এই গল্পের ব্যোমকেশ হ’ল ডাঃ পীযূষ কান্তি পাল। আমি বোকাসোকা অজিত। গল্প শুরুর আগে পীযূষদার একটু পরিচয় দিয়ে দিই।
প্রথমেই বলে রাখি সামান্য একটা গল্পে ডাঃ পালের মত অসামান্য প্রতিভাকে বর্ণনা করা যায় না। এমনকি খড়গ্রাম হাসপাতালে সাড়ে তিনবছর এক সঙ্গে থাকার পরও পীযূষদার অনেক কিছুই আমার অজানা রয়ে গেছে।
যেমন, ১। পীযূদার নাম কেন পিউপা হল?
২। পীযূষদা কি সত্যিই ক্যারাটেতে ব্ল্যাক বেল্ট? অনেকবার পীযূষদার মুখে শুনেছি, কিন্তু কোনও দিনও তার প্রমাণ পাইনি।
৩। চরম নারীবিদ্বেষী পীযূষদা বিয়েতে কি করে রাজি হল? ইত্যাদি… ইত্যাদি…
তবু যেটুকু পীযূষদাকে জেনেছি সেটুকুও ঠিকঠাক বর্ণনা করতে হলে অন্তত শ দেড়েক পাতার একটা উপন্যাস হয়ে যাবে। আপাতত সে চেষ্টায় যাচ্ছি না। বরঞ্চ এবার সরাসরি গল্পে চলে যাই।
আমি আর পীযূষদা একই কোয়ার্টারে থাকতাম। দু বছর একসাথে থাকার পর আমি বিয়ে করে ফেলি। এবং তারপর পীযূষদা অন্য কোয়ার্টারে চলে যায়।
আমরা সবসময় একসাথেই থাকতাম। কতটা একসাথে? আমার তখন হাসপাতালের সিস্টার এবং বর্তমানে স্ত্রী রূপালীর সাথে প্রেমপর্ব চলছে। বহুদিন পর্যন্ত হাসপাতালের লোকজন বুঝতে পারেনি রুপালীর কার সাথে ইয়ে চলছে। আমার না পীযূষদার?
এক রাত্রে আমার অনকল ডিউটি চলছে। রাত তিনটের সময় বাবা মা কোলে করে তাদের আট বছরের সন্তানকে নিয়ে এল। বাচ্চা ছেলেটি দুদিন ধরে হালকা জ্বরে ভুগছিল। দুর্বল হয়ে গেছিল। গতকাল রাত থেকে খেতে কষ্ট হচ্ছে। কিচ্ছু গিলতে পারছে না। এমনকি জল পর্যন্ত না।
মাঝ রাত থেকেই ছেলেটির কথা বার্তা, হাঁটা চলা বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু কেমন চমকে চমকে উঠছে। গলায় ঘড়ঘড় শব্দ হচ্ছে। মায়ের কথা অনুযায়ী দু তিনবার খিঁচুনিও হয়েছে।
সে সময় খড়গ্রাম ব্লকে শনিগ্রাম ও মিল্কি বলে দুটি গ্রামে এনকেফালাইটিস ছড়িয়ে পড়েছে। অজানা জ্বরে অনেকে মারা গেছে। সেদিন সকালেই প্রাণের মায়া উপেক্ষা করে ঐ দুটো গ্রামে ক্যাম্প করে এসেছি।
প্রাথমিক চিকিৎসা দিলাম। কান্দি সাব ডিভিশন হাসপাতালে পাঠানোর জন্য রেফার লিখলাম। আনুমানিক রোগের জায়গায় মেনিংগো এনকেফালাইটিস। কিন্তু মনের মধ্যে খচ খচ করছে। বাচ্চাটির গায়ে হাত ছোঁয়ালেই কেমন চমকে উঠছে। মাংসপেশীতে সঙ্কোচন হচ্ছে। এনকেফালাইটিসে এমন হয়?
কোয়ার্টারে গিয়ে পীযূষদাকে ডেকে তুললাম। ডাকতে খারাপ লাগছিল। বেচারা আগের রাতে ডিউটি করেছে। কিন্তু আমার আরেকজন ডাক্তারের মতামত দরকার। তাছাড়া পীযূষদা শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ। অভিজ্ঞতা অনেক বেশি।
কোয়ার্টার আর আমাদের হাসপাতালের মধ্যে একটা বড় দীঘি। দীঘির পাড় দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পীযূষদাকে বাচ্চাটার কথা বলছিলাম। পীযূষদা শুধু হাঁ হু করছে। ভোররাতে ঘুমটা মনে হয় এখনও কাটেনি।
ওয়ার্ডে পৌঁছে পীযুষদার চেহারা পাল্টে গেল। বাচ্চাটার বাবা মায়ের কাছে ভালো করে সব শুনল। তারপর বলল, “রাতে ভাত খেতে পেরেছিল?”
“ভাত তবু একটু খেয়েছিল বাবু। কিন্তু জল খেতে গিয়ে এমন বিষম খেলো। তারপর যায় যায় অবস্থা।”
পীযূষদা একটা কাগজ ভাঁজ করে বাচ্চাটির মুখে হাওয়া করল। সাথে সাথে বাচ্চাটির চোখের পাতা কেঁপে উঠল। মুখের মাংসপেশী কেঁপে উঠল। চোখদুটো যেন অসীম আতংকে ঠেলে বেরিয়ে এল।
পীযূষদা টর্চ নিয়ে বাচ্চাটির পায়ে কি খুঁজছে। আমাকে বলল, “এই দেখ।”
দেখলাম, কয়েকটি শুকিয়ে যাওয়া ক্ষতচিহ্ন। বললাম, “কি এটা?”
পীযূষদা বলল, “তুই একটা গাড়ল। ‘রেবিস’ এর নাম শুনেছিস। জলাতঙ্ক…। ওটা কুকুরের কামড়ের দাঁত।”
ততক্ষণে সবকিছু আমার কাছে জলের মত পরিষ্কার। বাচ্চাটির মা বলল, “হ্যাঁ, ডাক্তারবাবু। আড়াই মাস আগে বাচ্চাকে কুকুরে কামড়ে ছিল। ওঝার কাছে গিয়ে ঝাড়িয়ে নিয়েছিলাম।”
গল্পটা এখানে শেষ হলেই ভাল হত। কিন্তু আরেকটু বাকি আছে।
আমি কান্দির এসিএমওএইচ স্যারকে সব জানিয়ে বাচ্চাটিকে বেলেঘাটা আই ডি হাসপাতালে রেফার করলাম।বাচ্চাটির বাবা আমাকে প্রশ্ন করল, “কলকাতায় নিয়ে গেলে ছেলে কি বাঁচবে?”
মিথ্যে বলতে পারলাম না। জলাতঙ্ক ১০০ শতাংশ প্রাণঘাতী। বাবা মা ছেলেটিকে ছাড়িয়ে নিয়ে আবার ওঝার কাছে গেল। এবং সেদিন রাত্রেই বাচ্চাটি মারা গেল।
আপনারা যারা ভাবছেন, আড়াই মাস আগে কুকুরে কামড়ানোর পর হাসপাতালে আনলে বাচ্চাটি বেঁচে যেত, তারা ভুল ভাবছেন।
পীযূষদা পরে হিসেব করে দেখিয়েছিল, ঐ সময়ে আমাদের এ আর ভি অর্থাৎ জলাতঙ্কের টিকা প্রায় চার মাস ছিল না। হাসপাতালে আনলে টিকা দেওয়া যেত না। বাইরে থেকে হাজার দেড়েক টাকা খরচ করে টিকা নেওয়ার ক্ষমতা ওর বাবা মায়ের ছিল না।
আবার সাত বছর পর গত সপ্তাহে কান্দিতে পীযূষদার বাড়িতে গেছিলাম। সেখান থেকে খড়গ্রাম হাসপাতালে।
পীযূষদার বাহন, এখনও সেই এগারো বছরের পুরোনো মটরসাইকেলটাই। এতদিন বাদে পীযূষদার সাথে দেখা হয়ে মনে হ’ল, মটরসাইকেলটার মত পীযূষদার বয়সও অনেকটা বেড়ে গেছে।
এই লেখা গুলো শুধু পড়া যায় ,জানা যায়।
মতামত কি দেব। ভালো লাগে যুদ্ধ জয়ের খবরে। খারাপ লাগে পরাজয় । কিন্তু মেনে নিতেই হবে। অভিজ্ঞতা টাই সঞ্চয়। ভালো থাকুন আপনারা।
প্রতিটি লেখাই অসাধার, প্রতিটি ইনফো প্রয়োজনী।
কুসংস্কার আর অশিক্ষার জলন্ত প্রমাণ এই ঘটনা ??
🙁
এখন সরকারি হাসপাতালে এ আর ভি।র কেমন সরবরাহ থাকে?