পাড়ার এক খুদে, আসল নাম জানা নেই তবে সবাই ছোটু বলে ডাকে। মোড়ের মাথার ওই টেলারিং শপের, শাকিব চাচার খুব ন্যাওটা। ছোটু তার বন্ধু,শাকিব চাচা-এঁদের চোখ দিয়েই দুনিয়ার সব স্বাদ লুটে নেয়, তাই তাঁরাও চারপাশের সমস্ত খারাপ’টুকু সরিয়ে সবসময় ছোটু’কে এক অনাবিল আনন্দের জগতে নিয়ে যায়। ছোটু’ও মনে মনে এক সুন্দর আরশিনগর কল্পনা করে নেয়। ও দেখতে পায়না বলে-ওর কোনো খেদ নেই ঠিকই, কিন্তু ওর মা বাবা চান ও সুস্থ জীবন পাক-সেই কবে নাম লিখিয়ে এসেছে-নম্বর এলে ছোটু চোখ পাবে। ডাক্তার বাবু বলেছেন কারোর পুরোনো চোখ ছোটু’কে নতুন দৃষ্টি দিতে পারে।
শাকিব চাচার টেলরিং শপটা আজ দু’বছর ধরে ছোটু’ই দেখে। সে আজ ব্লাইন্ড স্কুলে পড়ায়ও আর জায়গায়-জায়গায় আই ডোনেশন ক্যাম্প করে যাতে তার মতো আরোও অনেক ছোটু’দের জীবনে আলো আসে।
সেবার শীতে চাচা চলে যাওয়ার পর থেকে যে,আক্ষরিক অর্থেই তাঁর চোখ দিয়েই আরশিনগর দেখে সে!
**************************************
আর্য, এক চল্লিশোর্ধ ব্যবসায়ী। আজীবন অক্লান্ত পরিশ্রম করে সে আজ সুপ্রতিষ্ঠিত। মা-বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী-কন্যা নিয়ে তার সুখের সংসার। চিরকালই মিশুকে ছেলেটি একদিন জানতে পারে, তার মামা-শ্বশুরের লিভার ট্রান্সপ্লান্টেশন প্রয়োজন। উনি বিয়ে করেননি। আপনজন বলতে এই আর্য’রাই। ডোনার পাওয়া যায় না আর পেলেও ম্যাচ করে না। এদিকে অবস্থার অবনতি হতে থাকে। একদিন আর্য’র কি খেয়াল হয়, নিজেই টেস্ট করাতে চায়-যদি ওর’টা ম্যাচ করে। রিপোর্ট আসে-আর্য তার লিভারের কিছু অংশ দিয়ে আদরের মামা’র প্রাণ বাঁচায়। জটিল পদ্ধতি হলেও আজ দাতা আর গ্রহীতা দু’জনেই সম্পূর্ণ সুস্থ ও কর্মক্ষম। শুধু আর্য’কে তার স্ত্রী-বেস্টফ্রেন্ড মলি ও মা-রূপী মেয়ে ঈশি আর কিছু আত্মজন ছাড়া আর কেউ বোঝে না। কি জানি কোন অজানা অপরাধে আজ’ও তার ‘আপনজন-দের’ কাছে সে দোষের ভাগী হয়ে আছে!
**************************************
বেশ অনেক বছর আগে, দত্ত দম্পতির একমাত্র কন্যা রুমি’র গুরুতর অ্যাক্সিডেন্ট হয়। অনেক চেষ্টা করেও কিছু ঠিক হয় না। শেষমেষ ব্রেন ডেথ হয়ে যায়। এসবে রুমির মা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। এই অবস্থায়, কি করবেন কিছুই কূলকিনারা করতে না পেরে রুমির বাবা তাঁর বাল্য বন্ধু যিনি আজ একজন নামকরা ডাক্তার তাঁর কাছে সবটা খুলে বলেন। ঠিক হয় রুমির অরগ্যান ডোনেট করা হবে। প্রাণখোলা-হাসিখুশী রুমি শুধু ছাই হয়ে বেঁচে থাক এমনটা ওর বাবা চায়নি।
আজ দত্ত দম্পতির চার সন্তান-সকলের মধ্যেই যে তাঁদের রুমি। এঁরা মাঝেমাঝেই আসেন তাঁদের অন্য মা-বাবা র কাছে। এঁদের মধ্যে একজন তো আবার রুমির মায়ের চিকিৎসক ও কাউন্সিলর, যার মধ্যে আজ’ও রুমির মা তাঁর আদরের রুমির হৃৎস্পন্দন শুনতে পান।
**************************************
শাকিব চাচা, আর্য, রুমির বাবা এঁদের মতো কখনো হতে পারব কিনা জানিনা। তবে হতে চাই।আশেপাশের মানুষকেও বোঝাতে চাই-যাতে তাঁরা তাঁদের আপনজনকে শুধু ফ্রেমবন্দি করে না রাখেন, অন্য মানুষদের মধ্যে তাঁদের বাঁচিয়ে রাখেন। ইচ্ছে থাকলেও সবাই এই মহাযজ্ঞে মনোনীত হন না, যাঁরা সুযোগ পায় তাঁরা নিজেদের অন্য জীবন দিয়ে যায়। সবাই সচেষ্ট হতে পারি, যদি আমরা মনের ক্যানভাস’টা একটু অন্যরকম ভালোবাসার রঙে ভরাই, যা ছাই রঙের চেয়ে-বিধি নিষেধ-নিয়ম নিষ্ঠার চেয়ে অনেক রঙিন-অনেক উজ্জ্বল-অনেক স্থায়ী-অনেক প্রাণবন্ত….!
!….হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন্স ডে….!