এ লেখা যখন শুরু করছি তখন দুপুর ৩টে। বাইরে কোকিল ডাকছে। আকাশও ঝকঝকে। গাড়িঘোড়া চলছে না। দূষণও কম। গৃহবন্দী থাকার কথা ছিল কিন্তু রোজই বেরতে হচ্ছে। আজকেও এমার্জেন্সি অপারেশন ছিল। আশাকরি আপনারা বাড়িতে আছেন আর সুস্থ আছেন। আর হ্যাঁ, হাত ধুচ্ছেন তো ?
যাই হোক কাজের কথায় আসি। আজকাল কেন জানিনা, মাঝেমধ্যেই কান্না পাচ্ছে। খুব খুশি হলে, দুঃখ পেলে, রাগ হলে আবার ভয় পেলেও। প্রতিবারই কিন্তু চোখের জল মোছার আগে ভাল করে হাত ধুয়ে নিচ্ছি। এই কান্না পাওয়া রোগটা ধরা পড়ল সেদিন বিকেল ৫টায়। কাঁসর, ঘণ্টা, হাঁড়ি, কড়াই, থালা, বালতি ঢ্যাং ঢ্যাং, ডং ডং করে বেজে উঠল। জীবনে এমন সম্মান পাইনি। সত্যি বলছি, খুব খুশি হলাম। চোখ জলে ভরে উঠল। হাত ধুয়ে চোখ মুছে ফেসবুকে স্টেটাস আপডেট করলাম-হাতের চড় কাঁদায়নি, হাততালি কাঁদিয়েছে। লাইক, শেয়ার ও কমেন্টের ফোয়ারা। বসলাম টিভির সামনে। কিন্তু তারপর পাড়ায় পাড়ায় করোনা দেবীর বিসর্জনের শোভাযাত্রা দেখতে দেখতে কান্না পেল- দেবী কতজনকে যে সঙ্গে নিয়ে যাবে…আবার হাত ধুয়ে চোখ মুছলাম। হাততালির রেশ কাটতে না কাটতেই নতুন খবর, বাড়িওয়ালারা নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছে, ইন্টার্ন, হাউস স্টাফরা কী করে ডিউটিতে যাবে বুঝতে পারছে না। ডাক্তারবাবুর ড্রাইভার কাজ ছেড়ে দিয়েছে। কারণ সে মেডিক্যাল কলেজে যাবে না। হুজুগ আর হাগু বেশিক্ষণ আটকে রাখা যায় না। শুধু হাততালি দিয়ে কী ই-তালি হওয়া আটকানো যাবে? কান্না পেল খুউউব। আবার হাত ধুয়ে চোখ মুছলাম।
চেম্বার বন্ধ। ফোন বেজেই চলেছে। ফোনেই জানতে পারলাম, একজনের আট সপ্তাহের প্রেগন্যান্সি মনে হয় নষ্ট হল। সে ফোনেই কাঁদছে। পরের ফোন, ‘বাচ্চা একদম নড়ছে না।’ আবার কান্না, মা হবার আগে। ‘তিনদিনের বাচ্চা সারাদিন পেচ্ছাপ করেনি’, এবারেও কান্না, মা হবার পর।
ফোনে উপদেশ দিতে দিতে আমারও কান্না পেল। রাতে আবার বেরতে হবে। হাত ধুয়ে চোখ মুছলাম। এই ভাবেই কান্নাকাটি করে আর একটা দিন কাটল।
আরো কিছু কারণে কান্না পেলো।
দিদিকে দেখে কান্না পেল। এই বিপদের সময় তিনি যেভাবে হাল ধরেছেন! এ সেই পুরনো দিদি, যাকে সব কিছু মন খুলে বলা যায়। দিদিকে বলার জন্য কোনও বিজ্ঞাপন লাগবে না। মোদিজীকে দেখে কান্না পেল-দেশের নেতা এমনই হতে হয়। ওঁদের ছাতির মাপ জানার কোনও দরকার নেই। কান্না পেল মদের আর মাংসের দোকানের বিশাল লাইন দেখে। দোকানের সামনে দুটো ছাগল দাঁড়িয়েছিল। চোখাচোখি হতেই যেন হাসল- ওরা কি আমার চোখে মৃত্যুভয় পড়তে পারল? বুঝলাম ক্রিকেট, বলিউড নয়, একমাত্র ভয়ই পারে দেশকে ‘এক’ করতে। আর একবার ভীষণ ভয় পেলাম – ফেসবুকে দেখি ছোট ছোট ভাইবোনেরা ইমার্জেন্সী ডিউটি দিচ্ছে, মুখে একটা সার্জিক্যাল মাস্ক লাগানো। আপনারা একটা অভিনন্দন দেখে স্যালুট করেছিলেন, এবার দেখুন হাজার খানেক অভিনন্দন। এই বাচ্চাগুলোর মুখ চেয়ে চায়ের দোকানে গুলতানি না মেরে বাড়ি ফিরে যান। অনেকের শুনেছি লজ্জায় চোখে জল আসে। হাত ধুয়ে চোখ মুছবেন কিন্তু।
আজ সকালে ঠিক সময়ে ড্রাইভার চলে এসেছে, অল্প কিছু বাজার করে নিয়ে। ওর বন্ধুরা সবাই দেশে ফিরে গেছে। আমার কাজের অসুবিধা হবে বলে ও রয়ে গেছে। দুজনে জলখাবার খেয়ে কাজে বেরলাম। রাস্তাঘাট ফাঁকা। ভাবলাম লোকের চৈতন্য হচ্ছে। ঘুম ভাঙল এন্টালি মার্কেটের কাছে গিয়ে। এই সময়েও লোকে এত বাজার করতে পারে! এই ভারী থলে বইতে কষ্টের থেকে বেশি লজ্জা পাওয়া উচিত। পার্ক সার্কাসের মোড় ফাঁকা। সেই বাচ্চা ছেলেগুলো কোথায়? যারা বেলুন বিক্রি করতো। সেই রোগা মা, যে উলঙ্গ বাচ্চাকে নিয়ে এসে দাড়াত। যাদের দেখলে আমি কাঁচ খুলে দিতাম বা কপালে হাত ঠেকাতাম। চোখ কড়কড় করল। কিন্তু নাকে ও চোখে হাত দেওয়া বারণ।
গন্তব্যে পৌঁছলাম। অ্যানেস্থেসিস্ট, নার্স, এমব্রায়োলজিস্ট, ওটি বয়, গেটম্যান, রিসেপশনিস্ট সবাই এসে গেছে। হালিশহর থেকে হাওড়া, বেহালা থেকে বেলঘরিয়া-সবাই হাজির। অজ্ঞান হবার আগে পেশেন্টের চোখে জল- কৃতজ্ঞতার, জ্ঞান ফেরার পর অন্য পেশেন্টের চোখে জল-ভালবাসার। আমাদের সব স্বাস্থ্যকর্মীর চোখে জল- আনন্দের। সত্যি বলছি সামান্য কিছু দিতে পারার আনন্দ অনেক কিছু পারার থেকে অনেকটাই বেশি। আবার হাত ধুয়ে চোখ মুছলাম।
এরপর একটা স্ক্যান করতে হল। দেখলাম ভ্রূণের হার্টবিট ধকধক করছে। কালকের সেই রক্তক্ষরণ এই প্রাণটাকে শেষ করতে পারেনি। আশা শেষ হয় না। আমার অজান্তেই হাত চোখে চলে গেল। ভাবছেন, হাত না ধুয়েই চোখে দিলাম- আসলে এবার অ্যালকোহল জেল এ হাত পরিষ্কার করেছিলাম।।
হাসছেন? হাসুন। ভালো থাকুন।
শেষও করি ওঁর গান দিয়ে,
‘বিপদে মোরে রক্ষা কর, এ নহে মোর প্রার্থণা
বিপদে আমি না যেন করি ভয়।’
ভালো লাগলো।