বিপুল তরঙ্গ রে, আমার অন্যতম প্রিয় গান। কিন্তু এখন ওয়েভ, ঢেউ এইসব শব্দ শুনলে মনে এক অজানা আতঙ্ক চলে আসে। বিশাল এই ঢেউ যে কারো ঘর ভেঙে দেয়, সংসার তছনছ করে দিতে পারে তা কল্পনাও করতে পারিনি। শুনবেন কীভাবে?
সুমি আমার পুরনো পেশেন্ট। বাচ্চার চেষ্টা করছিল। কোভিডের জন্য চিকিৎসা বন্ধ ছিল। পরশু সুমি চেম্বারে এসেছিল, দিদি আর মায়ের সঙ্গে। আকাশ সঙ্গে ছিল না। কী রে কেমন আছিস? সুমি পায়ের দিকে মুখ করে বলল, এবার পিরিয়ডের সমস্যার জন্য এসেছি। সুমির মা ‘একটু আসছি’ বলে বেরিয়ে গেলেন। ওষুধ লিখে জানতে চাইলাম, আকাশের কী ওয়ার্ক ফ্রম হোম না কি আগের মতো ট্যুরে যেতে হচ্ছে। সব বাঁধ ভেঙে সুমি কেঁদে উঠল।
… চোখের জলের লাগলো জোয়ার দুঃখের পারাবারে,
হল কানায় কানায় কানা়কানি এই পারে ওই পারে।
কৃষের ডেলিভারি আমার হাতে হয়েছিল। এখন পাঁচ। ভ্যাকসিন নিতে এসে আমার সঙ্গে হঠাৎ দেখা। কৃষ্ণেন্দুর সঙ্গে নাম মিলিয়ে সায়ন্তনী রেখেছিল। সায়ন্তনী নজর কাড়ত ওর লাল লিপস্টিকের জন্য। সিজারের দিন আমার কাছে বকুনি খেয়েছিল লাল লিপস্টিক পরে ভর্তি হওয়ার জন্য। বকা খেয়ে হেসে বলেছিল, বাচ্চার সঙ্গে সেলফি নিতে হবে না। একটু না সাজলে হয়! আমরা সবাই হেসে উঠেছিলাম।
‘কীরে কৃষের ওজন ভীষণ বেড়ে গেছে। সারাদিন অনলাইন ক্লাস আর টিভি দেখে? এক্সারসাইজ করছে না?
স্যর, কৃষ্ণেন্দু চলে যাবার পর আমি এখন বাবা, মায়ের কাছে থাকি। কৃষও খুব জেদি হয়ে গেছে। যা চায় বাবা, মা তাই এনে দেয়।
কবে হল?
গত মাসে। সব চেষ্টাই করেছিলাম স্যর, হেরে গেলাম। সায়ন্তনী মাস্ক পরেছিল। তাই ওর লিপস্টিক না পরা ঠোঁট, না-হাসি মুখটা আমাকে দেখতে হল না।
..আমার তরী ছিল চেনার কূলে, বাঁধন যে তার গেলো খুলে
তারে হাওয়ায় হাওয়ায় নিয়ে গেল কোন অচেনার ধারে।
শোভনবাবু ওনার স্ত্রীকে নিয়ে এসেছিলেন। দুজনেরই বয়স ৫০ ছুঁতে চলেছে। যা জানলাম, তিন মাস আগে কোভিডে ওঁদের একমাত্র ২০ বছরের সন্তানকে হারিয়েছেন। ওনার স্ত্রীর দৃঢ় বিশ্বাস, আধুনিক চিকিৎসায় উনি আবার মা হতে পারবেন, হারিয়ে যাওয়া ছেলে ওনার কোলে ফিরে আসবে। যাবার আগে বাস্তববাদী শোভনবাবু বলে গেলেন, ডাক্তারবাবু কেউ ফিরে আসুক বা না আসুক, আমি আর কাউকে হারাতে চাই না।
…সেই পথ হারানোর অধীর টানে অকূল পথ আপনি টানে
দিক ভোলাবার পাগল আমার হাসে অন্ধকারে।
ওপরের তিনটে ঘটনাই সত্যি। এদের অনেকেই আপনারা চেনেন, এরা হয়তো আমার আপনার পরিবারের কেউ।হয়তো চেনেন না। এদের হারিয়ে যাওয়া আপনজনের ছবির তলায় RIP, ওম শান্তি, আর পারা যাচ্ছে না, ভগবান তুমি নেই–এমন কমেন্ট করেছেন। সেই ছবিগুলো আমার আপনার হতে পারত।
শুধু সরকারের ভরসায় না থেকে আসুন আমরা সবাই নিজেদের সাধ্য মতো চেষ্টা করি যেন আর কোনও ঢেউ না আসে। কোন দিশা হারা রাতে আকাশের তারায় আপনজনকে না খুঁজতে হয়।
?
আপাততঃ পাথর হয়ে আছি। মৃত্যু তরঙ্গ।