হাসপাতালে ক্যাম্পাসের মধ্যে অনেকগুলো বড় বড় গাছ আছে। বেশ ঝাঁকড়া। সূর্য মাথার ওপরে উঠলে অনেকটা জুড়ে ছায়া দেয়। তিন-চারটে গাছ হোস্টেলের ছাদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ছাতার মতো ঢেকে রাখে। সারাক্ষণ পাখিদের কিচিরমিচির। কখনও-সখনও কোকিলের ডাকও ভেসে আসে। গাছের তলায় রোগীর বাড়ির লোকেদের ভীড়। ত্রিপল বা খবরের কাগজ পেতে খাওয়াদাওয়া। ওখানেই একটু গড়িয়ে নেওয়া। পাশের ত্রিপলের লোকেদের সাথে পরিচয় হয়। সুখ-দুঃখের ভাগবাঁটোয়ারা চলে। একসাথে চানাচুর মুড়ি খাওয়া হয়। ডিমের ঝোল কিংবা আধখানা পাউরুটি খুব সহজেই থালাবদল করে। দুটো ত্রিপলের মাঝের দূরত্ব কমতে থাকে। ত্রিপল দুটো জুড়ে গেলে মাঝের জোড়া জায়গায় আরও একজনের শোয়ার জায়গা হয়। দূরত্ব মানে শুধুই অপচয়। গোলাপী রঙের সস্তা ত্রিপল থেকে সীমান্তের কাঁটাতার… দূরত্ব শুধুই ভাঙার গল্প বলে। কখনও রাতের নিস্তব্ধতা ফুঁড়ে মাইকে ঘোষনা হয়-
“তেরো নম্বর ওয়ার্ডে রতন সাহার বাড়ির লোক যোগাযোগ করুন।”
বাইরে রতনের বাবা তখন ঘুমিয়ে কাদা। পাশের ত্রিপল থেকে কেউ হরেনের কাঁধে ঠেলা দেয়।
“তরে ডাকতেসে রে হরেন… উঠ, উঠ!”
****
দোলের জন্য আজ আউটডোর বন্ধ। সেই পরিচিত চিৎকার-চেঁচামেচি, লোকে-লোকারণ্য ব্যাপারটা নেই। চারদিক কেমন নিশ্চুপ। কয়েকজন আউটডোর খোলা আছে ভেবে ভুল করে এসে পড়েছে। তারা ইমার্জেন্সিতে দেখাবে বলে লাইন নিয়ে দাঁড়িয়েছে। রোদটা এর মধ্যেই বেশ চড়া হয়ে গেছে। বাইরে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। ইতিউতি ছড়িয়ে থাকা রোগীর বাড়ির লোক কোনোরকমে কাজ মিটিয়ে তাড়াতাড়ি ফিরতে চায়। আবার পরে একদিন আসতে হবে। বাড়ি ফিরতে সেই বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। গেটের মুখের হোটেলটায় দুপুরের খাওয়া সেরে নিতে হবে। মাছ-ভাত খেলে ষাট টাকা করে তিন প্লেট একশো আশি টাকা। অত খরচ করার বিলাসিতা নেই মঈনুদ্দিন সর্দারের। সাথে বৌ আর আট বছরের মেয়ে রুকসানা।
– তিন পিলেট সব্জিভাত দিবে ত… দুটা কাঁচালঙ্কা দিঅ
খড়ি ওঠা পা চুলকোতে চুলকোতে মঈনুদ্দিন ভাতের জন্য হাপিত্যেশ করে থাকে। খাওয়ার টেবিলের পাশে মস্ত ফ্রিজ রাখা। সামনেটা কাচ দিয়ে ঘেরা। ভেতরের সব জিনিস দেখা যায়। মা’র হাত টেনে রুকসানা ফিসফিস করে বলে…
– নীল প্যাকেটে দই না মা? মোকে একদিন খাবাবে?
মাথার ওপরে জংধরা ফ্যানটা শব্দ করে ঘুরতে থাকে। ঘররররর…
****
হাসপাতালের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা দাদা-দিদিরা রঙ নিয়ে মেতেছেন। রোজ শক্ত চোয়ালে হাসপাতালের দরজা পাহারা দেন। ভিজিটিং কার্ড মিলিয়ে ভেতরে ঢোকার ছাড়পত্র দেন। লাইন ঠিক করা, হাজারো উটকো ঝামেলা সামলানো; সেসব তো আছেই। মুখ চোখ দেখলে যে কারো মনে হবে বুঝি বা পাথর দিয়ে তৈরি। আজ তাঁদের অন্য রূপ। আবীরে ঢেকে যাচ্ছে মুখ। আবীরে ঢেকে যাচ্ছে শক্ত চোয়াল, পাথুরে চোখ। আজ রঙের দিন, হাসির দিন। ক্যাম্পাসের মধ্যে পুলিশ ফাঁড়িও আছে। সাদা পোশাকের এক পুলিশ কর্মী গান ধরেছেন। লোকে অবাক চোখে তাকাচ্ছে। ওই সাদা পোশাকেও বসন্ত আসে তাহলে?
সকালের রাউন্ড তাড়াতাড়িই শেষ হয়ে গেছে। এবার বাড়ির লোকের সাথে কথা বলার পালা। তাড়াতাড়ি খাতাপত্রের কাজ সেরে নিচ্ছি।
– ডাক্তারবাবু… ডাক্তারবাবু…
বেশ জোরে ডাক। আইসিইউ’র মধ্যে এরকম হঠাৎ জোরে ডাকের সাধারণত একটাই অর্থ হয়। স্যাচুরেশন পড়ছে, হাত পা ঠান্ডা… দ্রুত ভাবতে ভাবতেই ডাকটা খুব কাছে চলে এলো।
– ডাক্তারবাবু সুমনা একবার আমাকে ‘মা’ বলে ডাকলো…
এনকেফেলাইটিস নিয়ে সুমনা ভর্তি হয়েছিল। ক্রমাগত খিঁচুনি। একেবারে অজ্ঞান। মাথার ছবিতে সাদা সাদা ছোপ। অনেক ওষুধপত্র দিয়ে খিঁচুনিটা বন্ধ হয়েছে। আজ তিন দিন হ’ল ভেন্টিলেটরেরও প্রয়োজন হচ্ছে না। তবে কথা বলার ক্ষমতা হারিয়েছিল একেবারেই। মাঝে মাঝে কিছু অর্থহীন চিৎকার, এইটুকুই। অব্যক্ত চোখে কী যেন বলতে চায়। পারে না। বিছানাতেই পেচ্ছাব-পায়খানা। আবার একবার প্রায় চিৎকার করে উঠলো সুমনার মা-
– এক্ষুনি একবার ‘মা’ বললো সুমনা।
এতক্ষণ খেয়াল করিনি আমাদের বসার টেবিলেও একটু আবীরের রঙ লেগেছে কখন।