আমাদের সমাজে ভালো/মন্দ, সাদা/কালো এসবের বিচার বড়োই অদ্ভুত…. যত বড়ো হয়েছি বুঝতে পেরেছি, ছোটবেলায় পাড়ায়, বাড়ির অনুষ্ঠানে, বিয়ে বাড়িতে, ঘরোয়া আড্ডায় যে মহিলারা তথাকথিত “মন্দ” বলে সমলোচিত হয়েছেন, তাঁরা এক একজন যোদ্ধা ছিলেন!!
তখন আমি বেশ ছোট… কোনো একটা শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে আমার কোনো দূরসম্পর্কের আত্মীয়া বলেছিলেন, “আমি কিছুই মানি না গো, আমি নাস্তিক এবং কমিউনিস্ট শাখা-সিঁদুর পরি না, আমার কাছে মৃত্যু মানেই সব শেষ “…. এক বাড়ি লোকের মধ্যে তিনি অকপটে ঘোষণা করলেন তাঁর বিশ্বাসের কথা…. আমি তখন কমিউনিস্ট মানে জানিনা, নাস্তিক মানেও জানিনা, শুধু বুঝেছিলাম এই মানুষটা অন্য কেউ, অন্যরকম কেউ…..
পরে কিন্তু আমি তাঁর বিষয়ে অনেক ফিসফাস শুনেছি…. “এসব আবার বাড়াবাড়ি, এতো আধুনিকতাও বাপু ভালো না “… বাড়ির বাকি সমস্ত মহিলা যাঁরা বিধি মেনে চলেন, তাঁরা কেউ মেনে নিতে পারেনি তাঁর এই অকপট ঘোষণা…. আমি তখন অনেক ছোট, ওই ফিসফাঁস কোথাও আমার মনেও প্রশ্ন তুলেছিল,”এতটাও হয়তো ভালো না?!”
আজকে বুঝি সেই মহিলা কতো বড়ো যোদ্ধা ছিলেন… সেই সময়-এ দাঁড়িয়ে, তাঁকে কতোটা লড়াই করতে হয়েছে নিজের বিশ্বাসের জন্য, অনুভব করতে পারি আজ… আর খুব বুঝতে পারি, উনি নিশ্চই জানতেন তাঁর এই অকপট স্বীকারোক্তির পরে তাঁকে নিয়ে কতো সমালোচনা-ই হবে, অথবা এতটা জীবন পার করে আসতে বুঝি ওনাকে এমন অনেক সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছিল আগেই, ততদিনে হয়তো উনি এসবে নির্লিপ্ত হয়ে গেছেন …. সেই আত্মীয়ার সাথে আমার আর কোনোদিন দেখা হয়নি, তবুও আমি তাঁকে ভুলিনি!
তারপরে যতো বড়ো হয়েছি দেখেছি সমাজে সমলোচিত কে? যে মেয়ের নিজের একটা জীবন আছে, যে মেয়েটা মা হওয়ার পরেও সুন্দর করে সাজে, যে নিজের খেয়াল রাখে, নিজেকে priority দেয়, যার জন্য ক্যারিয়ার-টা গুরুত্বপূর্ণ তারা সবাই খারাপ, সবাই….. এরা সবাই স্বার্থপর….
আর ভালো কারা?? যে মানুষ নিজেকে সঁপে দিয়েছে ভাগ্যের হাতে, যে নিজের বিরুদ্ধে অন্যায়ের প্রতিবাদ করে না, যে মুখ বুজে মেনে নেয়….! কি অদ্ভুত, কি অদ্ভুত!
“দেখেছো এই বয়েসেও নিজেকে কি মেইনটেইন করেছে, আসলে সংসার ঠেলতে হয়না যে!”
“সারাদিন পরে বাড়ি ফেরে, সংসার কে সামলায়?”
“আর কতদিন পড়বে? বিয়ে করবে না নাকি?”
“বিধবা মহিলা, রঙীন শাড়ী পরে”
“বিধবা হয়ে মাছ খায় গো”
“মেয়েদের এতো জেদ ভালো নয়, একটু মানিয়ে নিলেই সংসারটা টিঁকত ”
এসব অসংখ্য কাঁটা, কথার কাঁটাকে পায়ে দলে, রক্তাক্ত হয়ে যে মানুষগুলো লড়াই করে আমাদের এগিয়ে নিয়ে গেলেন, তাঁরা সবাই কিন্তু “খারাপ মহিলা”।
অথচ স্রোতের বিপরীতে চলা যে মানুষগুলো লড়াই করে গেলেন, নিজেদের বিশ্বাসের কথা জোর গলায় বলে গেলেন, আর সমাজের চোখে “খারাপ মহিলা”-র তকমা পেয়েও আজকের প্রজন্মের লড়াইটা আরেকটু সহজ করে দিয়ে গেলেন, তাঁদের তো কখনো বলাই হলো না, “কুর্নিশ তোমাদের লড়াইকে, তোমরা এক একজন যোদ্ধা” ❤️
P. S: এই লাইনগুলো এই লেখার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক কিনা জানিনা, তবুও আজকে এই লাইনগুলো সারাদিন গুনগুন করেছি, তাই মনে হলো এই লেখাটার সঙ্গে থাক –
“দেখো প্রিয়তমা আকাশে উড়ছে প্রীতিলতার নিশান,
স্বামী বা কর্তা শব্দগুলোকে করে ফেলে খান খান;
চারকোল রাঙা কপালের ভাঁজে আটকে যাচ্ছে রোজ,
একুশে মৃত্যু তবুও মেয়েটা আজও করে প্রতিরোধ।
তার বাবা মাও দিয়েছিল কিনা, বিয়ের জন্য চাপ,
ইতিহাস বই ভুলে গেছে, বিলকুল।
তাকেও ধিঙ্গি বলেছিল কিনা পাশের মানুষ জন,
সেটাও কিন্তু জানা নেই নির্ভুল।”৷ (আকাশ চক্রবর্তী)
শিল্পী: Subrata Paul