানুষের চোখে পড়ার জন্য উপযুক্ত বলেই, ওই ডালটাই বেছে নেয় সবাই ! কেউ হিসেব রেখে হয়তো সিনেমা বানাবেন না, কিন্ত অনেকগুলো ঘটনাই ঘটেছে। তৈরি হয়েছে মিথ। কেউ কেউ অলৌকিক অ্যাংঙ্গেলও খুঁজে পেয়েছেন।
সুইসাইড ব্রাঞ্চটি কেউ কাটেও না তাই !!
তবে, পুলিশ বা অন্যরা যেটা দেখেছেন, যাঁরা আত্মহত্যা করেছে ওখানে, তাঁরা বেশিরভাগই একটুখানি হলেও লেখাপড়া জানা মানুষ বা গ্রামের মধ্যে যাঁরা তুলনামূলক সচ্ছল! না, ভাতের অভাবে অনাহারে অর্ধাহারে থাকা গ্রামের মানুষ কিন্ত মরেনি একজন ও!
কি জানি মানুষ কি ভাবে। একদিন সবুজ ধানের শীষ হলদে হতে শুরু করলে সবুজের মৃত্যু হতে থাকে, ফসল পড়ে থাকে … সেই ফসলের লোভ ছেড়ে অথবা নতুন ধানের নবান্নের উৎসব শেষে, একদিন জীবনের লেনদেন ফুরিয়ে গেলে … মানুষ হয়তো বেছে নেয় ওই ডাল। সুইসাইডাল!
যাইহোক, যে গল্প বলার জন্য এই তিনটি গল্পের অবতারণা, সেটিতে আসি এবার।
একটি নিরুপদ্রব সকালে ঘুম থেকে উঠে আপনাদের জীবন কাটছে এখন গৃহবন্দী অবস্থায়। প্রথমতঃ দুর্বিষহ লাগলেও অনেকেই একঘেয়েমি কাটিয়ে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন আশা করি। কেউ কেউ হয়তো কিছুটা মানসিক বা অন্যান্য সমস্যার মধ্যে আছেন। কারো হয়তো মজুত খাবার নেই, কারো কাজ চলে গেছে বা যেতে পারে, কারো ইনকাম বন্ধ হয়ে গেছে।
এই পরিণতি হবারই কথা। সরকার সাধ্যমত চেষ্টা করছে। আপনারা হয়তো আর কিছুদিনের মধ্যেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাবেন। যাবেন অবশ্যই – শুভকামনা রইলো।
আবার পৃথিবীর এই ঝড় থেমে যাবে। মানুষ জিতবেই। কিছু মানুষ হারিয়ে যাবে মৃত্যুর দেশে … কিছু মানুষকে আমরা মনে রাখবো। কিছু মানুষকে কেউ মনে রাখবো না। বড্ড স্বাভাবিক ভাবেই আমরা জীবন যাপন করবো।
এবার যাঁদের মনে রাখবো না কেউ, তাঁদের কথা বলি। কারা তাঁরা?? কোথা থেকে আসেন?? কেনই বা মরে যান প্রতিদিন তাঁরা ?? সে কি পিপিই কিটের অভাবে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যু শুধু ,নাকি আত্মহত্যা??
আসুন দেখি ।
যেহেতু আমি ডাক্তার, তাই ডাক্তারদের নিয়েই লিখতে পারবো বলে মনে হয়।
বিগত দিনে আমাদের রাজ্যে, দেশে বা পৃথিবীর অন্যান্য দেশে অসংখ্য ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন, মৃত্যুবরণ করেছেন। সে পরিসংখ্যান সত্যিই ভয়াবহ।
সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো: তারপরও আমাদের সমাজ এখনো প্রতিনিয়ত ডাক্তার তথা স্বাস্থ্যকর্মীদের হেনস্থা করে চলেছে। যত রকম ভাবে পারা যায়, তাঁদের মুখ বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। বিগত দিনেও অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে লজ্জাজনক হেনস্থার। এমনকি খুন ও!
এবার আপনি আমি সবাই জানি এগুলো। ডাক্তাররাও জানেন। খুব ভালো করে জানেন, যে কোন দিন তাঁর উপর নেমে আসতে পারে প্রাণঘাতী হামলা, যে কোনদিন করোনার গ্রাসে জীবন শেষ হয়ে যেতে পারে।
জানে সেইসব ছাত্র ছাত্রীরা, যাঁরা একদিন অনেক স্বপ্ন নিয়ে প্রচণ্ড পড়াশোনা করে, জয়েন্ট বৈতরণী পার করে আসে ডাক্তারি পড়তে।
আমি যেহেতু ছাত্র ছাত্রীদের পড়াই, কাছে থেকে দেখি, কি সব মেধাবী শিক্ষার্থীরা এসে ভিড় করে এই পেশায়! কি সুন্দর সব চিন্তা ভাবনা তাদের। বেশিরভাগই স্বপ্ন দেখে একদিন সে যন্ত্রনা কাতর মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলতে পারবে। ভাবে, তাঁর পরিবারের বা নিজের জন্য ভালো কিছু করতে পারবে।
অর্থনৈতিক দিক যদি দেখেন, অবশ্যই দেখা যায়, কিন্ত খুব সহজ করে যদি ভাবেন, এই সব মেধাবী শিক্ষার্থীরা যদি অন্য পেশা বেছে নিত, তাঁরা কি সফল হতো না ??? জেনে থাকবেন হয়তো , খুব কাছাকাছি মেধার বহু ছাত্র ছাত্রী যাঁরা হয়তো অন্য পেশায় যান, তাঁরা জানেন, তাঁদের ডাক্তারি পড়ুয়া বন্ধুটি যেখানে যেত সেখানেই সফলতা পেত।
এইসব শিক্ষার্থীদের মধ্যে গান বাজনা নাটক লেখালেখি ছবি তোলা অভিনয় – কি না দেখেছি/দেখছি !! না, মোটেই তাঁরা ফেলে দেয়ার মত নয়। যাঁদেরকে আপনারা অন্য পেশায় দেখেন, যাঁদেরকে দেখে সমাজের আইডল ভাবেন (ভাবুন, দোষ নেই তাতে), বিশ্বাস করুন, তাঁদের চেয়ে কোন অংশে কম নয় এমন অনেক ছাত্র ছাত্রী দেখি।
তাঁরা চাইলেই করতে পারতো অন্য কিছু। কিন্ত আপনি প্রশ্ন করবেন: করলো না কেন ??
এখানেই প্রশ্ন। হয়তো কোন ডাক্তারকে একান্তে আপনি যদি প্রশ্ন করেন, আপনি কেন এলেন তাহলে? – হয়তো নানা রকম জবাব পাবেন। কি রকম? বলছি।
কেউ বলবে – বাড়ির লোকজন চেয়েছে।
কেউ বলবে – চান্স পেয়ে গেলাম, স্যার বললেন বা সিনিয়র বললেন।
কেউ বলবেন – আমার বাবা দাদা এই পেশায়, তাই ..।
কেউ হয়তো বলবেন – পেশায় অর্থনৈতিক নিরাপত্তা আছে।
কারো ছোটবেলা থেকেই শখ।
আর একটা বড় অংশের কাছে উত্তর পাবেন – বিশেষ করে যাঁরা কিছুদিন এই পেশায় কাটিয়ে ফেলেছেন – মানসিক শান্তি। শান্তি চাই একজন অসুস্থ মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর।
এই সুখ টাকায় কেনা যায় না। একটি শিশুর জন্মানোর পর যে প্রথম কান্না, সেই অপার্থিব সৌন্দর্যের টান।
প্রতিদিন মৃত্যুকে দেখে দেখে, তাঁর চোখে চোখ রেখে বুক ফুলিয়ে বেঁচে থাকার মধ্যে যে অমোঘ আকর্ষণ, তার জন্য!
এবার আপনি তেড়ে আসবেন। ঢপ মারছি বলে হয়তো দু’ঘা লাগিয়েও দেবেন। আর আপনার ভাষা নৈপুণ্যে আমাদের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার তো হয়েই যাবে!!
আচ্ছা, দ্বিচারিতা মনে হচ্ছে তো??
আমার ও হচ্ছে। কেন? বলছি।
এই যে বিভিন্ন রকম উত্তর পেলেন, আপনিও জানেন তাতে সত্য মিথ্যা যাই থাকুক, একটা কথা সত্যি – এঁরা সবাই জীবন যাপন করার জন্য মোটামুটি একটা ইনকাম করতে পারেন বা করেন। না, আপনাদের হিসেব মতো প্রতিদিন লাখ লাখ হয় না বেশিরভাগেরই !!
এই পেশার চেয়ে অন্য পেশায় অনেক অনেক বেশি ইনকাম করা মানুষ আছেন। এবার প্রশ্ন হলো: এইসব জেনেও, মেনেও কেন এখনো সমাজের সব মেধাবীরা এখানে ভিড় জমায়?? শুধুই কি টাকার জন্য?? আপনারা কখনো কি এই প্রশ্ন করেছেন নিজেদের বিবেকের কাছে??
বিশ্বাস করুন, টাকা পয়সা গাড়ি বাড়ি এই পেশায় যাঁরা অর্জন করে ফেলেন, তাঁদের না আছে জীবনকে নিজের মতো করে কাটানোর উপায়, না আছে সময়। কিন্ত আপনারা তাঁদেরকে গাল দিতে থাকবেন – ওই ব্যাটা এতো টাকার মালিক, তাও ভিজিট নেয়!! বিশ্বাস করুন, এই ভিজিট নেয়ার ব্যাপারটা নেহাতই পেশার অংশ। সেই মানুষটির জীবনের সঙ্গে হয়তো তার সম্পর্ক সামান্যই। আপনি পরিষেবা নেন, তিনি ভিজিট নেন। এইটুকুই!! সে হিসেব জীবনের। মৃত্যুর জন্য নয়, আত্মহত্যার জন্য নয়!
কিন্ত আমরা কেউ ই ভেবে দেখি না যে, এই পেশায় আসা মানেই একটা সুইসাইডাল ডিসিশন!!
যাঁরা পাঁচ দশ বছর এই পেশায় কাটিয়েছেন, যাঁরা আপাতদৃষ্টিতে সফল, যাঁরা একটু কম সফল, বা অসফল – সবাইকে একান্তে জিজ্ঞেস করুন। দেখবেন- সবার একটাই জীবনের সবচেয়ে ভুল ডিসিশন!!
আমার সহকর্মীদের অনেকেই বলবেন – আমি মোটেই হতাশাগ্রস্থ নই এ পেশায়। আমি যথেষ্ট ভালো আছি। মানসিক শান্তি আছে। বাকি সব কিছুও আছে। কোনদিন হেনস্তা হইনি। কোনদিন খারাপ কাজ করিনি। চিকিৎসাও ঠিকঠাক করি। সমাজে ও যথেষ্ট সম্মান পাই।
তোমার ভাই, মাথায় গণ্ডগোল আছে!!
আপনি বলবেন – ভাই , ভাট বকা বন্ধ করো। ভালো মন্দ সবই আছে এ পেশায়। তুমি বললেই মানবো কেন??
আমি বলি কি, আপনারা আর আমার সহকর্মীরা- সবাই ভুল।
এই পেশায় আসা মানে সুইসাইড করতে চলা!!
এই পেশা আত্মঘাতী পেশা!!
যে এই পেশায় আসে, জ্ঞানতঃ বা অজ্ঞানতাবশত – সুইসাইড ই করে!!!
হ্যাঁ একবারে ঝাঁপ দিয়ে মরে যায় না, এই যা তফাৎ!
জঙ্গলে গিয়ে মরে যায় না, গাছের ডালে ঝুলে পড়ে না এই যা তফাৎ!!
কিন্ত সুইসাইড করে!!
কে কিভাবে করে শুনুন তাহলে!
শুনে থাকবেন, কেউ কেউ টাল সামলাতে না পেরে মাঝপথে ছেড়ে দেয়, আত্মহত্যা করে বলে আমরা খবর পাই, দুঃখ করি। সে সব ছেড়ে দিন।
কেউ কেউ সফলতা পায় না বলে নিজেকে ব্যর্থ ভাবে, সারাজীবন এই পেশাকে গালি দেয়, বাপ মা নিজেকে গালি দেয়, মরতে পারে না কিন্ত আজীবন সুইসাইড করতে থাকে। সেটাও আলাদা প্রেক্ষাপট।
এই সংখ্যাটা টোটাল ডাক্তারদের সংখ্যার তুলনায়, সত্যি বলতে খুবই কম। নগণ্যই বলা যায়।
তাহলে বাকিরা কিভাবে সুইসাইড করে??
যে ছেলে বা মেয়েটি ভালো কিছু করার আশায় এই পেশায় আসে, যে ডাক্তার সারাজীবন ধরে নাওয়া খাওয়া ভুলে, অল্প ভিজিট বা বিনা পয়সায় মানুষের সেবা করেন, যে ডাক্তার এই মহামারীতে এক অদ্ভুত ড্রেস কোড মেনে মানুষকে বাঁচাতে চান, যে ডাক্তার দিন রাত পরিবার ছেড়ে পড়ে থাকেন হাসপাতালে, যে ডাক্তার আপাতদৃষ্টিতে প্রচণ্ড সফল এই পেশায়, যে ডাক্তার সবদিক বাঁচিয়ে প্রাকটিস করেন, যে ডাক্তারের বিশ্বব্যাপী নাম, যে ডাক্তার মরে যাচ্ছেন প্রতিদিন এখন – তাঁরা সবাই সুইসাইড করেন বা করতে থাকেন বা করেছেন আগেই।
সেই সুইসাইড কিসের জন্য জানেন? কিসের লোভে জানেন?? কোন অদৃশ্য শক্তি তাঁকে টেনে নেয় এই পথে?? সেই ফাঁদে কেন পা দেন তাঁরা?? কেন এড়িয়ে গিয়ে অন্য পেশায় যান না??
এখানেই আসল রহস্য। সেই রহস্যের আড়ালে লুকিয়ে চলে এই আত্মঘাতী খেলা। এই রহস্য সৌন্দর্যের। এই রহস্য এক অপার অপার্থিব শান্তির। এই রহস্যের ওপারে রয়েছে চিরযৌবনা মৃত্যুর হাতছানি।
পৃথিবীতে যখন কোন কিছুর অভাব নেই, পরিবার পরিজন সমাজ সংসার নিয়ে আপনি চাইলেই একটি নিরুপদ্রব জীবন কাটাতে পারেন, কারো গালাগালি মার খাওয়ার দরকার নেই, যখন প্রতিদিন হেনস্থা হবার ভয় নেই – তেমন সময়ে এই সৌন্দর্য, শান্তি, মৃত্যু আপনাকে আমাকে প্রতিনিয়ত ডেকে চলে।
বিশ্বাস না হলে জিজ্ঞেস করবেন কোন সিনিয়র ডাক্তারকে।
কোন কিছুর লোভ নেই – অথচ নির্বিকার ভাবে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন শুধু মাত্র অন্য কারো মুখে হাসি ফোটাতে।
গর্বে বুক ভরে শ্বাস নিচ্ছেন এই ভেবে যে – একদিন এই পেশায় এসেছিলাম ভাগ্যিস!
জিজ্ঞেস করুন সেই ডাক্তার কে – যিনি এই মহামারীতে আক্রান্ত হবার কয়েকদিন পর সবকিছু তুচ্ছ করে ফের ড্রেস পড়ে বা না পড়েই নেমে পড়েছেন কোন আত্মীয় অনাত্মীয় একজন মানুষকে বাঁচাতে!!
জিজ্ঞেস করুন সেই ডাক্তারকে, যে দিনের পর দিন ঘরে ফেরেনি।
জিজ্ঞেস করুন সেই ডাক্তার কে – যে পঁয়ষট্টি বছর বয়সে ছুটে চলেছেন পাঁচশো কিলোমিটার দূরে কাজের জায়গায়!
জিজ্ঞেস করুন, একটানা সাতদিন ডিউটি করে মৃত্যু বিছানো হাসপাতালের মেঝেতে শুয়ে যে খুঁজে নিচ্ছে পরের দিনের ডিউটি রস্টার!
জিজ্ঞেস করুন সেই ডাক্তার কে – যে হাজারো অভাব অসুবিধার মধ্যে ও ভেবে চলেছেন – একজন মানুষ ও যেন শ্বাস নিতে সমস্যায় না পড়েন।
জিজ্ঞেস করুন সেই ডাক্তার কে – যাকে আপনারা অনেকে ভগবান বলেন!!
এইসব ক্ষেত্রেই আমরা ডাক্তাররা জ্ঞানতঃ বা অজান্তেই বেছে নিই সুন্দরকে। শান্তিকে। মৃত্যুকে।
কে বলে সুইসাইড মানে জীবনের উপর একটি দুঃখজনক সমাপ্তি??
কে বলে জীবনের ব্যর্থতা থেকে যে হতাশা আসে, তার ফল সুইসাইড??
কে বলে আমাদের এই সুইসাইড নোট শুধু মাত্র অন্যকে দায়ী করার জন্য লেখা হয়??
আপনার হাসি খুশি সুস্থতার জন্য, আপনার জীবনের ব্যথাটুকু দূর করে, শ্বাস নিতে সাহায্য করে, হাত নাড়াতে সাহায্য করে,উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করে, মৃত্যু পথযাত্রী আপনাদের সবাইকে আর ক’টা দিন এই পৃথিবীর ফুল ফল জল হাওয়া আকাশ বাতাস পাহাড় বরফ নদী সমুদ্রের পাড়ে খেলতে দেখে, ঝগড়া মারামারি কাটাকাটি যুদ্ধ করতে দেখে, উপাসনা করতে দেখে, ভালোবাসতে দেখে, একটি ছোট্ট শিশুর অপার্থিব কান্না হাসির সাক্ষী হতে হতে আমরা চলতে থাকি সুন্দরের পথে, শান্তির পথে, মৃত্যুর দিকে।
একবার কাছাকাছি এসে দেখুন এই পেশার – জাপানের ওই রহস্যময় জঙ্গল, গ্যাংটকের সুদৃশ্য সুইসাইড পয়েন্ট কিংবা গ্রামের সেই নির্জনতায় অশ্বত্থের সমান্তরাল সুইসাইড ডাল – সব আছে এই পেশার আনাচে কানাচে। দেখবেন, কি মোহময়ী সৌন্দর্য, কি অমৃতের সুখ নিয়ে এই পেশা আপনাকে ডেকে চলেছে মৃত্যুর দিকে।
যেখানে জীবনের সব লেনদেন শেষ হয়ে যায় সেই মৃত্যুর দিকে যেতে চেয়ে – যেখানে হিংসা ঘৃণা লোভ লালসার দূষণ, প্রকৃতির সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সুন্দর সেই মানুষের কাছে যেতে যেতে আত্মহত্যা করে চলি আমরা! এই সুইসাইডাল পেশার মানুষেরা।
হ্যাঁ, প্রতিদিন আপনাদের চোখের সামনে বেড়ে ওঠা সেই ভালো ছেলে বা মেয়েটি অজান্তেই সাধনা করে চলে সুন্দরের, শান্তির, মৃত্যুর।
প্রতিদিন পড়তে থাকে এই সুইসাইডাল ট্রাপে।