ভর দুপুরে দরজায় ধাই ধপাধপ। — খোলেন খোলেন
কে আবার! পাড়াচড়ানি স্যাঙাতনি। কোঁচড় থেকে দুটো টুসটুসে গাছপাকা আম বের করে ফিসফিস করে বলে–রাখেন রাখেন, দারুণ মিষ্টি।
আমি খেইমেই করে উঠি–নেব না নেব না। কার গাছ থেকে চুরি করে এনেছ।
কান মুচড়ে ভাবলেশহীন মুখে বলে – মা কালির দিব্যি, কারো গাছে আঁকশি দিই নি, পায়ের কাছে এসে পড়লে কি করব।
–এমনি এসে পড়ল? এ আম কার গাছের আমি বিলক্ষণ চিনি। ভটচাযবাড়ি ছাড়া পাড়ায় কারো এ গাছ নেই।
–ভটচাযবাড়িতে শেকড়, ডালপালা তো সব ঘোষ বাড়িতে, সারাদিন পাতা ঝেঁটোতে হয় তো এই শর্মাকেই। যে কটা এদিকে পড়েছিল দুটো করে সবাইকে বিলি করছি। নিজের পেটে সয় না–।
–তা হোক, আমি নেব না যাও।
স্যাঙাতনি একটু মনমরা হয়ে ফিরে গেল।।
বাগানের সব কটা গন্ধরাজ লেবু আমার গোনা। পাঁচিলের দিকে দু’চারটে করে রোজ হাওয়া। সেদিন দেখি নীল নাইটি স্যাট করে সরে গেল। সাঁঝের বেলা ধরলাম খপ করে — আমার লেবু কে নেয় বল দেখি?
স্যাঙাতনি কোমড়ে ওড়না পেঁচিয়ে গলার শিরা ফুলোতে লাগল — পেকে গিয়ে সব গাছতলায় লুটোচ্ছে, নিজেরা খাবেন না অন্যদেরও দেবেন না –দত্ত বাড়িতে লেবুগাছ নেই, ওরা সবাই ডালে লেবু চটকে ভাত খেতে ভালোবাসে। দিলাম দুটো। তাতে দোষের কি হল?
লাও ঠ্যালা! চুপ করে যাই। এ যদি ‘চুরি’ হয় ‘সমবন্টন’-কে কি নামে ডাকবো বল?
মুখুজ্জে বাড়িতে বিলেত থেকে মেয়ে জামাই এসেছে– লাউশাকের পোস্ত খাবার সাধ। অসময়ে বাজারে মিলছে না। স্যাঙাতনির কানে গেল।
–দাঁড়ান। দেখছি। পাঁচ নম্বর স্ট্রিটে একটা বাড়িতে দুটো লাউডগা দেয়ালের এপাশে দেখেছি কাল। সুয্যি উঠতেই এক থলে লাউডগা এনে ফেলল।
মুখুজ্জে গিন্নি আঁৎকে উঠলেন — অ্যাঁ– কার বাড়ি থেকে আনলি রে?
–ওসব ভাবতে হবে না। পাঁচিলের এপাশ থেকে একটু টান মারতেই এতগুলো ডগা হাতে এল, চিন্তা কোরোনা। ও আবার গজাবে– মেয়েকে ভালো করে কষিয়ে রেঁধে দাও। বলেই দে ছুট ।
কোনোদিন পথে যেতে দেখি আঁকশি দিয়ে কারো গাছের পেঁপে পাড়ছে। চীৎকার করি– এই কর কি কর কি? মার খাবে একদিন।
–আপনে কাজে যান। ওই বাড়ির কাকুর খুব পেটখারাপ–একটু পেঁপে কাঁচকলা দিয়ে মাছের ঝোল ভাত করে দেব।
আমাদের পাড়ার ফল ফুলুরির এরকম বেশ সুন্দর বিলিব্যবস্থা। গাছ কিন্তু কখনো একেবারে ফাঁকা হয়না, সবাই জানে। রাতদুপুরে যদি মনে হয় একটা তাজা কাঁচালঙ্কা হলে আলুচোখাটা জমত ভালো–স্যাঙাতনির কানে গেলে ঠিক পেয়ে যাবেন। নিজে একা মানুষ, এক বাড়ির আউট হাউসে বাউল ফকির দিন কাটায়, সত্যিই এসবের ভাগ নিজে নেয় না।
পার্কে আছে একটা দৈত্যের মতো বেল গাছ –মগডাল, মেজ সেজ ছোট ডাল ভরা শ্রীফল ঝুলতে থাকে। কেউ পেড়ে খায় না। পাড়বে কি করে? গাছে চড়তে জানা আর রণপা দিয়ে হাঁটা — দুটোই এখন বিলুপ্ত বিদ্যা। বেল পাকে। পাখিদের তাতে কিছু যায় আসে না। ভোরবেলা স্যাঙাতনি কুড়িয়ে নিয়ে আসে। বাড়ি বাড়ি বিলি করে। কোঁচড় থেকে বার করে দুটো বেল — নেন, এটা কারো বাড়ির নয়। পার্কের তলা থেকে কুড়োনো –আপনার ধম্ম যাবে না।
আজ নিলাম–আর কিন্তু আনবে না।
সেই বোশেখ মাসে বেলের শরবত খাইলাম এবার খোলা লইয়া করি কি? কিছুই তো ফেলতে মন চায় না। রঙ বুলিয়ে হল একটা ক্ষুদে প্ল্যান্ট পট। এখন, স্যাঙাতনি খুব খুশি– কিছু দেবার সুযোগ পেয়েছে–এভাবেই আমার ক্ষ্যাপামিরা আস্কারা পায়, গাছ তলার পচা ফাটা বেল খোলা দেখলেই স্যাঙাতনি এনে দেয়–আর আমি —