তসলিমা নাসরিন। বিখ্যাত নারীবাদী লেখক। ইসলামিক মৌলবাদের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন বারবার। মৌলবাদীদের আক্রমণের শিকার হয়েছেন বারবার। তাঁর মাথার দাম ধার্য করেছে মৌলবাদীরা। জীবনের ভয়ে লুকিয়ে থাকতে হয়েছে। অন্য দেশে আশ্রয় নিতে হয়েছে। তসলিমা দমেননি। অনেকের কাছে তিনি প্রেরণা। সম্প্রতি তিনি ভারতের কোনো এক হাসপাতালে শয্যাশায়ী। তিনি দ্রুত সেরে উঠুন।
.
কী হয়েছে তাঁর? ফেসবুকে তসলিমা স্বয়ং লিখছেন— “সেদিন ওভারসাইজ পাজামা পরে হাঁটছিলাম ঘরে, পাজামা চপ্পলে আটকে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম। অগত্যা যা করতে হয়, করেছি। হাঁটুতে ব্যথা হচ্ছিল, আইস্প্যাক দিয়েছি, ভলিনি স্প্রে করেছি। মনে হল হাঁটুর লিগামেন্টে হয়তো লেগেছে, কোনও হাসপাতালে গিয়ে এক্সরে করে দেখি কী হলো। গেলাম হাসপাতালে।”
.
তসলিমার হাঁটুতে লেগেছে। অন্য কোথাও লাগেনি, অন্য কোথাও ব্যথা নেই। কিন্তু—“এক্সরে আর সিটিস্ক্যান করে হাড়ের ডাক্তার বলে দিলেন পায়ের ফিমার নামের হাড়টির গলায় একখানা ক্র্যাক হয়েছে।”
.
আশ্চর্য ব্যাপার। ফিমার নামের হাড়টি হাঁটু থেকে হিপ জয়েন্ট পর্যন্ত বিস্তৃত। পড়ে গিয়ে তসলিমার হিপ অঞ্চলে লাগেনি, সেখানকার কোনো সমস্যা নিয়ে তিনি ডাক্তারের কাছে যাননি। হাঁটুর ব্যথার জন্য গিয়ে দেখলেন, হাঁটু থেকে এক ফুট দূরে ফিমার নামক হাড়টির অন্য প্রান্তে হিপ জয়েন্টে ফিমার-এর গলা, সেখানে ভেঙেছে। ব্যথা-ছাড়া হিপ জয়েন্টে ফিমার-এর গলা ভাঙা হতে পারে না, তা নয়, কিন্তু সেটা অথর্ব-বৃদ্ধ, ক্যানসার রোগী—ইত্যাদিদের ক্ষেত্রে। তসলিমা জানিয়েছেন, তিনি সেরকম নন।
.
ডাক্তারেরা খালি এক্স-রে দেখে সিদ্ধান্ত নেননি, তাঁরা সিটিস্ক্যান করেছিলেন। কেন? চুলের মতো সরু, বা ইনকমপ্লিট, ভাঙন এক্স-রে করে সব সময়ে ধরা যায় না। যদি এক্স-রে-তে ভাঙন না মেলে অথচ হিপ-অঞ্চলে সমস্যা থেকে যায়, তাহলে সিটি স্ক্যান ইত্যাদি করা হয়। এগুলো ইন্টারনেটে সব সময়ে পাওয়া তথ্য, ত০ সলিমার বা তাঁর অগণিত বন্ধুর জানার কথা। কিন্তু তসলিমা সিটিস্ক্যান করতে দিলেন। ব্যথা হাঁটুতে, সিটিস্ক্যান করা হল হিপ-এর। সে ব্যাপারে তাঁকে জোর কেউ করেননি। তারপর তাঁর চিকিৎসকের সঙ্গে মতপার্থক্য হল। তসলিমার ভাষায়—“এর চিকিৎসা কী, চিকিৎসার জন্য ডাক্তার দুটো অপশান দিলেন, প্রথম অপশান ইন্টারনাল ফিক্সেশান, ফাটলের জায়গাটা স্ক্রু লাগিয়ে ফিক্স করে দেবেন। দ্বিতীয় অপশান হিপ রিপ্লেসমেন্ট, আমার হিপ কেটে ফেলে দিয়ে কিছু প্লাস্টিক মেটাল দিয়ে একটা নকল হিপ বানিয়ে দেবে্ন। কিন্তু ইন্টারনাল ফিক্সেশান এর বিপক্ষে অজস্র বাজে কথা, এবং হিপ রিপ্লেসমেন্টের পক্ষে অজস্র ভালো কথা বললেন আমার কানের কাছে।”
.
তার মানে হাঁটুর ব্যথায় হিপের চিকিৎসা হবে, এমন প্রস্তাব ডাক্তার দিলেন। তসলিমা সেটা নিয়ে একটুও আপত্তি করলেন না। কিন্তু তিনি বললেন,
“জোর দিয়ে বললাম, ফিক্সেশান করবো। ডাক্তার খুশি হলেন না ততটা। বললেন ফিক্সেশানে সবসময় ফিক্স হয় না, ৮০% কাজ হয়, কিন্তু ২০ % ফেইল করে। আমি বল্লাম, ‘দেখা তো যাক ফিক্স হয় কিনা, হয়তো হবে।’ সার্জন বললেন, ‘ফিক্স না হলে কিন্তু আবার অপারেশান করতে হবে, আবার ওই হিপ রিপ্লেসমেন্টেই যেতে হবে।’ হাসপাতালে ভর্তি হয়ে গেলাম।”
.
অর্থাৎ হাসপাতালে ভর্তির আগে পর্যন্ত তিনি জানতেন তিনি হাঁটুর ব্যথায় হিপ রিপ্লেসমেন্টের জন্য ভর্তি হচ্ছেন। তসলিমা তখন এক, দুই, তিন, চার বা পাঁচজন চিকিৎসকের মত নিতে পারতেন। তসলিমা তা করেননি।
.
তিনি তখনও এক্স-রে প্লেট দেখেননি, কারণ অপারেশনের পরে তিনি লিখছেন—“আজ আমি এক্সরে রিপোর্ট দেখলাম আমার। আমার কোথাও কোনও ফ্র্যাকচার হয়নি সেদিন। ফ্র্যাকচার হয়নি বলে আমার হিপ জয়েন্টে কোনও ব্যথা ছিল না, কোনও সুয়েলিং ছিল না।”
.
তসলিমা বাংলাদেশে এমবিবিএস পাশ করা ডাক্তার, সুতরাং এক্সরে রিপোর্ট কেন, এক্স-রে প্লেট দেখেও বোঝার কথা। কিন্তু সিটিস্ক্যান করে তাঁর ফ্র্যাকচার ধরা পড়েছিল। এক্স-রে-তে অনেক সময়ে ধরা পড়ে না বলেই তসলিমা সিটিস্ক্যানে রাজি হয়েছিলেন আশা করতে পারি, নতুবা তাঁর সিটিস্ক্যানের সম্মতিপত্রে সই করার কথা নয়।
.
তসলিমার তিনটে পোস্টের বয়ান মিলিয়ে দেখলে, দেখবেন, তিনি হাঁটুর ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে গেলেন।
অস্থি বিশেষজ্ঞ X ray করলেন ও ফিমারের ওপর দিকে, হাঁটু থেকে অন্তত একফুট দূরে, ফ্র্যাকচার ধরা পড়ল। তসলিমা কিছু সন্দেহ করলেন না।
অস্থি বিশেষজ্ঞ হিপ রিপ্লেসমেন্ট বা ইন্টারনাল ফিক্সেশন এর কথা বললেন। হাঁটুর ব্যথায় হিপ রিপ্লেসমেন্ট শুনেও তসলিমা তেমন কিছুই বললেন না, খালি হিপ রিপ্লেসমেন্ট না করে ইন্টারনাল ফিক্সেশন করার কথা বললেন। কেন হাঁটুর ব্যথায় হিপ জয়েন্টের চিকিৎসা হবে, সেটা তসলিমা জিজ্ঞেস করলেন না।
তারপর ডাক্তারেরা একরকম জোর করে ফিক্সেশনের বদলে হিপ রিপ্লেসমেন্ট করলেন। তার আগে অপারেশনের ফলে ভালোমন্দ কী কী হবে, জানালেন না।
.
দুর্বোধ্য ব্যাপার হল, হাঁটুর ব্যথায় কেন হিপ সার্জারি, এপ্রশ্ন কেউই করলেন না।
.
কিন্তু তসলিমার কথায় অবিশ্বাস করা চলে না। তিনি সম্ভবত অনেক নাস্তিকের ঈশ্বর না-হোক পীর-পয়গম্বর। তাঁরা ধরে নিয়েছেন, হাঁটুর ব্যথায় হিপের এক্স-রে, সিটিস্ক্যান করার সময়ে তসলিমা কিছুই বোঝেননি। হাসপাতালে ঢোকার আগে আরেকজন অস্থি-বিশেষজ্ঞর মতামত নেবার প্রয়োজনীয়তা বোঝেননি। অপারেশনের পদ্ধতি নিয়ে তসলিমা ডাক্তারের স্বঙ্গে তর্ক তোলার সময়েও হাঁটুর ব্যথায় হিপের অপারেশন নিয়ে সন্দেহমাত্র করেননি।
.
অবশ্য তসলিমা সব বুঝেছেন পরে। তখন তিনি বলেছেন—“ধিক্কার দিচ্ছি নিজেকে। ধিক্কার দিচ্ছি এতকালের আমার মেডিক্যাল জ্ঞানকে। আমাকে হাসপাতালে মিথ্যে কথা বলা হয়েছিল যে আমার হিপ বোন ভেঙ্গেছে। আমার জীবনে কোনও জয়েন্ট পেইন ছিল না, জয়েন্ট ডিজিজ ছিল না। আমাকে মিথ্যে কথা বলে, ফিমার ফ্র্যাকচারের ট্রিট্মেন্টের নামে আমার হিপ জয়েন্ট কেটে, ফিমার কেটে ফেলে দিয়ে আমাকে সারাজীবনের জন্য পঙ্গু বানিয়ে দেওয়া হয়েছে।”
.
যা যা বোঝার তসলিমার তা আগেই বোঝা উচিত ছিল। বোঝার জন্য যা কিছু দরকার, সবই হাসপাতালে ভর্তির আগেই তসলিমার কাছে মজুত ছিল। হাঁটুর ব্যথায় হিপ-এর চিকিৎসাতেই তাঁর সন্দেহ হওয়া উচিত ছিল, অন্য ডাক্তার দেখানো উচিত ছিল। ঠিক কোন অপারেশন হবে, সেটা জানিয়েই তসলিমাকে ভর্তি করা হয়েছে, তখন তাঁর অন্য ডাক্তারের মত নেবার প্রচুর সুযোগ ছিল।
.
এরকম সুযোগ সকলের থাকে না। সত্যিই অনেক রোগী চাপে পড়ে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন। তসলিমার ক্ষেত্রে সে কথা একেবারেই খাটে না। দুঃখের ব্যাপার হল, একদিকে যে সমস্ত রোগীরা কোনো কারণে চাপে পড়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাঁরা ভাবছেন তসলিমা তাঁদেরই মতো অসহায়। অন্যদিকে, যে সব ডাক্তারেরা রোগীকে কখনও চাপে রেখে সিদ্ধান্ত না নেবার চেষ্টা করেন, তাঁরাও অন্যায়ভাবে দোষারোপের শিকার হচ্ছেন। তসলিমা স্পষ্টতই ভিক্টিম সাজার অপচেষ্টা করছেন।
.
এবং তসলিমা সফল। অনেক মানুষ তাঁর পোস্টে সহানুভূতি জানাচ্ছেন, ও ডাক্তারদের শাস্তি দাবি করছেন। ডাক্তারদের দোষ আছে কিনা, সে প্রশ্ন আলাদা। কিন্তু তসলিমা যে নেহাত কিছু না-জেনে অপারেশনে রাজি হয়েছেন, এটা তসলিমা তাঁর নিজের পোস্টেই মিথ্যা প্রমাণ করেছেন।
.
শেষে আসি সব চাইতে দুঃখের কথায়। তসলিমা লিখেছেন—“আমাকে বাংলাদেশি মুসলিম রোগী হিসেবে দেখা হয়েছে। যার কাছ থেকে প্রচুর টাকা নিয়ে অপারেশান করা হবে। সেই নিরীহ রোগী দেশে ফিরে যাবে, এবং ভেবে সুখ পাবে যে তার ট্রিট্মেন্ট হয়েছে।”
.
শেষ পর্যন্ত তিনি বললেন, হিন্দু ডাক্তার তার হিন্দু রোগী আর মুসলিম রোগীকে আলাদাভাবে দেখে। এই কথাটা অনেক হিন্দু ও মুসলিম মৌলবাদী হাজারবার বলেছে। কিন্তু তারা হিন্দু ডাক্তার আর মুসলিম রোগীর মাঝখানে ফাটল তুলতে পারেনি, কিংবা মুসলিম ডাক্তার আর তার হিন্দু রোগীর মাঝখানে ফাটল তুলতে পারেনি। তবে কিনা তসলিমা হলেন সাচ্চা ধর্মনিরপেক্ষ, মৌলবাদের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী। তিনি হয়তো অনেক বেশি ফাটল তুললেন।