শিশুর কল্পনা আর কল্পনা থেকে সৃজন কত দূর দূর ছুটে বেড়ায়– ছুটিয়ে নিয়ে বেড়ায় আমাকে– কী করে বোঝাই আপনাদের! সেবার ড্রইং ক্লাসে একটি মেয়েকে আঁকতে দিলাম ঝুড়িতে বসানো সবুজ লাউ| মানে তাকে ঝুড়িও আঁকতে হবে, লাউও আঁকতে হবে| মেয়েটির ডাউনস সিনড্রোম এবং সে slow learner| এ ধরনের বাচ্চাদের মস্তিষ্কে শব্দধারণ ক্ষমতা কম| সেইহেতু স্মৃতিও কম। তাই রোজকার দেখা বস্তুগুলোকে আগে শেখাতে হয় এবং ছবি বা real object সামনে রেখেই শেখাতে হয়| তাতে করে ওই বস্তুগুলো শিশুর মনে একটা স্থায়ী ছাপ ফেলে| এমন শিশুর ক্ষেত্রে স্থায়ী মানে লম্বা একটা ছাপ– যতদূর সে ছাপ বাড়ে ততই শুভ তার পক্ষে| শেখাটা আর সে ভোলে না| চারপাশকে বুঝতে পারে– সাজানো দ্রব্য নির্বাচন করতে পারে এবং কোনটার কী দরকার ধরতেও পারে|
গরমকাল চলছিল| তাই ঋতুর সাথে মিলিয়ে কিছু দরকারী সবজি শেখাব ঠিক করলাম| বললাম– “দ্যাখ –এখন তো গরম! বাজারে তো এসময় লাউ ওঠে| সবুজ সাদা mixed রঙের লাউ? দেখছিস তো রোজ? ওই আঁক ঝুড়ি ভর্তি করে– দোকানি যেমন করে থরে থরে সাজিয়ে রাখে!”–মেয়েটির আঁকার হাত বড় ভালো| ঝুড়ি আঁকল| তারপর ঝুড়ির মাঝে বসালো একটা বড় লাউ| তখনো রঙ করেনি|
হঠাৎ দেখি লাউয়ের চারপাশের পেন্সিল টানা বাঁকগুলোকে আরো বেঁকিয়ে চুরিয়ে দিচ্ছে| কান মুলব ভেবেও থমকালাম| দেখলাম লাউটা তার রং পেন্সিলে আস্তে আস্তে মেঘ হয়ে যাচ্ছে| জলও পড়ছে মেঘ দিয়ে| টপটপ করে|
জল আঁকাও শেষ হল| লাউ যখন পুরো মেঘ হয়ে গেছে, ঠিক তখনই তলার ঝুড়িটা মুছতে লাগল রবার দিয়ে| হাত চেপে ধরলাম| বললাম–“না, কিছু মুছতে পারবি না| ঝুড়িটাকেও ফিট কর মেঘের মানানসই করে|”
এবার সে আঁকলে ঠিক তারই মত দুই বেনীওয়ালা একটা মেয়ে আর বড় চুলওয়ালা একটা মাকে| মায়ের মাথায় ছাতার মত উল্টে এঁকে দিল ঝুড়িটা| আর ঝুড়ির মাথায় কটা উডপেন্সিলের ফুটকি| শেষ বারিপাত|
ততক্ষণে সে মেয়ের কল্পনা আমায় পেয়েছে| এবার কল্পনা আর পাগলামিতে মাখামাখি হচ্ছে আমার আঙুল| ছবির মা– ছবির মেয়ের হাতে বসাতে লাগলাম গোছা গোছা চুড়ি|
— “দ্যাখ রে মেয়ে গোল হাতে চুড়ি গলিয়ে তুই হলি এক গ্রামের মেয়ে আর আমি ভিনদেশী এক দিদিমণি| এই ধর রাজস্থানের কোনো গাঁ| চ– তোর ঝুড়ি এবার ফিট হয়ে গেছে| চ -অ -অ- হরিণবেগে চলব এবার ঝুড়ি মাথায় দিয়ে| কী বৃষ্টি! কী বৃষ্টি! ভিজে মরবি! ধেয়ে চল মাঠ ধরে!”
ওপারে শয়ে শয়ে দরজা খুলছে! মত্ত বায়ু| একদম দামামা| মা মেয়ের চুলফুল উলুখাগড়া|
রোজকার জীবন থেকে কেমন আকরে চলে যাও !
ফুল তোলো , সুবাস দাও , যত পার ।
সময় কম ।
আহা, চারিদিকে বিন্দু বিন্দু হাসি ধরে পড়ছে মেয়ের আর তার মা?
শিশুর কল্পনা এবং সেই কল্পনা থেকে তার সৃষ্টি আপনি অত্যন্ত দক্ষভাবে শব্দের মালায় সাজিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন ময়ূরী । মুগ্ধতা আর মুগ্ধতা …
বাহ্ ঐ মেয়ে নিশ্চয় একদিন একঝুড়ি স্বপ্নময় মেঘ এনে বৃষ্টি ঝরাবে ।
আমি ডাক্তার নই । আমি ডক্টরেট। তাই যেটুকু আমার বোধশক্তির উন্মেষ পড়াশুনার মাধ্যমে শিশুর কল্পনার বিকাশ ঘটাতে পারেন সর্বাগ্রে শিশুটির মা। মায়ের সানিধ্য শিশুটিকে আলোকের দেশে নিয়ে যায় । আর আছেন স্নেহশীলা ময়ূরী মিত্ররা যারা শিশু বিকাশের পথ বিজ্ঞান সম্মতভাবে পরিবেশিত করেন , শিক্ষা প্রদান করেন জ্যোতির্ময় আগামীর পথের নিশানা দেখান।
এই স্বপ্ন ফেরি করা দিদিমণি র হাতে থাকুক যাদু কাঠি, যা দিয়ে এই শিশুদের সব স্বপ্ন পূরণ….
তুমি বাচ্চাগুলোর চোখে কল্পনার মায়াজাল বুনে কেমন আগলে রাখো ওদের বাস্তবের কঠোরতা থেকে। আর এত সুন্দর তোমার বর্ণনা যে আমাদের চোখেও সেই কল্পনার ছবি আঁকে যেন তাকে ছুঁতে পারি ধরতে পারি সহজেই।
শিশুর কল্পনার কোন পরিধি হয়না, তাইতো কল্পনার দমকা হাওয়ায় সব দরজা খুলে যায়….ঝরে পরে বৃষ্টি !!
এ ভাবনা শুধু তুমিই ভাবতে পারো ❤