২৭.০৯.২০২৪
৯১. ছোটরা যখন স্বাস্থ্য ভবন ঝাড়ু দিচ্ছিল এবং সেই ঝাড়ুর শব্দে নবান্ন অব্দি কাঁপছিল, তখন বড়রা গেল মেডিক্যাল কাউন্সিলের হালহকিকত জানতে। বছরের পর বছর ভোটে কারচুপি করে তৃণমূলী হার্মাদবাহিনী কাউন্সিলে অধিকার বজায় রেখেছিল। পশ্চিমবঙ্গের যত ডাক্তারি লবি, যার উপর থ্রেট কালচারের ভিত্তি নির্মিত- সবার আশ্রয়স্থল এই কাউন্সিল। অভীক দে, বিরূপাক্ষ ইত্যাদি সব ডাক্তার-গুণ্ডাদের চারণক্ষেত্র এটাই। তাদের অভয়ারণ্যের বাঘগুলো এখন পশ্চিমবঙ্গের থ্রেট কালচারের প্ৰধান নরখাদক!! অভীক দে, সৌরভ পাল ইত্যাদি ইত্যাদি…এখন আবার তাদের চেয়ারম্যান সুদীপ্ত রায়ের টিকি বাঁধা সিবিআইয়ের হাতে। এমতাবস্থায় সিনিয়র ডাক্তারদের কয়েকটি সংগঠন একত্রে মেডিক্যাল কাউন্সিলে যায় ডেপুটেশন জমা দিতে। সেখানে গিয়ে জানা যায় আরো সব বিস্ময়কর তথ্য!
৯২. এর মধ্যে সবচেয়ে বিস্ময়ের হলো মেডিক্যাল কাউন্সিলের রেজিস্ট্রার শ্রীমান মানস চক্রবর্তী মহাশয় বছর চারেক হলো অবসরগ্রহণ করেছেন এবং তৎপরবর্তী মাত্র ছয় মাসের একটা এক্সটেনশনের দলিল ওনার কাছে আছে। তারপর তিন বছরের বেশি সময় ধরে তিনি মেডিক্যাল কাউন্সিলের শীর্ষপদ অলঙ্কৃত করে বসে আছেন জাস্ট এমনি ভালো লাগছে বলে!! অর্থাৎ এই তিন বছর ধরে যেসকল ডাক্তারি পড়ুয়ারা রেজিস্ট্রেশন পেয়েছেন, তাতে যিনি স্বাক্ষর করেছেন, বকলমে তার কোনো আইনি মান্যতাই নেই।
কাউন্সিল থেকে বছরের পর বছর চারজন মানুষ মাসিক ৫০,০০০ টাকা ভাতা পান- কোন ভিত্তিতে কেউ জানেনা।
জনরোষ প্রশমিত করতে সন্দীপ ঘোষের রেজিস্ট্রেশন বাতিলের যে নাটক হয়েছে, তা আদৌ কাউন্সিলের সংবিধান মেনে দুই তৃতীয়াংশের বেশি সদস্যের মত নিয়ে হয়নি। সুতরাং কোর্টে এই রেজিস্ট্রেশন পুনরায় ফিরে পেতে সন্দীপ ঘোষের ত্রিশ সেকেন্ড সময়ও লাগবে না।
এত কিছুর পরেও মানসবাবু বিনীত গোয়েলের মতোই চেয়ার আঁকড়ে বসে থাকেন।
৯৩. এর মাঝে প্রধান সচিবের নির্দেশিকা সামনে আসে। এই নির্দেশিকা মূলত আন্দোলনের চতুর্থ পয়েন্ট নিয়ে। সম্ভবত এই পয়েন্টটাই সবচেয়ে সহজ ছিল সমাধান করা- প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দিলেই সুরক্ষার দাবি মেনে নেওয়া হয়ে যায়, অন্তত কাগজে-কলমে তো বটেই। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে- স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের বাপ কলকাতা পুলিশের তত্ত্বাবধানে আমাদের সুরক্ষায় মুড়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই যে সুরক্ষা, এই যে সিসিটিভি- এগুলোকে যে দুষ্কৃতী ডাক্তারেরা হাপিস করে দেয় যথাসময়ে, যাদের উপস্থিতিতে সমস্ত সুরক্ষাই আদপে প্রহসনে পরিণত হয়- সেই দুষ্কৃতীদের বিরূদ্ধে ব্যবস্থার কোনো উচ্চবাচ্য করা হয়না। এবং এটাই স্বাভাবিক- কারণ এই দুষ্কৃতীরাই সরকারের ক্ষমতায়ন করে, কলেজে এবং হাসপাতালে সরকারি প্রভাব সুনিশ্চিত করে। আর তৃণমূল সরকার কালিদাস নয়, এরা গাছের সব ডাল কাটতে পারে, নিজের ডালটা অক্ষত রাখে।
৯৪. এরপর আসে আসল নেমেসিস- বাঁধ ভাঙা বন্যা, নাকি বাঁধ ছাড়া বন্যা? বন্যা মানবিক না প্ৰাকৃতিক জানা নেই, মোটমাট গোটা সাতেক জেলা জলমগ্ন হয়ে যায়। ডিভিসি জল ছাড়তে বাধ্য হওয়ায় এই দুর্যোগ- এই নিয়ে অনেক দর কষাকষি চলে কেন্দ্র-রাজ্যে, প্রতি বছরের মতোই। আবার ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান নিয়ে কিঞ্চিৎ আলোচনা হয়। ঘর ডোবে গরিব মানুষের, সে এক ভয়ংকর শীতল দৃশ্য!! এখন বন্যার মাঝে ডাক্তারি আন্দোলন বড় বেমানান। আর এখানেই আমরা বারবার হেরে যাই, নীতির প্রশ্নে। দু’কানকাটা নির্লজ্জতার চূড়ায় না উঠতে পারলে স্বৈরাচারী সরকারকে আঘাত করা যায় না। মমতা ব্যানার্জির জায়গায় মা দুর্গা এলেও যে কারণে বাম সরকারকে টলাতে পারতো না। নীতি নিয়ে দুর্নীতি এবং নীতিহীনতার সঙ্গে লড়াই করা যায়না। আমরা তাই আবারো একবার পিছিয়ে এলাম।
৯৫. বন্যাকে একটা বড় কারণ হিসাবে বললেও বন্যাই একমাত্র কারণ স্বাস্থ্যভবন অবস্থান প্রত্যাহারের- একথা বললে নিজের কাছেই অন্যায় হবে। প্রথমত একটা বড় ন্যারেটিভ তৈরি হয়েছিল, সরকার ৯০% দাবি মেনে নিয়েছে, তাও ডাক্তারেরা স্বাস্থ্যব্যবস্থা অচল করে আন্দোলন চালাচ্ছে। কিছু শতাংশ মানুষ বুঝেছে আমরা অনেক বড় বড় প্রতিশ্রুতি পেলেও নৈতিক জয় ছাড়া আদপে কিছুই পাইনি। কিন্তু আবারো দীর্ঘমেয়াদি দাবি নিয়ে কর্মবিরতি বজায় রাখাও সম্ভব ছিল না।
স্বাস্থ্যভবনে বিভিন্ন জায়গা থেকে খাবারদাবারের কোনো অভাব ছিল না। কিন্তু হাজার হোক, ওটা রাস্তাই ছিল- এবং আমাদের কারোরই দিনের পর দিন রাস্তায় কাটানোর অভ্যাস কোনোকালেই ছিল না। বৃষ্টি, মশা ইত্যাদির প্রকোপে অনেক জনেরই শরীর খারাপ হয়, সেগুলোও বিবেচ্য। সব মিলিয়ে স্বাস্থ্য ভবনে উপস্থিতির হারও কিছুটা হলেও কমেছিলো।
সর্বোপরি, এখনো শেষ হয়নি- ডেকোরেটার্সদের পরোক্ষে চাপ দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন জিনিসপত্র আস্তে আস্তে গুটিয়ে নিতে, কে দিয়েছে পাঠক বুঝে নিন!
সব মিলিয়ে স্বাস্থ্য ভবনে অবস্থান তোলার ঘোষণার সাথেই আন্দোলনের প্রথম পর্বের উপসংহার টানা হয়ে যায়। সরকারকে সপ্তাহ খানেকের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয় সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য, ততদিন অব্দি জরুরি পরিষেবা শুরু করা হয়। এর পাশাপাশি বন্যা দুর্গতদের জন্য অভয়া ক্যাম্পের আয়োজন করার পরিকল্পনা হয়- যে মনুষ্যসমাজ আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল, তাদের দুঃসময়ে পাশে গিয়ে দাঁড়ানোর প্রতিজ্ঞায় আরো বৃহত্তর আন্দোলনের আগমনী সুর বেজে ওঠে…