২৭.১০.২০২৪
১৩৫. এরপর অনশনকারীদের অসুস্থ হওয়ার পালা। শরীরের গ্লাইকোজেন স্টোর সমাপ্ত কয়েক ঘন্টার মধ্যে, ক্রমাগত ফ্যাট ভেঙে কিটোন বডি দিয়ে কাজ চালানোর প্রচেষ্টা, সেই থেকে শরীরে অম্লের মাত্রা বৃদ্ধি এবং পরিশেষে প্রোটিন ভেঙে শরীরের ক্ষয়। শরীরের অবধারিত কিছু অপূরণীয় ক্ষতি কথা মাথায় নিয়েই অনশনে নেমেছিলেন ডাক্তারেরা- মানুষও পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু তাঁরা ভাবেননি তাঁদের ‘মানবিক’ মুখ্যমন্ত্রীর চোখ খুলবেনা একবারের জন্যও। সিনিয়র ডাক্তারেরা পদত্যাগের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, গোটা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ধিক্কার এসেছে- তাতে ‘দিদি’র বয়েই গেছে!! তিনি এখন পুজোয় ব্যস্ত। একের পর এক পুজোর উদ্বোধন হয়েছে, গরিবের পেট ভরানোর নামে ৮৫,০০০ টাকা করে পার্টির লোকেদের পাইয়ে দেওয়ার সুব্যবস্থা হয়েছে। এদিকে আসল গরিব ফুচকাওয়ালা ঠিকমতো তোলা দিতে পারেনি বলে তার জিনিসপত্র ভেঙেচুড়ে দেওয়া হয়েছে। এই হচ্ছে বাংলার ‘মানবিক মুখ’।
১৩৬. এদিকে শরীর টানেনি অনিকেতের, তারপর একে একে অনুষ্টুপ, পুলস্ত্য, তনয়াদি, আলোক, সৌভিক- কারো পেটব্যথা, কারো হার্ট রেট কম, কেউ বা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছেন। একে একে যখন সঙ্কটজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন আন্দোলনকারীরা, শাসকদলের নেতারা মন্তব্য করেছেন, ‘এটা আমরণ অনশন হচ্ছেনা, হাসপাতালে ভর্তি অব্দি অনশন হচ্ছে’। আমরা শুনেছি, অবাক হইনি- কারণ একমাত্র অর্থের অন্বেষণে যে তৃণমূল দলের উদ্ভব, তাদের মানবিকতার স্তর এটুকু অব্দিই সীমাবদ্ধ আমরা তা জানতাম। আন্দোলন আরো এগিয়েছে, অনশনকারীর সংখ্যা বেড়েছে- ডা. রুমেলিকা কুমার, ডা. পরিচয় পাণ্ডা, ডা. আলোলিকা ঘোড়ুই , ডা. স্পন্দন চৌধুরী, ডা. সন্দীপ মণ্ডল- নাম যোগ হয়েছে একে একে। এর সাথে যোগ হয়েছে অগণিত প্রতীকী অনশনকারী- কেউ ১২ঘন্টা, কেউ ২৪ ঘন্টা- আট বছরের বাচ্চা থেকে আশি বছরের বৃদ্ধা- অনশনমঞ্চ ভাগ করে নিয়েছে সবাই। টনক নড়েনি শুধু সরকারের।
১৩৭. টনক নড়েছে অবশেষে কার্নিভ্যালের দিন- যখন উৎসবে রোমের নিরোর মতো মমতা ব্যানার্জির ডান্ডিয়া খেলার সমান্তরালে দ্রোহের কর্মসূচী ঘোষিত হলো। সিনিয়র ডাক্তারদের দ্রোহের কার্নিভ্যাল ও জুনিয়র ডাক্তারদের মানববন্ধনের কর্মসূচী ঘোষণার পরই পুলিশের পক্ষ থেকে দু’টোকেই রদ করার ঘোষণা হয়। একদিকে মমতা ব্যানার্জির ব্যক্তিগত ইগোর কার্নিভ্যাল, অপরদিকে নিজের মেয়ের খুনের ন্যায়বিচার চেয়ে বাংলার মানুষের দ্রোহের কার্নিভ্যাল- আবার রাস্তা জুড়ে ব্যারিকেড বসে, তাতে জড়িয়ে পড়ে লৌহ-শৃঙ্খল। হীরক রানীর উৎসবে যেন কেউ বাধা না হয়ে দাঁড়ায়!! কেস গড়ায় উচ্চ আদালত পর্যন্ত এবং আবারো অবধারিতভাবে কোর্টে নাস্তানাবুদ হয় রাজ্য সরকার। দ্রোহের কার্নিভ্যালে সরকারি নিষেধাজ্ঞার কোনো আইনি বৈধতা নেই- আবার খোলা হলো শেকল। এতদিনে পুলিশের অবশ্য এটা ড্রিল হয়ে গেছে, ব্যারিকেড লাগাও, কোর্টে গালি খাও, আবার খোলো- লজ্জাশরম তাদেরও আর বাকি নেই, পেটের দায়ে চাকরিটুকু রাখার জন্য যেটুকু করতে হয়…
১৩৮. তবে কথায় আছে, শঠের ছলের অভাব হয়না। প্রশাসনেরও অত্যাচারের প্রকারভেদের অভাব হয়না। সরকারি কার্নিভ্যালে ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন ডা. তপব্রত রায়। তাঁর জামায় ছিল প্রতিবাদী লেখাজোখা, তাতে কাগজ সাঁটা- ‘প্রতীকী অনশনকারী’। প্রতিবাদী অনশনকারী ডাক্তারদের সঙ্গে সংহতিতে তিনি অনশন করছিলেন। এই দোষে তাঁকে আটক করে পুলিশ, বিনা নোটিশে তাঁকে ময়দান থানায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং হেনস্তা করা হয় চার ঘন্টা ধরে। সরকারি ক্ষমতার এরকম বেপরোয়া অপব্যবহার ব্রিটিশ আমলেও কি হতো? নিশ্চয়ই হতো। কিন্তু স্বাধীন ভারতেও হচ্ছে- এটাই গণতন্ত্রের লজ্জা। প্রতিবাদ হয়েছে এর বিরুদ্ধেও, কর্পোরেশনের সমস্ত ডাক্তারদের মধ্যে আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছে। সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপে স্বৈরাচারের ছাপ যত স্পষ্ট হয়েছে, আন্দোলন ততই তীব্রতর হয়েছে।
১৩৯. এদিকে জনরোষ ছড়িয়েছে দাবানলের মতো। দ্রোহের কার্নিভ্যালে মানুষ উপচে পড়েছে, আশ্চর্যের বিষয় ডাক্তারদের সংখ্যা তাতে অন্যান্য মানুষের তুলনায় নগন্য। কর্মবিরতি প্রত্যাহারের জন্য কাজের চাপে আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে ডাক্তারদের অংশগ্রহণ অবধারিতভাবে কমতো, তাই হয়েছে। কিন্তু সেই অভাব বাঙলার মানুষ বুঝতে দেয়নি। রাস্তার লড়াইয়ের ব্যাটন ডাক্তারদের থেকে সাধারণ মানুষের যোগ্য হাতে হস্তান্তর হয়ে ধর্মতলার অনশন মঞ্চ কার্যত গণআন্দোলনের পীঠস্থানে পরিণত হয়েছে। একই ছবি দেখা গেছে পরবর্তী কর্মসূচিতেও- সে গণস্বাক্ষরের কর্মসূচিতেই হোক, বা সোদপুর থেকে ধর্মতলার সুদীর্ঘ ন্যায়বিচার যাত্রায়। দু’মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরও, সরকারের সমস্ত রকম চোখরাঙানি উপেক্ষা করে মানুষ রাস্তায় নেমেছে। সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করে, সারাদিন ধরে কুৎসা ছড়িয়ে, রাজনীতির কাদা লাগানোর চিরাচরিত চেষ্টা করেও আন্দোলন দমিয়ে রাখা যায়নি- আন্দোলনের এটাই সবথেকে বড় পাওনা।
১৪০. কিন্তু বিচার রইলো তিমিরেই। সুপ্রিম কোর্টে আবার একটা শুনানি, আবারো সমগ্র দেশের স্বপ্নভঙ্গ। আইন আইনের পথেই তারিখের খেলা খেলেছে। নামমাত্র কিছু বার্তালাপ সেরে দীপাবলির পর আবার শুনানির তারিখ ধার্য হয়েছে। ইতিমধ্যে সিবিআই প্রাথমিক চার্জশিট যা দিয়েছে, তা আরো হতাশাব্যঞ্জক। তাতে সঞ্জয় রায়ের গুষ্ঠির পিণ্ডি বিবরণ আছে, কিন্তু এই খুন ধামাচাপা দেওয়ার জন্য যে নেক্সাস কাজ করলো, তার শুধু প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত ব্যতীত কিছুই নেই। চার্জশিট নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করে রাজ্যপালের কাছে যাওয়ার কর্মসূচি নেওয়া হয়- অথচ পূর্বপরিকল্পিত ভাবে যাওয়া হলেও প্রতিনিধিদের ঘন্টার পর ঘন্টা বসিয়ে রাখা হয়, নামমাত্র দেখা করে বিদায় করা হয়। সিবিআইয়ের বিরুদ্ধে উষ্মা প্রকাশ করে যাওয়া হয়েছে বলেই হয়তো এই আপ্যায়ন- এটাই তৃণমূল সরকারকে দুটো কথা শুনিয়ে বৈঠকে বসার কথা হলে রাজ্যপাল নিশ্চয়ই সবকথা মন দিয়ে শুনতেন, সেই নিয়ে রাজনৈতিক কাদা ছোড়াছুড়ি করতেন। এরাজ্যে রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে মানুষ নিজের ধর্মাচরণ করবে, এটা ভাবাই বোধ হয় কষ্টকল্পনা।
১৪১. অনশনে মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের আশা আর বিশেষ ছিল না। তাঁর কার্নিভ্যাল তিনি সেরে ফেলেছেন, ওদিকে আর বিশেষ যাওয়ার প্রয়োজন নেই তাঁর। মুখ্যসচিব তাঁর বক্তব্যে বরাবর জানিয়ে এসেছেন, কাজকর্ম অনেক এগিয়েছে, ওনারা অনশন তুলে কাজে ফিরুন। যদিও সমস্ত প্রকারের কর্মবিরতি অনশনের কর্মসূচি ঘোষণার পরেই তুলে দেওয়া হয়েছিল, তবু ইচ্ছাকৃতভাবে ‘কাজে ফিরুন’ কথাটা ব্যবহার হয়েছে প্রতি পদে- একটা মিথ্যা কর্মবিরতির ন্যারেটিভ তৈরি করার জন্যে। সরকার পক্ষ থেকে যখন কোনো সদিচ্ছা দেখা গেল না, তখন বাধ্য হয়েই সমস্ত সিনিয়র জুনিয়র ডাক্তারেরা মিলে একত্রে আগামী মঙ্গলবার সর্বাত্মক স্বাস্থ্য ধর্মঘটের কথা ঘোষণা করা হলো। আর ম্যাজিকের মতো ঠিক পরের দিনই শনিবার, মুখ্যসচিব পৌঁছে যান অনশনমঞ্চে, মুখ্যমন্ত্রীর ফোন নিয়ে।
সেই ফোনের বার্তালাপ আমরা শুনলাম টিভিতে, দু’সপ্তাহ অনশনের পর মুখ্যমন্ত্রী ফোনে জানতে চাইছেন, তোমাদের দশ দফা দাবি কী কী একবার বলো তো!! এর চেয়ে বড় প্রহসন আর কী হতে পারতো!! ফোনে শোনা গেল কিছু স্তোকবাক্য, কিছু মিথ্যা প্রতিশ্রুতি, কিছু প্রচ্ছন্ন হুমকি, আর অনেক বেশি ঔদ্ধত্যের প্রকাশ। আলোচনার টেবিলে আহবান জানানো হলো, সেদিন নয়, পরদিন নয়, দু’দিন পেরিয়ে সোমবার- অনশনে প্রতীক্ষায় রইলেন আটজন ডাক্তার, আরো অনেক বেশি সাধারণ মানুষ।