রেফার রোগ অর্থাৎ আননেসেসারি রেফারালের সর্বজনগ্রাহ্য কারণ খুঁজতে সিস্টেম এনালিসিস করে প্রথমেই যেটা মাথায় আসে তা হল – উপযুক্ত সংখ্যায় উপযুক্ত ডাক্তার ও অন্যান্য কর্মীর অভাব। সংখ্যার বিষয়টা পরে আসছি। আগে এই উপযুক্ত ডাক্তার শব্দটা নিয়ে নাড়াচাড়া করা যাক।
বিশেষজ্ঞ ছেড়ে অ-বিশেষজ্ঞ বা সাধারণ ডাক্তারের কথা আগে, সরকারি পরিভাষায় যাদের নাম জেনারেল ডিউটি এম ও। ধরুন একটি ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র। তাতে নিয়ম অনুযায়ী যত জন GDMO থাকার কথা তাই আছে। তাহলে কি অপ্রয়োজনীয় রেফারাল আটকানো যাবে? যাবে না। এক এক করে আসুন।
নলেজের ঘাটতি। সাপের কামড় গত বারের পরীক্ষায় এসেছিল তাই এবারে সেটা না পড়েই পরীক্ষা দিতে যাওয়া ও এমবিবিএস পাশ করে যাওয়া সম্ভব। ফলে সেই ডাক্তার ডিউটিতে থাকলে সাপে কাটা রুগী রেফার হবেই।
স্কিলে ঘাটতি। এপিসিওটমি রিপেয়ার করতে জানে না, নরমাল ডেলিভারি নিজের হাতে কোনোদিন করায়নি এমন জিডিএমও দেখেছি। পোস্টিরিয়ার ন্যাজাল প্যাকিং দিতে পারে না, ছোট বাচ্চাদের ফ্লুইড চালাতে পারে না এমন ডাক্তারও দেখেছি। সেই ডাক্তার ডিউটিতে থাকলে ওই সব কেস রেফার হতে বাধ্য। দোষটা তার নয়, সিস্টেমের দোষ। সিস্টেম তাকে সুযোগ দিয়েছে এই ভাবে বেড়ে ওঠার।
এবারে আসুন নেক্সট পয়েন্টে। এক্সপেরিয়েন্সের ঘাটতি। ডার্মাটোলজির ইন্টার্নশিপের সময় কোনো কুষ্ঠ রুগী দেখেনি। অগত্যা সাসপেক্ট কেস এলেই রেফার। একজন ডাক্তার কেস ডায়াগনসিস করতে পারছে না অভিজ্ঞতার ঘাটতির জন্য, সে জীবনে জলাতঙ্ক রোগীই দেখেনি। কিন্তু তার সহকর্মী দেখেছে। তার সাথে কনসালটেশনের কোনো চল নেই। জেলাস্তর থেকে তার নিচের হাসপাতালে কোনো ক্লিনিক্যাল মিটিং, ক্লিনিক্যাল অডিটের চল নেই, প্যাথলজিক্যাল অটপসির ব্যবস্থা নেই।
বেশ বোঝা যাচ্ছে যে স্রেফ উপযুক্ত সংখ্যায় ডাক্তার দিলেই রেফার আটকানো যাবে না। নলেজ, স্কিল, এক্সপেরিয়েন্সের ঘাটতি মেটাতে মেডিক্যাল এডুকেশন, ট্রেনিং, পরীক্ষা পাস, পাস করার পরে Continuing Medical Education বা CME – এই গোটা সিস্টেমটা নিয়েই ভাবতে হবে।
জেলা স্তরে ক্লিনিক্যাল বিষয় যেমন ডেঙ্গু ম্যানেজমেন্ট, বা পয়জনিং-এর ট্রেনিং-এও দেখেছি ২০- ২৫% অনুপস্থিত থাকেন। অতএব মেকানিক্যালি CME কথাটা উচ্চারণ করলেই সমস্যা মিটবে না। সরকারি চাকরিতে ঢোকার পরে উপযুক্ত সময় ধরে সবার ইনডাকশন ট্রেনিং হোক, নিয়ম কানুনের পাশাপাশি এসেন্সিয়াল SOP গুলোও আলোচনা হবে। IAS-দের ট্রেনি থাকতে হয় কত দিন?
এবার আসুন। এটিচুডের ঘাটতি। একই কেস একই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে একজন দেখে দিচ্ছে আর অন্য জন রেফার করছে। দুজনের যোগ্যতা একই এমনটাও দেখেছি। যে রেফার করছে তার দৃষ্টিভঙ্গি কিঞ্চিৎ ভিন্ন। সে হয়তো ঝুঁকি নিতে চায় না, কেস কিছুটা খারাপ , মরে গেলে রুগীর বাড়ির লোকের হাতে মারধর, বা CPA ইত্যাদি। এই দৃষ্টিভঙ্গি কি ভাবে পাল্টানো যাবে সে মস্ত প্রশ্ন। গ্রামীণ স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিতে নিরাপত্তার ন্যূনতম ব্যবস্থা না করে বা আধা শহরের মহকুমা / জেলা হাসপাতালগুলিতে প্রশিক্ষণ বিহীন নিরাপত্তা কর্মীদের দিয়ে নাম কা ওয়াস্তে ব্যবস্থা করে কি ভাবে ডাক্তার সহ অন্যান্য কর্মীদের মনে নিরাপত্তার ভাব জাগানো যায় সেটা মস্ত চ্যালেঞ্জ।
ধরা যাক কোনো এক যাদুমন্ত্র বলে ওপরের বর্ণিত ওই ঘাটতিগুলি মেটানো গেল। এবারেও কি রেফার আটকানো যাবে? ডাক্তার একদম ঠিকঠাক, কিন্তু ধরুন যদি উপযুক্ত পরীক্ষা নিরীক্ষার সুবিধে না থাকে? ছোট গ্রামীণ হাসপাতালের কথা ছেড়েই দিন, কটা জেলা হাসপাতালে ২৪ x ৭ এক্স-রে, ইসিজি, প্যাথলজি, বায়কেমিস্ট্রির ব্যবস্থা থাকে? হয় মেশিন নেই, অথবা টেকনিশিয়ান/ টেকনোলজিস্ট নেই অথবা রিয়েজেন্ট নেই, মেশিন আছে, কিন্তু সেটা বিকল। বিকল মেশিনকে তাড়াতাড়ি সচল করার কোনো ফুলপ্রুফ সিস্টেম এদ্দিনেও তৈরি করা গেল না। কেন গেল না? উপযুক্ত সংখ্যায় ডাক্তার না পাওয়ার একটা যুক্তি আছে। কিন্তু প্যারামেডিকেল বা নার্সিং স্টাফ না পাওয়ার কি যুক্তি আছে। একটিবার খোঁজ করে দেখুন তো শেষ কবে MT lab বা MT opto রিক্রুটমেন্ট হয়েছে ?
আর এই উপযুক্ত সংখ্যা কথাটাই তো ভীষণ গোলমেলে। সরকারের ম্যানপাওয়ার নর্ম হল ১৯৯১ সালের establishment table নামের একটি বস্তু। তার পরে গঙ্গা তিস্তা দিয়ে কত জল গড়িয়ে গেল, Indian Public Health Standards, Quality Assurance কত কি ম্যান পাওয়ার নর্ম এলো গেল কিন্তু সেই ৯১-এর টেবলের কোনো রিফর্ম হল না। রিফর্ম বাদ দিন। ওই টেবিল অনুযায়ী কটা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে, মহকুমা হাসপাতালে কর্মী নিযুক্ত আছে? সব ধরনের কর্মীর অপ্রতুলতা। এমন কি কেরানিদেরও। আপনি বলবেন রেফার আটকাতে কেরানীর কি ভূমিকা? আরে বাবা, একটা চিঠি, ধরুন যন্ত্র খারাপ সেটা লিখতে বা ডাক্তারদের ছুটির হিসেব রাখতেও তো ডিলিং এসিস্ট্যান্ট লাগে। PSC বাদ দিয়ে নিজস্ব হেলথ রিক্রুটমেন্ট বোর্ড তৈরি হয়েছিল এসবের জন্য। তারা করেটা কি ? ডোমের পোস্ট ফাঁকা। তাদের জন্য একটা সঠিক TOR তৈরি করা গেল না ? PhD ক্যান্ডিডেট এপ্লাই করছে আর লোকে হাসছে।
আর অভাবের সংসারে সবচেয়ে বেশি লাগে প্ল্যানিং। আমাদের ম্যানপাওয়ার প্ল্যানিং-এর নমুনা? রুগী মৃত্যুর পরে কাগজ পড়ে জানা গেল যে জেলা হাসপাতালে ছয় জন অর্থোপেডিক সার্জেন ছিল। আর এদিকে অন্য জেলা হাসপাতালে একজন মাত্র। এই posting কে করলো কিভাবে করলো, কেন তাকে শো কজ করা হবে না ? দোষ কেবল ক্লিনিশিয়ানদের? সেই স্বাস্থ্য প্রশাসকদের নয়?
সব শেষে আসুন রেফারের সবচেয়ে বাজে কারণটাতে। ফাঁকিবাজি। আপনি যদি দিনের পর দিন দেখেন যে আপনার ফাঁকিবাজ সহকর্মী আর আর আপনি মাসের শেষে একই মাইনে পান, বছর শেষে একই ইনক্রিমেন্ট তাহলে আপনিই বা “বোকা” এর মতো খাটতে যাবেন কেন? পারফরমেন্স বেসড ইনসেনটিভ বলে কিছু নেই। না মানিটারি, না নন-মানিটারি। এর উল্টো দিকে শাস্তি? দূরে বদলির ভয়? অর্ধেক তো চাকরিই ছেড়ে দেয়। আর বদলি হতে হবে জেনে শুনে যারা চাকরিতে আসে তাদের মনে ওই ভয় কতটা কাজ করে বলে আপনার মনে হয়? আর যাদের ভয় আছে তাদের জন্য তো ইউনিয়ন আছে।
আর কাজের পরিবেশ? কষ্ট করে লেখা পড়া শিখে আই-এর মাইক্রো সার্জারি শিখে আসা সার্জেনকে দিয়ে মেডিকো লিগ্যাল পোস্টমর্টেম করিয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করে এই সিস্টেম। নিত্য ঝামেলার জন্য হাসপাতাল সুপারের পোস্ট এখন স্বাস্থ্য প্রশাসকদের কাছে বিভীষিকা। সবাই প্রোগ্রাম অফিসার হতে চায়। আর ক’জন সুপার এর হসপিটাল ম্যানেজমেন্টের ডিগ্রি ডিপ্লোমা আছে-? বড়জোর DPH বা MPH এই তো। ক’জন সিএমওএইচ-এর বড় হাসপাতাল চালানোর অভিজ্ঞতা আছে? প্রমোশন পলিসিতেও গন্ডগোল।
আর আমাদের প্ল্যানিং-এর নমুনা? কোটি টাকা ব্যয় করে সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল তৈরি হল তাতে কোনো অফিস কমপ্লেক্স ঘর নেই। সুপার কি রাস্তায় বসে অফিস চালাব? তাই সই। আরো আজব ব্যাপার হল তাতে ছ’টা OT আছে কিন্তু কোনো ফার্মেসি স্টোর নেই। এত ওষুধ পত্র, যন্ত্রপাতি, লিনেন রাখবে কোথায়? হেন হাসপাতাল নেই যেখানে প্রায় প্রতিমাসে আদেশ আসে ওপর থেকে অমুক ক্লিনিক খুলতে হবে, তমুক OPD খুলতে হবে। আজ জেরিয়াট্রিক, তো কাল টেলিমেডিসিন। সুপার জায়গা বের করবে কি করে সে নিয়ে মাথা ব্যথা নেই ওপরওয়ালাদের। ফলে সংকুচিত হয় সেই ইনডোর, ইনডোরের করিডোর, বারান্দা। ফলে বেড নেই, ফলে রেফার। এ ভাবে কোনো সভ্য দেশে হসপিটাল সিস্টেম চলে না।
সবটা মিলিয়ে খুব জটিল অপ্রীতিকর একটা পরিস্থিতির মধ্যে স্বাস্থ্যকর্তারা রেফার রোগের মোকাবিলায় নেমেছেন। দুটো হাসপাতাল সারপ্রাইজ ভিজিট করে (এই তথ্য প্রযুক্তির যুগে ভিজিট করে কেন জানতে হবে কোথায় “বেশি” ডাক্তার সেটা বোধগম্য নয়, ডাটাবেস কি হল তাহলে?) সেই রোগ সারানো যাবে না। হ্যাঁ ,কিছু লোক খেপিয়ে তোলা যাবে। ইন্ধন যোগানোর জন্য সবজান্তা সংবাদ মাধ্যম তো আছেই।
রেফার রোগ সারাতে গেলে সঠিক তথ্য সংগ্রহ (তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার) করা দরকার সবার প্রথমে। তার সাথে সঠিক যুগোপযোগী চিন্তাভাবনা যুক্ত করে সঠিক পরিকল্পনা করার দরকার। প্রচুর খাটতে হবে, সিস্টেমের খোল নলচে পাল্টে রিফর্ম করতে হবে। দেশ বিদেশের বেস্ট প্রাকটিস মডেলগুলো থেকে শিক্ষা নিতে হবে আর প্রতিপদে সঠিক চেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট টেকনিকের প্রয়োগ করে সব স্টেকহোল্ডারদের এই রিফর্মে সামিল করতে হবে। একা কোনো সুপার বা সিএমওএইচ ধমকে চমকে এটা করতে পারবে না।
সাধারণ মানুষের হয়রানি যাতে কমে (শূন্য করা সম্ভব নয়), গরীব মানুষ যাতে আরও গরীব না হয়ে যায় তার জন্য তার বাড়ির কাছের (ডোর স্টেপ) সরকারি ছোট বড় হাসপাতালে যতটা সম্ভব চিকিৎসা দেওয়া আমাদের দায়িত্ত্ব কর্তব্য এ নিয়ে কোনো বিতর্কই চলতে পারে না। কিন্তু এই সীমিত বাজেট নিয়ে স্রেফ ধমকে চমকে সেই কর্তব্য পালিত হবে কিভাবে – সেই সুস্থ বিতর্ক চলতে থাকুক যতক্ষণ না বাস্তব সম্মত সমাধান সূত্র বেরিয়ে আসে। স্রেফ ডাক্তার নয়, চিকিৎসাকর্মী নয়, সাধারণ মানুষও এই বিতর্কে অংশ নিন।
সব শেষে বলবো আমাদের আশাবাদী হতেই হবে। ২০ বছরের বেশি সময় ধরে এই সিস্টেমটা খুব কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতার নিরিখে বলতে পারি, ডাক্তার সহ অধিকাংশ কর্মচারীরা বেসিক্যালি ফাঁকিবাজ নন, তাঁরা কাজ করতে চান। উপযুক্ত কাজের পরিবেশ চান শুধু, সঙ্গে একটু ঠিকমতো ব্যাকআপ সাপোর্ট সিস্টেম। কোভিডের সময় এই সহকর্মীদের নিয়ে মিরাকল দেখিয়েছি আমরা। সব্বাই ভয়ে পালিয়ে গেছে। তাবড় দাপুটে নেতা মন্ত্রীসান্ত্রিরা হাসপাতালের ৫০০ মিটারের মধ্যে আসেন নি। স্রেফ ডাক্তার আর স্বাস্থ্যকর্মী – এরাই বুক দিয়ে আগলিয়েছে সরকারি হাসপাতালের সিস্টেম। ধমকে চমকে এ জিনিস হয় নি।
সিস্টেম পরিচালকরা আমাদের ওপর ভরসা রাখুন, আমাদের পাশে দাঁড়ান সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে। আমরা নিরাশ করবো না।