০৬.১০.২০২৪
কর্মবিরতি: to be or not to be!!
১১১. আরজিকরের ঘটনায় সবাই যখন মর্মাহত, তখন সাগর দত্তের জুতোপেটা আগুনে ঘি ঢালার মতোই ছিল। তদুপরি সুপ্রিম কোর্ট ও রাজ্য সরকারের অসংবেদনশীলতায় জুনিয়র ডক্টরস ফ্রন্ট বিরক্ত হয়ে পড়ে একরকম। এই অবস্থায় কর্মবিরতির ডাক দেওয়া ছাড়া বিশেষ কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু এই কর্মবিরতি ২.০ সবাই স্বাগত জানায়নি। মিডিয়া ন্যারেটিভ বদলাতে থাকে, সিনিয়র ডাক্তারেরাও উষ্মা প্রকাশ শুরু করেন, এমনকি জুনিয়র ডাক্তারদেরও একটা বড় অংশ কর্মবিরতির বিপক্ষেই ছিল। রোগী পরিষেবা ব্যাহত হওয়া, আসন্ন পুজোর মরসুম, সিনিয়র ডাক্তারদের প্রায় দু’মাস অক্লান্ত পরিশ্রম- সব ক’টা যুক্তিই ছিল কর্মবিরতির বিপক্ষেই। আরো একটা বড় উদ্বেগের বিষয় ছিল জুনিয়র ডাক্তারদেরই একটা বড় অংশ পরীক্ষার দোরগোড়ায়। এই অবস্থায় কর্মবিরতি ঘোষণা ও প্রতিবাদ চালিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা অনেকেরই কমে এসেছিল, তার সাথে যুক্ত হয়েছিল দুই মাসব্যাপী রাস্তায় কাটানোর ক্লান্তি।
১১২. তবে কেন এই কর্মবিরতি? শুধুই সাগর দত্তের ঘটনায় একটা প্রতিক্রিয়া মাত্র? বিভিন্ন হাসপাতালে হিংসার ঘটনা অনুঘটকের কাজ করলেও এই কর্মবিরতির ডাক, তা আংশিকভাবে তোলার আগেই দেওয়া হয়েছিল। শুরুতেই বলা হয়েছিল সরকার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন না হলে আবার কর্মবিরতির দিকে যাওয়া হবে। সত্যি বলতে, আংশিক কর্মবিরতি প্রত্যাহার সরকার আসলে আন্দোলনের ইতি হিসেবেই দেখেছিল। যেসব দাবি নিয়ে তারা ভেবে দেখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেসব নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য তো করাই হয়নি; বরং মুখ্য সচিবের পক্ষ থেকে যেসব নির্দেশাবলী দেওয়া হয়েছিল, তা নিয়েও কোনো কাজ হয়নি। আর হয়নি বলেই সাগর দত্তের মতো ঘটনা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছে ভাড়া করা সিভিক ভলান্টিয়ারের দল। যাঁর তত্ত্বাবধানে স্বাস্থ্য দপ্তর দুর্নীতির আঁতুরঘর হয়ে উঠেছে, সেই স্বাস্থ্য সচিবের অপসারণের কথাও পরে ভেবে দেখার কথা বলা হয়েছিল- তা নিয়েও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
১১৩. আর শুধু এই আন্দোলন কি ডাক্তারদের নিজেদের কয়েকটা দাবি আদায়ের আন্দোলন? সরকার মানুষকে এই আঙ্গিকে দেখানোর চেষ্টা করলেও আসল দাবি কিন্তু সেরকম নয়। রোগিস্বার্থে একটা উন্নততর স্বাস্থ্যব্যবস্থার জন্য এই আন্দোলন। আজ সরকারি হাসপাতালে একজন রোগী ও তার পরিজনেরা বুঝতে পারেন না তাঁরা কোনদিকে যাবেন। ফ্রি চিকিৎসার মোড়কে তাঁরা স্বাস্থ্যকে অধিকার ভুলে দানসামগ্রী ভেবে ফেলেছেন। হাসপাতালে আসছেন, নিজেরাই ট্রলি ঠেলে নিয়ে যাচ্ছেন, দালালের পাল্লায় পড়ছেন, কখনো বেড পাচ্ছেন, অধিকাংশ সময় শুনছেন বেড নেই। সেই বেড হয়তো কোন নেতা মন্ত্রী দখল করে বসে আছেন সিবিআই-র হাত থেকে পালিয়ে। যাইহোক সে আমাদের দুর্ভাগ্য!! এবার ভর্তি হলে সেই রোগীর লোকেরাই রক্ত জমা দিতে ছুটছে, রক্ত আনতে ছুটছে, রোগীকে দিয়ে ট্রলি ঠেলছে- এই দৃশ্যই চোখে পড়ে হাসপাতালের প্রতিটা কোণে। আর বেড যদি না পাওয়া যায়, তাহলে অনিশ্চয়তা নিয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে বেড়ানো, প্রত্যেক হাসপাতালের কড়া নাড়া এবং ব্যর্থ হয়ে আবারো অন্য কোথাও যাওয়া- অবশেষে সামর্থ্য থাকলে প্রাইভেটে বা দালাল ধরে সরকারি হাসপাতালে বা ভিন রাজ্যে যাত্রা আর সঙ্গতি না থাকলে রাস্তাতেই গঙ্গালাভ- এই হচ্ছে জনগণের নিয়তি। এই ছবিটা রোজকার, কখনো মিডিয়া সেটা নিজের স্বার্থে দেখায়, কখনো দেখায় না। যাঁরা হাসপাতালে রোগী নিয়ে যাতায়াত করেন, তাঁরা সকলেই এটা জানেন।
১১৪. আজ আন্দোলনে দাবি তোলা হয়েছিল একটা লাইভ বেড ভ্যাকানসি সিস্টেমের, যাতে হাসপাতালে বেড আছে না নেই সেটা হাসপাতালে যাওয়ার আগেই জানা থাকে। দাবি জানানো হয়েছিল সেন্ট্রাল রেফারাল সিস্টেমের। যাতে উচ্চতর হাসপাতালে বেডের স্ট্যাটাস জেনে তবেই রোগীকে রেফার করা হয়। রেফার সিস্টেমের এই অস্বচ্ছতার জন্যই এত রোগী হয়রানি, এত ক্ষোভ- আর সেই ক্ষোভের অনিবার্য বহিঃপ্রকাশ চিকিৎসক নিগ্রহ। এই পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝির সহজ এবং বাস্তবায়নযোগ্য সমাধান আমরা ভেবে বলেছি- সরকারের কানে ওঠেনি। কারণ রোগীরা যদি জানতে পারে সরকারি হাসপাতালে সত্যিই বেড নেই, বেডটা ঝালমুড়ি নয় যে বানিয়ে দেওয়া যায়- তাহলে ভোট ব্যাংকে টান তো পড়বেই। আবার বিভিন্ন হাসপাতালের কমিটিতে নিজের পেটোয়া লোককে সরিয়ে গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ঢুকে পড়লে নিম্নমানের জাল ওষুধও চালিয়ে দেওয়া মুশকিল হবে। সব মিলিয়ে বিনামূল্যে চিকিৎসার নামে যে ব্যবসা সরকারবাহাদুর ফেঁদে বসেছে, তার লালবাতি জ্বলে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
১১৫. এত অন্যায় অবিচার দেখে মুখ বুজে সেটা মেনে নেওয়া- এতদিন যে মানুষেরা ডাক্তারদের মুখের দিকে তাকিয়ে আন্দোলন চালিয়ে গেছে তাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা মাত্র। আবার কর্মবিরতিতে সবার মত নেই। তাহলে করণীয় কী!! জানতে কলেজের সিনিয়র ডাক্তারদের সাথে আলোচনা সভা ডাকা হলো। সেখানে সকলেই বলে গেলেন, কর্মবিরতি কখনো সমাধান নয়। সমাধান তাহলে কী? এটাই ভবিতব্য মেনে নেওয়া? সব অন্যায় দুর্নীতি মেনা নেওয়া? কোনো সদুত্তর নেই। আমরা ভুল দরজায় কড়া নেড়েছিলাম। সিনিয়র ডাক্তারদের কাছে যদি উত্তর থাকতো তাহলে তাঁরা এতদিনে এর সমাধান করেই ফেলতেন; পারেননি যখন, তখন তাঁরা পথের দিশা দেবেনই বা কীভাবে!! তাঁদের কেউ কেউ মনে করেন, ইমার্জেন্সিতে মার খাওয়ার ঘটনা আগেও হয়েছে, পরেও হবে। আমরা যোদ্ধা, আমরা পিছিয়ে আস্তে পারিনা। এ কেমন যোদ্ধা যার হাতে অস্ত্র নেই!! কেউ বা বললেন, তুমি সৎ থাকলে দৈবশক্তি তোমায় বাঁচাবে, অর্থাৎ অভয়া সেই হিসেবে খুবই দুর্নীতিপরায়ণ ছিল এটাই সাব্যস্ত হয় আর কি!!
১১৬. এসব দৈববাণী আমরা পেলাম, কিন্তু সিনিয়রদের পক্ষ থেকে অন্তত প্রতীকী প্রতিবাদের আশ্বাসটুকু আমরা পেলাম না। তাঁরা শুধু নিজেদের ডিউটি করে যেতেই আগ্রহী। যখন টাইটানিকে জল ঢুকছিল তখনো যেমন বাদকরা নিজেদের কাজে মগ্ন ছিলেন, আমাদের সিনিয়ররা সেইভাবেই কাজে মগ্ন থাকতে চান- বালিতে মুখ গুঁজে মরুঝর কেটে যাওয়ার আশ্বাসে। সুতরাং আমাদের সামনে বিকল্প খুব কমই ছিল এবং আমাদের নেতৃত্বের সামনের সারির মানুষেরা অনশনে যাওয়ার কথা এবার ভাবতে শুরু করলো। অহিংস আন্দোলনে নিজেদের দাবি আদায় করার চরম পদক্ষেপ অনশন। আমি আমার দাবি যদি এতটাই ন্যায্য মনে করে থাকি, তবে তা পাওয়ার জন্য আমি জীবন বাজি লাগতেও প্রস্তুত- অতএব চরম সিদ্ধান্ত নেওয়ার দিকে আমাদের পা বাড়াতেই হবে, একথা মাথায় রেখেই মহালয়ার দিন মহা-মিছিল ও মহা-সমাবেশের প্রস্তুতি নিলাম আমরা…