??????????
একটা গ্রাম। একপ্রান্তে বাস রাস্তা। বাস স্টপেজ পার হয়েই জঙ্গল। শাল সেগুন পলাশ শিমূল। ছোটো ছোটো নদী। না না নদী নয় তটিনী। শাল পিয়ালের মধ্যে দিয়ে তেচোখা মাছের ঝাঁক নিয়ে তিরতির করে বয়ে চলেছে। রাতে ভালুক আসে। প্রহরে প্রহরে শেয়াল ডাকে। কখনও হাতির দল শুঁড় দুলিয়ে দুলিয়ে রাস্তা পার হয়ে যায়। রাস্তায় বন দপ্তর লিখে রাখে “হাতীদের রাস্তা পার হওয়ার স্থান। সাবধান।”
আরেক প্রান্তে শ্মশান। এখানে কাঠের চুল্লি। কাঠের পরে কাঠ জমিয়ে মৃতদেহ পোড়ানো। শহুরে নাকে কাবাবের মাংস পোড়া গন্ধ আসবে। আস্তে আস্তে ঝলসে ওঠে দেহ। এখানে ডেথ সার্টিফিকেট লাগে না।আজও।
তারও পেছনে মিটার গেজের সরু রেল লাইন। দূর থেকে হাত দেখালে রেলগাড়ি দাঁড়িয়ে যায়। কুউউউউ ঝিক ঝিক ঝিক। ঢেউ খেলানো লাল রুক্ষ মাটিতে রেলগাড়ি চলে– ঢিমে তেতালে।
রাস্তার পাশ দিয়ে দিয়ে সরু সরু লালমাটির রাস্তা। উঁচু নিচু। গায়ে গায়ে বাড়ি। গোয়াল ঘর। এক আধটা মুদির দোকান। এখানে বলে সদায়পাতি। “কি গ্য তুমি আমাদের অমলদার ছেলে না? তা কত্তোদিন পরে এল্যা গো?”
সিগারেট কিনতে পারবেন না। অমলদার ছেলে আপনি। আপনার তখন আর কোনও পরিচয় থাকবে না।
সোজা গেলে চন্ডীমন্ডপ। তারপর ধর্মরাজতলা – গাজনতলা। মাঝে মাঝে একটা করে পুরোনো পুজোর দালান। বাঁধানো। শূন্য পড়ে থাকে। বাড়ির মা দুগ্গারা অবসরে এলো চুলে গল্প করে। আবার পুজোয় সেজে উঠবে। আম্রপল্লবে। আলোয়। গ্রাম সানাইয়ের শব্দে। ঢাকীর বোলে।
তারপরেই নিয়োগীদের পরিত্যক্ত চূণসুরকির তিনতলা বাড়ি। দেওয়াল থেকে বট আর অশত্থ গাছ উঁকি দেয়। গোখরোর শঙ্খ লাগে। জানালায় পায়রারা বক বকম করে। সেই সব ছেড়ে একটু এগোলে খেজুর ধুতরো আকন্দ বাবলা আর রামবেগুনের ঝোপ ছাড়িয়ে গেলে বুড়ো বটতলা। সেখানে আছে তেঁতুল আর বেল গাছ। পাশেই দুধপুকুর। আকন্দ গাছে পাড় ঢেকে আছে। দিনের বেলাই কেউ যায় না। গোখরো চিতি আর কেউটের ভয়ে। তারপরে একটা ঝকঝকে তকতকে বাড়ি। ঢুকেই কামরাঙ্গা আর পেয়ারা গাছ। একটা পুরোনো গল্প বলা পাল্কি। রং চটা।
কামরাঙ্গা আর পেয়ারা গাছের মাঝখানে – বেড়ায় ঘেরা শান্তিপিসির বাড়ি। এক্কেবারে ঝকঝকে। নিকানো দাওয়া। একটা কুটোও পড়ে নেই সেখানে। শান্তিপিসি একা থাকে। বড্ড সুন্দরী। এই পাকা চুল আর মোটা কাচের চশমাতেও। কেন যে বিয়ে করেনি সেটা আজও গোটা গ্রামের অবাক জিজ্ঞাসা। প্রথমে মা মারা যায়। শান্তিপিসির অক্লান্ত সেবার পরেও। তারপর বাবা পড়েন বিছানায়। ব্রেন স্ট্রোক। শয্যাশায়ী হয়ে যায় বুড়ো।
“আমি বে’ করলে এই বুড়াটার কী গতি হতো বল দি’নি?” বিয়ের কথা জানতে চাইলে শান্তিপিসি বলতো।
অবশ্য শোনা যায় কলকাতার বিখ্যাত এক চিত্রতারকা শান্তিপিসির প্রেমে ডুবে ছিলেন। মোদ্দা কথা শান্তিপিসির বিয়ে ঐ গ্রামে একটা চর্চার বিষয় ছিলো।
ক্রমে দিন যায়, বাবার অবস্থা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে ওঠে। সারা রাত পিসি জেগে থাকে। সামান্য একটু শব্দেও বুঝতে পারে বাবা বিছানা ভিজিয়েছে না জল চাইছে। নাওয়ানো খাওয়ানো বিছানা পরিষ্কার – রান্না করা। এত্তো বড়ো বাগান ঝাঁট দেওয়া – পিসির সময় কোথা দিয়ে যায় পিসি নিজেও জানে না।
সেদিন সকাল থেকে বৃষ্টি। ঝমঝম করছে চারদিক। মোটা মোটা কলের মতো জল পড়ছে। দুধপুকুর উপচে পড়েছে। কামরাঙ্গা গাছের গোড়ায় জল। কারেন্ট নেই । শান্তিপিসি সন্ধেবেলা লন্ঠনে তেল ভরে বাবার ঘরে একটা আর নিজের জন্য একটা লন্ঠন নিয়ে একটু সাবু ফুটিয়ে নিলো। লেবু দিয়ে। নুন চিনি দিয়ে। পিসিও তাই খেয়ে নেবে।
ব্যাঙের ডাকে বৃষ্টির শব্দ ঢাকা পড়ে গেছে। জোনাকিরা আজ সব কোথায় গেছে কে জানে? আজ বড্ড অন্ধকার। লন্ঠনের আলো কোনোরকমে ঘরের মধ্যে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। বাইরে পৌঁছচ্ছে না। পিসি বসে রইলো বাবার ঘরের সামনের টানা বারান্দায়। লন্ঠনের কালি জমতে জমতে চোখ অন্ধকার হয়ে এলো। তারপর কখন ভোর হলো। তাকিয়ে দেখে বাবা শুয়ে আছে। চোখে আর ঠোঁটের চারপাশে মাছি বসে আছে। কোনও মাছিই উড়ছে না। স্থির বসে আছে। গাল বেয়ে পিঁপড়ের দল উঠে আসছে। দুধপুকুর থেকে পাঁক পচা গন্ধ আসছে। এক এক করে লোকজন জমা হলো। শান্তিপিসি তো কাউকে খবর দেয় নি। তখনও ঝিরিঝিরি বৃষ্টি – দিনের আলো নিভু নিভু। ধূপের গন্ধ – রজনীগন্ধার আজও লেগে আছে ঘরে। কারা যেন এসেছিলো “বল্য হরি হরিইব্বোল”। বুড়ো বটতলা পেরিয়ে পীচরাস্তা ছাড়িয়ে সব চলে গেল। জল ছপছপ – জল ছপছপ। পেছন পেছন ধূপের গন্ধ গেলো।
এখন দুগ্গা পুজো শেষ। দূর আকাশে বাজির শব্দটা আসতে আসতেও আসে না। আলোটাই শুধু একা একা ভেসে আসে। “রাস্তায় ধারে ডুমলাইটগুলান যেন আলোই দ্যায় না” ক্রমশঃ রাত গভীর হয়। কুয়াশা চরাচর ঢেকে ফেলে। শান্তিপিসি লন্ঠনে সলতে পাকিয়ে জ্বালিয়ে রাখে। চাকা ঘুরিয়ে । মৃদু আলো লন্ঠনের মধ্যেই আটকে থাকে। পিসি শুনতে পায় বাবা ডাকছে। এটা জল চাওয়ার আওয়াজ। টুপটাপ শিশির পড়ে? দূর বাবার বিছানা ভিজে গেছে । পিসি লন্ঠনের শিখা বাড়ায় । ন্যুব্জ কোমরে লন্ঠন তুলে নেয় “যাই গ্য বাবা আমার -শুনেছি বটেক তুমার ডাক – আসছি আমি – বয়সও হল্যোঁ কিনা? টুকুস সময় লাগে গ্য যেতে”।
(এইভাবে চলে পিসির স্বপ্ন পরাবাস্তব আর বাস্তবের টানা -পোড়েন )