প্রশ্নঃ-
আপনি ফেসবুকে এত সময় কেন দেন? মনে হয় না জীবনের অপব্যয়? তার ওপর হোয়াটসঅ্যাপ টুইটার…
উত্তরঃ-
এই উত্তরটা অর্থাৎ কেন ফেসবুকে এত সময় দিই, বলার আগে একটা গল্প বলে নিই।
যদিও আমার টাইম লাইনে রয়েছে, কিন্তু যিনি পোস্ট করে আমাকে ট্যাগ করেছেন তিনি কাস্টম করে রেখেছেন বলে আমার বন্ধু-অবন্ধু আম জনতার দৃষ্টিগোচর সেটি নয়। আশা করি তিনি তাঁর লেখাটি কপি পেস্ট করলে রাগ করবেন না।
না, আমি মোটেই বলব না, উনি রাগ করলে আমার কীই বা এসে যায়! যথেষ্টই এসে-যায়। অল্প লইয়া থাকি তাই… মোর যাহা যায় তাহা যায়।
★
Manjulika Ray সেই পোস্টে লিখেছেন,
“কী অদ্ভুত কাণ্ড!
আমি ক্লাস নাইনে পড়তে কোথা থেকে এই কবিতাটা পেয়েছিলাম তা জানি না কিন্তু আমার প্রথম খাতায় লিখে রেখেছি। কবির নাম অরুণাচল দত্তচৌধুরী দেখে আজ সাহস করে জিজ্ঞেস করেছিলাম। সত্যিই পৃথিবীটা যে গোলাকার তার প্রমাণ আবার পেলাম। কে জানতো যে সেই লেখা কবিতা তাঁর নিজের স্রষ্টাকে খুঁজে নিতে পারবে!
সাম্প্রতিক
(অরুণাচল দত্তচৌধুরী)
নারী মানেই —
রমণীয় অনাবৃতি নয়,
নারী মানেই
বসন ভূষণ শয্যা লজ্জা ভয়–
এমনি ভাবা ভীষণ রকম ভুল।
বস্তুতঃ আজ পুরনো সব অর্থগুলো
পালটে নেবার দিন
কবি মানেই — স্বপ্ন
এবং অবসরে —
হুইস্কি সোডা জিন–
মধ্যযুগের এসব কথা – ভুলতে হবে
আষ্টেপৃষ্টে হাজার শিকল খুলতে হবে।
যৌবন নয় ভাবনা নিছক ‘ আমি এবং তুমি ‘
যৌবন নয় দুমড়ে থাকা নষ্ট হতাশ ভূমি,
এখন নতুন কুরুক্ষেত্রে ইস্পাত নির্যাসে
সহযোদ্ধার ভালোবাসা বুকের কাছে আসে,
ম্লান হয়ে যায় মিথ্যেবাদীর স্তুতি
আমার মায়ের, বধুর চোখে দুরন্ত প্রস্তুতি। ”
******
★
এবারে আমার কথা বলি।
কেন আমি ফেসবুকে এত সময় থাকি।
আমার গৃহিণীপনা নেই বলে কলেজ জীবনের কিম্বা তার আগের পরের কোনও লেখাই সঞ্চয়ে নেই। তার জন্য আফসোস আছে। আবার নেই ও।
আমার এই তুচ্ছ জীবনে আদৌ কিছু লেখালিখির কথা ছিল নাকি?
তো যাই হোক কী করে যেন আমার দুএকটা লেখা সেই সময়ে কলেজে কারওর কারওর চোখে পড়েছিল। মানে পরিচিত একশ জনের মধ্যে দুই বা খুব বেশি হলে তিন চার জনের মধ্যে।
তার মধ্যে একটি পাগলের নাম ছিল শম্ভু মৈত্র। আমার থেকে তিন বছরের ছোট। এসএফআই করত। দেখতে? গৌর বর্ণ। তীক্ষ্ণ নাসা। এক গাল কালো রেশমি দাড়ি। অবিকল যিশুখ্রিস্ট। সে ছিল আমার লেখার থলেদার।
থলেদার জানেন তো মশাইয়েরা? চোরেরা চুরির মাল সরাসরি বিক্রি করে না ধরা পড়ে যাবার ভয়ে। তারা দেয় থলেদারকে। সে হল ওই যাকে আধুনিক পরিভাষায় যাকে বলে এজেন্ট, যে কিনা চোরের কাছ থেকে গোপনে কিনে নেওয়া মাল অল্প অল্প করে বাজারে ছাড়ে। থলেদার কে ধরা অত সোজা নয়। সে নিয়মিত প্রণামী দেয় থানা সহ সব প্রয়োজনীয় জায়গায়। তো শম্ভু ছিল আমার চোরাই মালের থলেদার।
চোরাই? আজ্ঞে হ্যাঁ, তাইই। আমি টুকে লিখি। অদ্যাবধি। বর্ণপরিচয় থেকে গতকাল অবধি, যা পড়েছি তার থেকে টুকি। ইদানিং নিজের লেখা থেকেও, তারাপদ রায় যেমন বলেছিলেন, টুকি। নিজে নিজে ভেবে লিখতে গেলে ভাবনা সমূহ ফারমেনটেড হয়ে যায়। গেঁজে গিয়ে চোলাই মদ্য।
চোরাই নইলে চোলাই, এই আমার আউটপুট।
চুরির প্রমাণ দিই।
কলেজ জীবনের একটা লেখা, পুরো মনে নেই, কটা লাইন ছিল, এই রকমঃ-
‘যমুনাবতী সরস্বতী কাল যমুনার বিয়ে
আজ যমুনার শরীর দখল… খিদের সুযোগ নিয়ে!
যমুনা বোন না,
তোকে মরতে দেব না…
আমার বোন জ্বলে উঠুক অগ্নিকন্যা।
ধান রাখতে বাপ মরেছে ভাইটা আটক থানায়
শঙ্কা নিবিড় দু’চোখে তোর অশ্রু কি আর মানায়?’
আমাদের দুই না তিন বছরের জুনিয়র বিপাসা(সেন), লাইব্রেরি দরজার পাশে সাঁটানো আমার নিজস্ব দেওয়াল পত্রিকায় লেখাটা পড়ে, ইউনিয়ন রুমের সামনে কটাক্ষ হেনে বলল, শঙ্খ বাবুর লেখা থেকে চুরি করলে যমুনাবতী নামটা?
এমনিতেই চোরেরা সদাশঙ্কিত থাকে। তায় অভিযোগকারিনী মারকাটারি সুন্দরী বালিকা। ঘাবড়ে গিয়ে বলতেই পারলাম না শঙ্খ বাবুও তো সেই পুরোনো যমুনাবতী থেকেই…
বেশ বড় ছিল এই লেখাটা। তার এক জায়গায় ছিল,
‘অজস্র সুখ নীল হয়ে যায়, সে কোন সাপের বিষে…
পেছন ফেরার রাস্তা বন্দী একশ চুয়াল্লিশে!’
এই জায়গাটা শম্ভু বড় আবেগ দিয়ে বলত।
সেই শম্ভু, সীমা ও বল্গাহীন যাপনে অভ্যস্ত সেই উজ্জ্বল যুবক, এনজেপি স্টেশনে আজ থেকে বহুদিন আগে নেহাতই অসময়ে হার্ট অ্যাটাকে চলে গেল।
আমার প্ল্যান ছিল, ওর লিখে রাখা খাতা বা স্মৃতির কাছ থেকে আমার কলেজ জীবনের লেখা গুলি শুনে শুনে টুকে নেব। আমি কবেই বা সময়ের কাজ সময়ে করেছি! শম্ভুর চিতায় চলে গেছে আমার কলেজ জীবনের সব লেখা।
সেই সমস্ত লেখাই ছিল ঘোর বিপ্লবগন্ধ মাখা। ছত্রে ছত্রে অর্ধপাচ্য শ্রেণী সংগ্রাম। তখন আমরা পুচ্ছে আগুন দিলে বোধ হয় সোঁ করে গিয়ে নামতাম কেউ কেউ ক্রেমলিন প্রাসাদের ছাদে। সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের শত্রুরা নামত বেজিং(তখন পিকিং)এ মাও সেতুংএর বাড়ির উঠোনে।
চুপিচুপি স্বীকার করি, সব লেখাতেই যে কড়া বিপ্লবের গন্ধ থাকত তা না। কিছু নরম সরম লেখাও লিখতাম। হ্যাঁ, অন্যরকম কবিতা আর গদ্যও। হায়, বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ সেই লেখাগুলি, খোলসা করে বললে প্রেমপত্রগুলি, লিখে ফেলার পরপরই চলে যেত প্রাপিকাদের কাছে।
আমার ধারণা, তার একটা অংশ না পড়েই ছিঁড়ে ফেলা হত। আর বাকিগুলো বিনষ্ট হয়েছে পাত্রীদের বিয়ের আগে। কালের প্রভাব এড়িয়ে কি টিকে আছে একটিও?
সেই যে, বালিগঞ্জ প্লেসের ঠিকানায় পাঠানো সেই চিঠি। দক্ষিণ কলকাতার কন্যা বলে সম্বোধনে সুদক্ষিণা। সেই চিঠিটির বয়ান ছিল, এই রকম
সুদক্ষিণা শোনো,
তোমাকে যা বলতে চাই, তার মধ্যে ভান নেই কোনও।
আমার তো কাজ শুধু দিনরাত ওই মুখ ভাবা
যতই পাহারা দিক, দিনেরাতে… ডাকসাইটে বাবা
পারিজাত-প্রেম-অর্ঘ্য নাও করপুটে
স্বর্গের গন্ধটি যার ঢাকা পড়বে না…
ঢাকা পড়বে না জেনো বাবার চুরুটে।
এরপরে গদ্যে কিছু অনুনয় বিনয়ের পরে
অন্যদের চাইতে নিজের ভালোত্ব মানে নিজের নির্মলতা প্রকাশের প্রয়াসে আবার কাব্য,
‘সুদক্ষিণা শোনো,
অনুপের মত আমি বালিগঞ্জ প্লেসে যাইনি।
বিরক্ত করিনি
আর করিনি তো ফোনও।
এ’রকম হাবিজাবি কিছু প্রলাপের পর পুনরায়,
‘সুদক্ষিণা শোনো,
তেইশটা চিঠির পর উত্তর দাওনি এখনও।’
আবার কিছু প্রলাপের পর ক্ষেদোক্তি,
‘সুদক্ষিণা, শোনো,
উত্তর দিচ্ছো না? একি!
আয়নায় নিজেকে দেখি…
দু চোখের নীচে কালি
গাল ভরা ব্রণ।’
পুনশ্চ কিছু প্রলাপ।
আর তার পর অন্তিম সন্দেহ প্রকাশ,
‘সুদক্ষিণা শোনো,
ঘ্যানঘেনিয়ে এত ভাবে
কেউই কি তোমাকে পাবে?
আমি হেন দুর্ভাগা কি আছে এক জনও?
আমাকে দিয়ে এই সব পাপেভরা পত্র লেখাতো আমার সিনিয়ররা, সহপাঠীরা। এই লাইনে আমার বেশ নাম ছড়িয়েছিল। বলতে লজ্জা করে, লেখাতো দুএক জন জুনিয়রও। পারিশ্রমিক দিয়ে। মজুরি বেশি না। চা, ওমলেট, সিগারেট। না পারলে চা বিস্কুটই সই।
সেই সব ফরমায়েশি লেখা নাই বা থাকুক, শম্ভুর কাছে থাকা লেখাগুলো তো থাকতে পারত।
তো, যা বলছিলাম, হারিয়ে যাওয়া লেখাগুলোর একটা, অন্তত একটা ফেরত পেলাম এই ফেসবুকের দৌলতে। মঞ্জুলিকার সৌজন্যে।
সেই সে আমলে, কিছু লিখলে সেই চিরকুট পকেটে নিয়ে ঘুরতে হত। ঠিকঠাক শিকার পেলে তাকে পাকড়ে সেই লেখা পড়ালে তবে শান্তি!
কলেজে ঢুকে অন্যরা পাত্তা দিত না বলে লাইব্রেরির দেওয়ালের পাশে চিটকেছিলাম নিজস্ব দেওয়াল পত্রিকা। আরে বাবা, কাউকে তো পড়াতে হবে।
না, কনফিডেন্সের অভাবে আর আলস্যে, বড় ছোট কোনও পত্রিকায় পাঠাতাম না লেখা। পাঠিয়ে সেই বসে থাকো। ছ’মাস একবছর। তত ধৈর্য ছিল না আমার।
কলেজ ম্যাগাজিন ‘রূপান্তর’এ বার দুয়েক লেখা বেরিয়েছিল বটে। কিন্তু লিখেই তাৎক্ষণিক কাউকে পড়ানো মানে প্রকাশিত হবার মজাই আলাদা। স্বর্গীয় আনন্দ প্রায়।
এই সব বালখিল্যপনার পরে গ্রামে পোস্টিং। আমি যথারীতি উদ্যমহীন। স্থানীয় পত্রিকায় যদি বা লিখতে বলত কেউ,(আহা, ডাক্তার বলে কী মানুষ না! লিখতে ইচ্ছে হয়েছে, লিখুক।) একঘেয়ে নির্দেশ আসত, – জ্বর কিম্বা জন্ডিস নিয়ে লিখে দেবেন তো এক দু পাতা!
দুঃখের চোটে লেখাই ছেড়ে দিলাম। একেবারে ছাড়লাম তা নয়। সরকারি ডাক্তারদের সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের নিউজলেটারে দু একটা পদ্য আর গদ্য। সে সব লেখাও কালের গর্ভে (পড়ুন ভোগে) চলে গেছে, কবেই।
গ্রাম ছেড়ে শহরতলিতে এলাম। সোদপুরে। তখন ফেসবুক ছিল না। অর্কুট। মনে হল প্রকাশ মাধ্যম খুঁজে পেলাম।
প্রথমের দিকে সেখানে ঢুকতে আবার অর্কুটে আগের থেকেই রয়েছে এমন কারও রেকমেন্ডেশন লাগত। বড় ছেলের অর্কুট রয়েছে, কিন্তু সে রেকো দেবে না। কী, না তার প্রাইভেসির সর্বনাশ হয়ে যাবে!
চেম্বারে দেখাতে আসা এক মেয়ে, নাম মনে আছে, পিয়ালি, রেকমেন্ড করে দিল। সে সময় কমপিউটারে অর্কুট। তখন তো মোবাইলে এত কারিকুরি ছিল না। সেই নোকিয়া ফোনের যুগ।
তারপরে এল ফেসবুক। এ আমার প্রথম যৌবনের সেই নিজস্ব দেওয়াল পত্রিকাকেই ফিরিয়ে দিল যেন। যাই লিখি, যা ইচ্ছে তাই, যাচ্ছেতাই সেই সমস্ত স্বপ্রকাশ লেখা এই দেওয়ালে তুলি। কেউ পড়ুক না পড়ুক, প্রকাশিত তো হল।
ফেসবুকে কেন সময় কাটাই, বাড়িতে লাথি ঝাঁটা খেয়েও, এই হল তার জবাবদিহি।
মঞ্জুলিকার কাছ থেকে লেখাটি পুনরুদ্ধারের পর আর দুটো সত্যি ধরা দিল।
একটা জিনিস প্রমাণিত হল। সময় হল সমুদ্রের মত। সমুদ্র যা নেয়… ফিরিয়ে দেয়। হয় তো মৃত। হয় তো অমৃত।
অন্য যা প্রমাণিত হল তা একটু দুঃখের। প্রমাণ হল যে গত প্রায় চল্লিশ বছরে লেখায় আমি এক পাও এগোতে পারিনি। অন্য সমসাময়িক যাঁরা একই সময় লিখতে শুরু করেছেন, কত পথ পেরিয়ে গেলেন তাঁরা। কেউ কেউ লেখা থেকে রিটায়ারও করে গেলেন।
কিন্তু আমি আমার তেইশ বছর পেরুতে পারলাম না। বিপ্লব-প্রেম-অপ্রেম-কবিতা… না কোনও কিছুতেই না। মাঝের থেকে এরা চারজনই আমাকে ছেড়ে চলে গেল, আমাকে সেই তেইশ বছরের মোড়ে দাঁড় করিয়ে রেখে।