ডাক্তার হরিপদ দত্ত সম্প্রতি কর্মহীন হয়ে পড়েছে। একেবারেই কোনও কাজ নেই তার। ব্যাপার কিছুই না। মাত্র ছেচল্লিশ বছর বয়সে তার নশ্বর দেহ পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে গেছে। এখন সে পঞ্চহাজার ভূতের আবাস এই যে অশথ গাছ তার ডালে দোল খাচ্ছে। যেহেতু তার সমাজ এখন ভৌতিক, আর কে না জানে একবার ভূত হয়ে গেলে আর প্রাণভয় থাকে না, কাজেই ভৌতিক আবহে হরিপদর কাছে পেশেন্ট আসার প্রশ্নই নেই।
এই অশত্থ গাছটা বলতে নেই, ভূতে একদম গিজগিজ করছে। ভূতোপোযোগী বনস্পতি প্রোমোটারদের দাপটে এ অঞ্চলে একদমই কমে গেছে। এই গাছটায় তাই হরিপদকে একদম গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বাস করতে হচ্ছে ঘিঞ্জি মেট্রোপলিসের মত।
তার নিজের মা বাবা আগেই গত। মাঝে মধ্যেই আট বছরের কন্যা আর তার মা মানে নিজের বউয়ের কথা মনে পড়লে হরিপদর বুকটা হু হু করে ওঠে। আসলেই দেরি করে বিয়ে করেছিল। ডাক্তারি পাশ করার পর কিছু ডিগ্রি টিগ্রি যোগ করতে করতে বয়স বেড়ে গেল। প্লেইন এমবিবিএস ডাক্তার আর কেউ দেখাতে চায় না। প্লেইন এমবিবিএস যা জানে তার থেকে ডাঃ গুগল জানে অনেক বেশি। তাই রোগ ব্যাধি হলে নেট সার্চ করে চিকিৎসা চালায় লোকে। রোগ বাঁকা পথ ধরলে, তখন স্পেশালিষ্ট, সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল।
তারপরে মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলে। একটু থিতু না হলে বিয়ে করার সাহস পায়নি। এই করতে করতে বিয়ের বয়েস হয়ে গেল সাঁইত্রিশ আটত্রিশ।
থিতু মানে রোজগার। একদম শেষে সে ছিল একটা ছোটোখাটো হাসপাতালে। বেসরকারি সেই হাসপাতালের মালিকটি ব্যবসায়ী। তার পারিবারিক প্রচুর ব্যবসা। রিয়েল এস্টেট, ইটভাটা, আধা চিটফান্ড গোছের মাইক্রোফিনান্স, গরু পাচার এই সবের পরও এক্সট্রা কিছু টাকা ব্যাঙ্ক লোন জোগাড় করে ছোটো জামাইকে দহেজের শর্ত অনুযায়ী একটা ব্যবসা ফেঁদে দিতে হবে।
সেই ছেলে আবার লেখাপড়া জানে কিছু। পড়াশুনো করে শ্বশুরকে বলল, – হসপিটাল আর হসপিটালিটি একই ল্যাটিন অরিজিন বাবামশাই। হোটেল খুলব না হসপিটাল খুলব ভেবে দেখি।
অনেক ভাবনার পর সেই জামাইয়ের জন্য হাসপাতাল খুলে দিয়েছিল সদু লাহিড়ি। সেই লাহিড়ি মরেছে বছর পাঁচেক আগে। তার সঙ্গেও দেখা হল এইখানে। তাকে বলাই হল না তার গুণধর জামাইয়ের কথা। কীভাবে কী কী কায়দায় বিল বাড়াচ্ছে। নানান ছুতোয়, কনজিউমেবলসের নাম করে আর প্রাইভেট সেমিপ্রাইভেট, ভিআইপি স্যুট, আইসিইউ, এইচডিএউএর চক্করে মসৃণ ভাবে দশ দিনের বিল আট দশলাখ টাকায় দাঁড় করাচ্ছে সেই গুটখাখোর জামাই। তার মধ্যেও ডাক্তারদের ফোনে আর মুখোমুখি চমকায় বদমাশটা।
ইনভেসটিগেশন বাড়াও, ডাক্তার সাহেব। সিটিস্ক্যান করাও, এমআরআই, পেটস্ক্যান করাও। আরও হাজার গন্ডা জিনিস করাও। আর শোনো, কোনও পেশেন্টকে ফালতু মায়াদয়া করার ব্যাপার নেই। কেস হলে সামলাতে পারবে না।
কেউ কেউ অবাধ্য হয়।
বাতাসে গুজব, অবাধ্য ডাক্তারকে টাইট দিতে মরে যাওয়া পার্টিকে দিয়ে কেস অবধি করিয়েছে দু চারটে। উকিলটুকিলও জোগাড় করে দিয়েছে। ডাক্তারকে প্যাঁচে ফেলে নড়বড়ে রাখতে হয়। নইলে বিজনেস চলে না।
লাখ লাখ টাকায় ডাক্তারের পাওনা এক পার্সেন্টও না। কিন্তু তাকে হ্যাপা পোয়াতে হয় সেন্ট পারসেন্ট। পেশেন্ট পার্টি ভাবে চশমখোর ডাক্তারটাই ওই আট দশলাখ পুরোটা সাঁটিয়েছে। আর পেশেন্ট মরলে? সে তো ডবল ধামাকা। নার্সিং হোমে ভাঙচুর হলে ইনশিওরেন্স রয়েছে। মালিকের নিজের জন্য আছে বডিগার্ড, বাউন্সার, পুলিস মায় এমএলএ, এমপি, মন্ত্রী।
মারমুখী ক্ষুব্ধ জনতার মার? তা’ খাবার জন্য রয়েছে বেচারা ডাক্তার সিস্টার আর কিছু স্টাফ।
লাহিড়ি মানে ওই সতু লাহিড়ির ভূত হরিপদকে জিজ্ঞেস করেছিল, – তা হ্যাঁ হে ডাঃ দত্ত, তোমার তো বয়েস পঞ্চাশও পেরোয়নি। তুমি এই চত্বরে পৌঁছুলে কী করে?
– পরে বলব, সে অনেক গপ্পো। বলে বিতৃষ্ণায় মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল ভূতপূর্ব ডাক্তার, অপিচ বর্তমান-ভূত শ্রীমান হরিপদ।
তবে বউ মেয়ের জন্য মনখারাপটুকু বাদ দিলে সব মিলিয়ে কিন্তু হরিপদ ভালোই আছে। নো টেনশন। ওই যে আগের জীবনে সকাল থেকে উদ্বেগ আর আশঙ্কা মেশানো এক জীবন। আজ চেম্বারে পেশেন্ট হবে কি না, চেনা পেশেন্ট অন্য কারও আন্ডারে ভর্তি হয়ে গেল কিনা এইসব ঘটমান বর্তমান আর ঘটমান ভবিষ্যতের চিন্তা তো ছিলই। তার ওপরে ছিল গত দিনগুলোর জন্য চিন্তা। চেম্বারে দেখানো কেউ খারাপ হয়ে গেল কিনা। ভর্তি কোনও পেশেন্টের নাভিশ্বাস উঠল কি না।
এ’দেশে নিয়ম হচ্ছে, রুগী বাঁচলে বাঁচে নিজের ক্যালিতে, আর বাড়ির লোকের ভাগ্যে। আর মরলে মরে শয়তান ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায়। নইলে মরবার কথাই না।
ভারতে মানুষের গড় আয়ু পঁচাত্তর না কত যেন, ওটি কথার কথা। কুষ্ঠি অনুযায়ী সবার চিরজীবী হবার কথা। তো এই চিরজীবী পেশেন্টকুলকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব এক আর এক মাত্রই ডাক্তারের।
সত্যিই এই টেনশন আর নেওয়া যাচ্ছিল না, ভাবে ভূতপূর্ব ডাক্তারটি। মরে গিয়ে যেন বেঁচেছে! অথচ বাঁচার ইচ্ছেও ছিল তার ষোলো আনাই। কত ভেবেছিল ডাক্তার বন্ধুরা মিলে কোঅপারেটিভ করে একটা কলোনি বানাবে। সেখানে থাকবে একটা ফ্রি ক্লিনিক আর পথশিশুদের জন্য একটা ইস্কুল। সেই সব স্বপ্ন, স্বপ্নই রয়ে গেল।
মাঝে মধ্যেই দেখা হয়ে যায় কত চেনাজানাদের সঙ্গে। এই যেমন সে’দিন দেখা হল তারক মাস্টারের সঙ্গে। হরিপদ এমবিবিএস পাশ করার পর, পাড়ার দোকানে বসেছিল দিন কতক। সেই সময়ে দেখাতে এসেছিলেন তারক স্যার। তখনও অবধি, হরিপদ কী বলে, ওই প্লেইন এমবিবিএসই। তাই ফিজও ছিল খুব কম। কী হয়েছিল মনে নেই। দেখানোর পর কিচ্ছুটি না ঠেকিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। চেম্বারের সামনে বসা অ্যাসিস্ট্যান্ট ফি চাইতেই, স্যার ঝাঁঝিয়ে উঠেছিলেন, – ফি? হরিপদর স্যার আমি, তায় এক পাড়ার লোক। আমি ওকে ফিজ দেব?
দেনওনি। অথচ হরিপদ যখন ক্লাস নাইনে অঙ্কে ফেল করেছিল, এক সাবজেক্টে ফেল বলে প্রোমোটেড উইথ ওয়ার্নিং। হরিপদ বিপদে পড়ে ওঁর কোচিংএ গেছিল। ভর্তি হতে পারেনি পয়সার অভাবে। এই যুক্তি খাটেনি, যে, সে স্যারের ছাত্র আর একই পাড়ায় থাকে।
ফিজ না পাওয়া হরিপদ, তারকস্যারকে বলতে পারেনি, আলু পেঁয়াজ, সবজি, মুদির দোকান মায় ওই অ্যাসিস্ট্যান্ট ছোকরাকেও পয়সা দিতে হয় ট্যাঁকের থেকেই। হরিপদ অ্যাদ্দিনে নিশ্চিন্ত। স্যারের প্রেতকে আর অসুখের জন্য দেখতে হবে না। তবু পুরোনো অভ্যাসে বলেছে, দেখা হবার পর, – স্যার, ভালো থাকবেন।
তারক স্যার ঠোঁট উলটে, সেই আগেও যেমন বলতেন, বললেন,
– আর থাকা! ভূত প্রেতরা কেউ অঙ্ক শিখতেই চায় না। এসে অবধি কোচিংটা শুরু করতেই পারলাম না!
গত পরশু একটা বাচ্চা মতন ছেলেকে খুব মুখচেনা মনে হল। ব্যবহারটা ভারি ভালো। আলাপ হতে খোঁজ নিল হরিপদ।
সেই ছেলে বলল, – হ্যাঁ, স্যার, আমার ছবি পেপারে বেরিয়েছিল। ওই জন্যেই আমাকে চেনা মনে হচ্ছে আপনার। আমি স্যার ওই যে মুকুন্দপুরের হাসপাতালে সিনিয়র রেসিডেন্ট ছিলাম। কোভিডে ভুগে এ’খানে এলাম।
ওই ছেলের সঙ্গে মিশেই আরও ক’জন অতি অল্প বয়সী ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ হল। সবাই ছিল কোভিড যোদ্ধা। ও’দের দুজনকে নাকি গত বছর পাড়ায় ঢুকতে দেয়নি পাড়ার লোকেরা। লোকাল কমিশনার হাত উলটে বলেছিল,- জনতার আদালতই শেষ কথা বলবে। আমার কিছু করার নেই।
হরিপদকে জিজ্ঞেস করেছিল ছেলেদের একজন,- স্যার, ইয়ে, আপনিও কি কোভিডেই?
হরিপদ ওকে বলতে পারেনি কথাটা। যে লজ্জার কথা ওই লাহিড়িকেও বলতে পারেনি। হরিপদ মরেছে হার্ট অ্যাটাক হয়ে।
কেন?
ওই লাহিড়ির জামাইয়ের অবাধ্য ছিল সে। বারবার বলার পরও একটা ডিফেকটিভ ভেন্টিলেটর সারানোর ব্যবস্থা হয়নি। ওকে মিথ্যে কথা বলেছিল নার্সিং হোমের পোষা ম্যানেজারটা। সেই ভেন্টিলেটরের ম্যালফাংশনে একটা পেশেন্ট মারা যাবার পর, আড়াল থেকে পেশেন্ট পার্টিকে খেপিয়েছিল লাহিড়ির জামাই স্বয়ং। তাদের মধ্যে মিশে নার্সিং হোমের এক বাউন্সার ব্যাপক পিটিয়েছিল ওকে। মাথা ফেটেছিল, দাঁত পড়ে গেছিল, হাতে ফ্র্যাকচার… তাও হয়েছিল। সে সব সেরে যাচ্ছিল। কিন্তু স্ট্রেস স্ট্রেন আর এই সদ্য পাওয়া তীব্র অপমানের চাপে, বেচারার হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেল।
হরিপদ খবর পাচ্ছে অবস্থা ক্রমেই আরও খারাপ হচ্ছে চারিপাশে। তার পর থেকেই সে এই অশত্থের ডালে দোল খাচ্ছে আর অপেক্ষা করছে।
অল্প বয়সে ডায়াবেটিস আর ব্লাডপ্রেশার ধরছে ডাক্তারদের এত টেনশনে টেনশনে থেকে। হরিপদ অপেক্ষা করেই চলেছে। করবেও। কবে বাকি ডাক্তারেরা আসে।
তারপর ভূতপূর্ব ডাক্তার-ভূতেরা মিলে না হয় একটা ভৌতিক কলোনি বানাবে। তার সেই স্বপ্নের ফ্রি ক্লিনিক আর হ্যাঁ ইস্কুলটাও থাকবে সে’খানে।