কিছুদিন আগেই মাটির পাঁচ কিলোমিটারেরও নিচে ভয়ঙ্কর তাপমাত্রায় আলো বাতাসহীন খাদ্যহীন প্রায় অমর অচেনা এক বিরাট জীব জগতের খোঁজ পাওয়া গেছে। যার আয়তন প্রায় আমাদের সবকটা মহাসাগরের সম্মিলিত পরিমাণের দ্বিগুণ। আর মোট ওজন পনেরো থেকে চব্বিশ বিলিয়ন টনের বেশী। এটুকুই এখনও পর্যন্ত জানা গেছে। হয়তো আরও বড় আরও বিস্তৃত এই জীবজগত। এটা জানতে হলে আমাদের যেতে হবে সুদূর দক্ষিণ আফ্রিকার এক বিস্তীর্ণ পাথুরে অঞ্চলে।
দক্ষিণ আফ্রিকার কাপাভাল ক্রেটন। দুই মহাদেশের অন্তর্বর্তী কৃষ্টাল পাথরের তৈরি এক বিস্তীর্ণ পাথুরে এলাকা। জুরাসিক যুগের পাথরও সেখানে পাওয়া যায়, এমন কি প্রিক্যাম্ব্রিয়ন যুগের পাথরও সেখানে পাওয়া গেছে। সাধারণভাবে এই পাথরদের বয়স ৫৪০ মিলিয়ন বছর বলে ধরা হয়। পরীক্ষায় জানা গেছে কেউ কেউ আবার ২ থেকে ৩ বিলিয়ন বছরের পুরোনোও আছে! ব্যাপারটা জটিল। একটা বিশেষ কৃষ্টাল পাথরের অঞ্চলে কোটি বছরের পুরোনো পাথর! এই প্রাচীন কৃষ্টালাইন বেড রক জাতীয় পাথরেরা পৃথিবীর মাটির স্থিতিশীল অবস্থা বজায় রাখে। এরা দক্ষিণ আফ্রিকার সন্নিহিত অঞ্চলে একটা টেক্টোনিক প্লেট তৈরি করে রেখেছে অর্থাৎ এই সেই প্লেটেরা যাদের নড়াচড়ায় তৈরি হয় ভূমিকম্প -ওঠে সুনামী। অস্থির হয়ে ওঠে পৃথিবী। ধ্বংস হয়ে যায় জনপদ। আবার সেই রুক্ষ জায়গার পাশেই আছে এক সোনার খনি। Mponeng বাংলা নিকটতম উচ্চারণ সম্ভবতঃ এম্পনেং সোনার খনি। যেটা চার কিলোমিটার গভীর। এতে দুটো সোনালী ধাপ (gold reef) আছে। এর এক টন মাটিতে দশ গ্রাম সোনা পাওয়া গেলেই কোম্পানি লাভের মুখ দেখে। তাই মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে গভীর থেকে গভীরতর হয়ে ওঠে সোনার খনি। খুঁড়তে গিয়ে নিয়মিত মাটি পরীক্ষা করা হয় যাতে টেক্টোনিক প্লেটের কোনও ক্ষতি না হয় – তখনই প্রথম এই প্রাচীন অজানা এক অদ্ভুত জীবজগতের খোঁজ পাওয়া যায়। এক অদ্ভুত ধরনের জীব – যাদের সঙ্গে পৃথিবীর কোনও প্রাণীর মিল নেই। এরা কেউ এককোষী – কেউ বহুকোষী বা অ্যার্কিয়া। ব্যাপারটা বিজ্ঞানীদের চমকে দেয়। তারপর বাহান্নোটা দেশের এক হাজার দুশো বৈজ্ঞানিক ডীপ কার্বন অবজারভেটরি চালু করে সেখান থেকে কাজ আরম্ভ করেন। ক্রমশঃ এই বিষয়ে জানার জন্যে অনেক দেশের বৈজ্ঞানিকরা মিলে একটা প্রকল্প চালু করেন। আমেরিকার শক্তি বিষয়ক মন্ত্রক এবং সুইডেনের কৃষ্টালাইন বেড রক এই গবেষণায় অর্থ সাহায্য করতে শুরু করে। অ্যাটলান্টিকের সাউথ ক্যারোলিনায় এই কেন্দ্র চালু হয়। ক্যারেন লয়েড (এ্যাসোসিয়েটেড প্রোফেসর, ইউনিভার্সিটি অফ টেনেসি, ক্নক্সভিলা) এই প্রকল্পের কর্ণধার। আমেরিকান জিওফিজিক্যাল ইউনিয়নের তত্ত্বাবধানে ভূতাত্ত্বিক, জীববিজ্ঞানী, পদার্থবিজ্ঞানী রসায়নবিদ সবাই মিলে এই গবেষণা চালিয়ে যেতে থাকেন। জাপানি জাহাজ চিকায়ূ তার যন্ত্রপাতি নিয়ে সমুদ্রের বহু গভীরে গর্ত খুঁড়ছে। অর্থাৎ জোর কদমে কাজ চলছে।
বিজ্ঞানীরা আশ্চর্য হয়ে ভাবছেন পৃথিবীর এতো গভীরে অক্সিজেন ছাড়া আলো ছাড়া জল ছাড়া প্রাণের অস্তিত্ব কিভাবে সম্ভব? মাটির বহু নিচে অবস্থান; এই অঞ্চলের নাম তাই সাবটেরেনিয়ান বায়োস্ফিয়ার। আবার আলোহীন এক গভীর অন্ধকারে রয়েছে এই জীবজগৎ তাই অনেকেই একে ডার্ক বায়োস্ফিয়ারও বলেন। দেখা যাচ্ছে এই সব প্রাণীরা মিথেনোজেন। অর্থাৎ এদের অক্সিজেন লাগে না। মিথেনোজেন ব্যাপারটা একটু বিশদ করা যাক। পৃথিবী যখন অগ্নিগোলক থেকে সদ্য ঠান্ডা হয়েছে। তখনও পৃথিবীতে জল নেই। অক্সিজেনও নেই। আছে কেবল হাইড্রোজেন নাইট্রোজেন মিথেন আর অ্যামোনিয়া। এই সময়ে সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মির ক্রিয়ায় কিছু কিছু জীবনের উপযোগী কিছু নাইট্রোজেন বেস তৈরি করে ফ্যালে তার মধ্যে ইউরাসিল আর সিস্টোসাইনই প্রধান। এরাই জীবনের প্রথম পদক্ষেপ। এরথেকেই তৈরি হয় এইসব এককোষী এবং ক্রমশঃ বহুকোষী প্রাণীর দল। মনে রাখতে হবে তখন প্রাণের জন্য পৃথিবীতে প্রয়োজনীয় জলও নেই – অক্সিজেনও নেই – তাও এরা বেঁচে ছিলো।
এই ফাঁকে আমরা জল আর অক্সিজেনের উৎপত্তির একটা সহজ রূপরেখা দিয়ে ফেলি।
শোনা যায় ভেস্টা নামেরএকটা জলভরা উল্কা এসে পৃথিবীর সঙ্গে ধাক্কা খায় এবং তার ফলে পৃথিবীতে জল আসে। সে যেভাবেই হোক না কেন তাতে এই জীবজগতের কোনও ব্যাঘাত ঘটছে না।তখন সেই জল থেকে অতি বেগুনি রশ্মির জন্য অতি সামান্য কিছু অক্সিজেন হয়তো তৈরি হতো কিন্তু সেটা হালকা বলে ম্যাধ্যাকর্ষণ ছাড়িয়ে উড়ে যেতো। সুতরাং ওজোন স্তরও নেই। এবং মনে রাখতে হবে এখন মনে রাখতে হবে ওজোন স্তর নেই বলে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের বাইরে অর্থাৎ ওজোন স্তরের বাইরের তাপমাত্রা প্রায় দুশো ডিগ্রি এবং মেসোস্ফিয়ারের তাপমাত্রা হাজার ডিগ্রি থেকে চার হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়ে থাকে। তখনও ওজোন স্তর ছিলো না – সুতরাং পৃথিবীর তাপমাত্রাও ছিলো ভয়ানক বেশী। এইসব প্রাণী সেইজন্যই উচ্চতাপ আর অক্সিজেনহীন অবস্থাতেও বাঁচতে পারে। অক্সিজেন না থাকায় এরা তখন মিথেন গ্রহণ করে এবং মিথেনই ত্যাগ। করে। এদের থেকেই মিউটেশন বজ্রপাত এবং অতিবেগুনি রশ্মির জন্য সম্ভবতঃ সমুদ্রের জলে অ্যালগী তৈরি হয় যারা প্রচুর অক্সিজেন তৈরি করে’ বাতাস অক্সিজেনে ভরে দ্যায় এবং ক্রমশঃ ক্রমশঃ ওজোন স্তর তৈরি হয়। এই পদ্ধতিতে প্রাণ আসতে সময় লাগে প্রায় দুই বিলিয়ন বছর। সেই থেকেই এইসব মিথেনোজেনরা মাটির গভীরে আরও গভীরে চলে যায়। এবং সেখানেই বেঁচে থাকে।
আবারো মনে রাখতে হবে ওজোন না থাকলে পৃথিবীর তাপমাত্রাও ভয়ানক বেশী হতো। তাই মাটির নিচে দুশো পঞ্চাশ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশী তাপমাত্রায় এরা দিব্য বেঁচে আছে। অথচ অন্য সব প্রাণী ঐ তাপমাত্রায় মরে ভুত হয়ে যায়। এছাড়াও এরা যে পরিমাণ মাটির চাপ শরীরে বহন করে তাতে অন্য সব প্রাণীই চিঁড়েচ্যাপ্টা হয়ে যাবে। অথচ এরা বেঁচে আছে। শত সহস্র বছর ধরে সেই প্রাগ-ডাইনোসর যুগ থেকেই।
এদের আরও কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। এদের মৃত্যু নেই। এরা সমস্ত চাপ তাপ সহ্য করে শত সহস্র বছর ধরে বেঁচে আছে – জল এবং অক্সিজেন ছাড়াই। কেবলমাত্র শরীরের ধ্বংস হওয়া অংশটুকু সারিয়ে নেয় তারপর অতি ধীর গতিতে নিজেদের জৈবক্রিয়া চালিয়ে যায়। এদের শ্বাসপ্রশ্বাস আর সমস্ত শারীরিক কাজকর্ম অত্যন্ত ধীরে ধীরে হয়। তাই অনন্ত কাল ধরে বেঁচে থাকে। সেই জন্যেই প্রথম এদের সন্ধান পাওয়া যায় কেবলমাত্র অতি প্রাচীন পাথরের মধ্যে । এখন দেখা যাচ্ছে গোটা পৃথিবীর সমস্ত জায়গায় মাটির তলায় এরা আছে। এমনকি সমুদ্রের গভীরতম অঞ্চলের মাটির দুই কিলোমিটার নিচে পর্যন্ত মাটি খোঁড়া সম্ভব হয়েছে। সেখানেও ওরা আছে। এবং বহাল তবিয়তে আছে। এরপরে কেউ যদি বলে মহাশূন্যে বা সূর্যের গভীরেও কোনও জীবন্ত প্রাণী আছে হয়তো বা সেটাও বিশ্বাস করে নিতে হবে। হয়তো কোনদিন মাটির ওপরে ওরা এসে বাঁচাতে শিখে যাবে। তখন এই অচেনা প্রাণীজগতের আচার আচরণে হয়তো মানবপ্রজাতি বিপন্ন হয়ে পড়বে। অথবা ভূপৃষ্ঠের এত কম বায়ুচাপে ওরা ধ্বংস হয়ে যাবে।