সংবাদপত্রে প্রকাশ এক ব্যক্তির মৃত্যুর পরে তাঁর মৃতদেহ নিয়ে শুধু একটা শংসাপত্রের (ডেথ সার্টিফিকেট) জন্য তাঁর বিধবা স্ত্রী পাঁচ ঘন্টা দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছিলেন। ভদ্রলোক টিবিতে আক্রান্ত ছিলেন। চিকিৎসকের অমানবিক মুখ।
ইতিহাসের পাঁচালি
বছর পনেরো আগের কথা- কিম্বা আরও আরও বেশী বছরের। দক্ষিণ কলকাতায় এক ডাক্তার খুনে সহায়তার অভিযোগে গ্রেফতার এবং ডাক্তারির লাইসেন্স বাতিল। পরে জামিন পেয়ে সেই খুনী ডাক্তার আত্মহত্যা করেন।
এক গভীর নিশুতি রাতে, যখন দক্ষিণ কলকাতা আরও জনশূন্য, নিবিড় অন্ধকারে ঢাকা থাকতো, সেই সময় এক ডাক্তারের বাড়ির দরজায় ধাক্কা পড়লো। “ডাক্তারবাবু, ও ডাক্তারবাবু”
সেই ডাক্তার ঘুমচোখে দরজা খুলে হতভম্ব। পাড়ার এক মাঝবয়সী মানুষ। হাঁফাচ্ছেন। বিশ্রস্ত বেশবাস। ঘর্মাক্ত। “কি হয়েছে?”
“রমা (অবশ্যই কাল্পনিক নাম) আর নেই।” ভদ্রলোক আক্ষরিক অর্থেই ভেঙে পড়েন। রমা নাম্নী মহিলা ঐ ডাক্তারের রোগী ছিলেন। কিছুদিন আগেই ব্লাড প্রেসার আর শুগার নিয়ে চেম্বারে এসেছিলেন।
ডাক্তার নিজেও হতচকিত। “বয়সও তেমন কিছু হয়নি…. কী হয়েছিলো?”
“ও তো রাতে অনেক বার উঠতো… হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখি পাশে নেই…বাথরুমের আলো জ্বলছে… গিয়ে দেখি….” ভদ্রলোক দুহাতে মুখ গোঁজেন।
ডাক্তার দ্রুত জামা পরে ন্যান। অভ্যাসবশতঃ হাতে চিরসঙ্গী ব্যাগটা তুলে ন্যান। ভদ্রলোক দরজা হাট করে খোলা রেখেই চলে এসেছেন। এ সময়ে কে’ই বা মাথা ঠিক রাখতে পারে? আলো জ্বলছে, ডাক্তার সোজা বাথরুমে চলে আসেন। চেনা বাড়ি,চেনা মানুষ, কাছের মানুষ, পাড়ার মানুষ।
সত্যিই ভদ্রমহিলা বাথরুমে চৌবাচ্চার পাশে নিথর শুয়ে আছেন। চোখের মণি স্থির। আলোয় কোনও পরিবর্তন নেই। হৃদস্পন্দন স্তব্ধ। এখন রাত তিনটে। আগামীকাল আবার পাঁশকুড়ায় চেম্বার। ছটায় বেরোতে হবে। ডাক্তার অভ্যস্ত হাতে ডেথ সার্টিফিকেট বা মৃত্যু শংসাপত্র লিখে শয্যালগ্ন হয়। না হলে ভদ্রলোকের অনেক ভোগান্তি হবে।
পরের দিন সন্ধ্যায় ডাক্তার গ্রেফতার।
শ্মশানের কর্মীদের সন্দেহ হয়েছিলো। একা একা একজন মানুষ শ্মশানে এসেছে! ডেথ সার্টিফিকেট আছে, তাতে কী?
বডি আটকে পোস্ট মর্টেম (ময়নাতদন্ত) হয়। মাথার পেছন থেকে ভোঁতা কোনও জিনিস দিয়ে আঘাত করায় মহিলার মৃত্যু হয়েছে।
বাল বাল বাঁচ গ্যয়ে
এই ঘটনাটা ডক্টর’স ডায়ালগে ‘মেঘ ছেঁড়া আলো’ নামক ক্ষুদ্র লেখনীতে স্থান পেয়েছিলেন। আমার এক বিনামূল্যের রোগী। রংচটা লুঙ্গি, ফতুয়াধারী। লাংসে ক্যানসার। অন্তিম দিন ঘনায়মান।
সকাল দশটা নাগাদ কিছু মানুষ এসে উদ্বিগ্ন মুখে বলেন “উনি মারা গেছেন। যদি একটা সাট্টিফিকেট…”
সব শুনে টুনে বুঝলাম ঘন্টা দুই আগে ওনার এন্তেকাল হয়েছে। বললাম “আর দু ঘন্টা পরে পুরোনো কাগজপত্র নিয়ে আসবেন”
একটু পরে ইনা মিনা খাতুনের মা, আলুথালু উদভ্রান্ত, এসে বললো “ও ডাক্তার দাদা এই সাট্টিফিকেট তুমি দিও নি। বুড়ো উইল করার আগেই ওরে ওরা মুখে বালিশ চাপা দে মেরে ফেলছে”
সেই লোকগুলো অন্য কোনও ডাক্তারের সার্টিফিকেট নিয়ে অথবা সার্টিফিকেট ছাড়াই কবর দ্যায়। পরে ঐ দেহ এক্সহিউম (কবর খুঁড়ে বার করা) করা হয় এবং ময়নাতদন্তের পরে দোষীদের শাস্তি হয়।
অবশেষে বোধোদয়
আমি রোগীর জন্য হৃদয়ে দয়া রাখি। বাড়ির লোকের জন্য নয়। আমি রোগীর মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ি, মৃত্যুর কারণ চাপা দিতে নয়। আমি আমার রোগীদের ভালবাসি। কোনোদিন ডেথ সার্টিফিকেট লিখে পয়সা নিই নি। আবার অনায্য সার্টিফিকেট দিই নি। ময়নাতদন্ত বিজ্ঞানকে এগিয়ে ন্যায়। ময়নাতদন্ত রোগীর মৃত্যুর কারণ খুঁজে বার করে।
একটা সত্যি গল্প বলি? হেব্বি হেব্বি ডায়লগ আছে। পুরো অঞ্জন চৌধুরী (নাম ভুলে গেছেন? শত্রু এবং আরও অনেক বইয়ের পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার)।
প্রবল শীতের রাত্রি। আমার দুয়ারে কয়েকজন চাদরমুড়ি লোক। হৌসকল। গেলাম। একজন মৃত ব্যক্তির শংসাপত্র দিতে হবে। এলাকা পচুইয়ের গন্ধে ম ম করছে।
“আমি সার্টিফিকেট দেবো না”
“লোকডা মরি গৈল আর সাট্টিফিকেট লিতি কুথাকে যাবো?” চোখে ক্রোধ, কপালের শিরা ফুলে উঠেছে।
“দিবি না মানে শালার ডাক্তার, পুঁতে রাখবো” মোটামুটি ভীড় চারপাশে। আমাকে যারা ঘিরে আছে কিছু খুশবুদার মানুষ- গা থেকে মুখ থেকে দেশীয় আসবের গন্ধ।
আমি স্থিরপ্রতিজ্ঞ। “এই সার্টিফিকেট আমি দেবো না”
“আমরাও তোকে ছাড়বো না” হিসহিস করে ওঠে একজন।
“বেশ তো আমি থাকছি, আমাকে একটা মোড়া টোড়া কিছু দিন”
এবং আশ্চর্যের ব্যাপার মোড়াটা এসে পড়ে। বসে নিশ্চিন্ত হই।
“খুব ভালো কথা। তাহলে সকালে দুটো সার্টিফিকেটের ব্যবস্থা করবেন”
ক্রমশঃ রাত শেষের দিকে পৌঁছয়। কুয়াশা ঘন হয়ে শিশির হয়ে ওঠে। ঘাসে মাখামাখি করে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে শুয়ে থাকে। মন্দ লাগছিলো না। দু একটা কাক আধোঘুমে স্বপ্নে ডেকে উঠছে। সারারাত পোকা খেয়ে ক্লান্ত ফিঙে বিজলিতারে বসে ডেকে ওঠে। সারারাত ও কর্কশ সুরে ডেকেছে। এখন শিস দ্যায়।
লোকগুলো একটা রিক্সাওয়ালাকে বলে “জ্ঝাঃ,মালটাকে পৌঁছে দিয়ে আয়”
রিক্সাওয়ালা প্যাডেলে চাপ দিতে দিতে বলে “ভালো করেছো দাদা। জুয়ার পয়সা নিয়ে গন্ডগোল.. প্যাটে লাত্থি মারতেই…. ব্যস”
পরের দিন খবর পেলাম দেহ দাহ হয়ে গেছে। কোনও সদাশয় ডাক্তারবাবু তাদের পরম কাঙ্ক্ষিত সাট্টিফিকেট দিয়ে দিয়েছেন। মৃতের আবার কিসের দাম? কিসের সহানুভূতি? মালটা তো মরেই গেছে।
ঐ সাট্টিফিকেট চাওয়া লোকগুলো এখন বুড়ো হয়েছে। এখনও বাঁধানো গাছতলায় বসে বিড়ি ফোঁকে। আমাকে দেখলে চোখ নামিয়ে ন্যায়। হয়তো সময়ের বিচারে আমিই জয়ী।
ডাক্তারবাবুরা দীর্ঘজীবী হৌন। মৃত্যু শংসাপত্র লিখে যান। মহত্বগিরি আনলিমিটেড। চলুক।