কলকাতার সাহেবি ইস্কুলে লেখাপড়া, তারপর কলকাতা মেডিকেল কলেজ – পরবর্তীতে ইউপিএসসি দিয়ে দিল্লীর ঝাঁচকচকে হাসপাতাল – তারপর? না, এক ডাক্তারবাবুর মাথার পোকা নড়ে ওঠে – আর অ্যান্টিক্লাইম্যাক্স – দিল্লী ছেড়ে কলকাতা থেকে দূরে, দক্ষিণ চব্বিশ-পরগণা জেলার ডায়মন্ডহারবার মহকুমা, সেখানকার বেলপুকুর গাঁ – গণ্ডগ্রামে বসে ডাঃ অনিরুদ্ধ সেনগুপ্ত হয়ে ওঠেন ‘গাঁয়ের ডাক্তার’ – এই বই, এক গাঁয়ের ডাক্তারের গল্প (প্রকাশক – গুরুচণ্ডা৯), তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা, একান্ত নিজের স্টাইলে বলা নিজের গল্প।”
এসে কাজ করতে শুরু করার প্রথম দিনেই মহা গণ্ডগোল লেগে গেল। আমাদের হাসপাতালের ড্রেনটা যেখান দিয়ে বেরোচ্ছে সেখানে এক স্থানীয় বাসিন্দা বাগান করে বসে আছে, ফলে ড্রেনের জল বেরোচ্ছে না, জমা হচ্ছে হাসপাতালের সামনে আর ভিতরে। ড্রেনটা পরিষ্কার করতে লোক পাঠিয়েছিলাম, খানিক বাদে আমার কাছে খবর এল, সেই বাগান করনেওয়ালা মদ খেয়ে তাকে মারতে এসেছে। গেলাম সেদিকে, খানিক তর্কাতর্কি হল, তারপর বাগানবাবুর গালে সপাটে এক থাপ্পড় লাগিয়ে দিলাম। ভারি খারাপ কাজ বোধহয়, কিন্তু তার নেশা গেল ছুটে এবং ড্রেন পরিষ্কার করতে তারপর কারো কোনো অসুবিধা হয়নি। আর গ্রামে গ্রামে সেই বার্তা রটে গেল ক্রমে, চার বছর পরে এক ছোকরা ডাক্তার এসেছে ঠিকই, কিন্তু শাxx মহা বদমেজাজি। ফলে আমাকে ঘাঁটানোর দুর্বুদ্ধি বিশেষ কারো হয়নি।”
দীর্ঘ উদ্ধৃতির জন্য মার্জনা করবেন, কিন্তু এক ব্যতিক্রমী চিকিৎসক গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রটির ভোল বদলে দিয়েছিলেন ঠিক কীভাবে – কী অনায়াস ভণিতাহীন দক্ষতায় সেই গল্প শুনিয়েছেন তিনি নিজেই – উপরের অংশটুকু থেকে আন্দাজ পাওয়া যেতে পারে।
ঘোরতর সরকারপন্থীরাও মানবেন, দেশ তথা রাজ্যের স্বাস্থ্যব্যবস্থার অবস্থা যে খুব ভালো নয়। কিন্তু, কেন এই হাল? সরকার বলবেন, ডাক্তার পাওয়া যায় না। ডাক্তারবাবুরা বলবেন, গ্রামীন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পরিকাঠামোর যা হাল, তাতে কিছুই করা যায় না – রেফার করা বাদ দিয়ে কিছুই করার নেই, উল্টে পাব্লিকের গালি শোনা। ডাক্তারবাবু যদিও বা আসেন, বেশীদিন টেকেন না – সাধারণ মানুষও পারতপক্ষে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ভরসায় থাকেন না – হাতের কাছে হাতুড়েদের উপরেই ভরসা করেন, জটিল কিছু হলে বেশ কিছুদূর পাড়ি দিয়ে মহকুমা বা জেলা হাসপাতালে হাজির হন – অথবা, ছোট নার্সিং হোম।
বাজারচলতি এই প্রবাহের বিপরীতে রুখে দাঁড়ানোর প্রয়াস খুব সুলভ নয় – এবং, একক প্রয়াস।
ডাঃ সেনগুপ্ত যখন বেলপুকুর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে হাজির হলেন, পরিকাঠামো বলতে তিনি একমেবাদ্বিতীয়ম ডাক্তার – সাথে একজন নড়বড়ে নার্স, যাঁর দুচোখে ছানি। চারজন চতুর্থশ্রেণীর কর্মচারী – একজন মাধ্যমিক পাশ, সেই সুবাদে আংশিক ফার্মাসিস্ট। ডাক্তারের থাকার কোয়ার্টার বলতে একখানা ভাঙাচোরা বাড়ি, যাতে কেউটে সাপের বাসা। হাসপাতাল চত্ত্বরে ইলেকট্রিকাল ট্রান্সফরমার – কিন্তু, হাসপাতালে বিদ্যুৎসংযোগ বিচ্ছিন্ন।
সোজা পথে সমাধান সহজ নয়। হাসপাতাল চত্ত্বরের ট্রান্সফরমার থেকে হাসপাতালে বিদ্যুৎসংযোগ পেতে দীর্ঘ সরকারি পদ্ধতি – একটি হাসপাতাল বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন থাকার সমস্যা নিয়ে ভাবিত নয় কেউই। শর্টকাট সমাধান ধরলেই সবার টনক নড়ে – নিয়মের পথও অমনি সরল হয়ে যায়। হাসপাতালে বাতি জ্বালানোর কেরোসিন, রোজকার প্রয়োজনের ওষুধের স্টক – সমস্যা সর্বত্র – রীতিমতো তেড়িয়া পদ্ধতিতে সমাধান খুঁজেছেন ডাক্তারবাবু – বর্ণনাও ভারী সরস।
ব্যবস্থাকে দুষে সকলেই দায় এড়ান – অবশ্যই ব্যবস্থায় খামতি আছে – কিন্তু, সমাধানের পথ সিনসিয়ারলি খোঁজেন কজন?
স্পষ্টভাষায় জানিয়ে রাখা যাক, এই বই পড়ে যদি কেউ এই উপসংহারে পৌঁছান, যে, কেবলমাত্র সদিচ্ছা থাকলেই সব সমস্যার সমাধান সম্ভব, সেটা বড় ভুল হবে। গণ্ডগ্রামের টিমটিম করে চলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ভোল বদলে দিতে পেরেছেন ডাঃ সেনগুপ্ত কত অনায়াসে – যেখানে প্রায় কিছুই হত না, এমনকি রোগীরাও আসতেন না, সে অবস্থা থেকে সচল স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ছোট থেকে মাঝারি অপারেশন চালু হয়ে গেল, এমনকি কিছু জটিল অপারেশনও সম্ভব হতে পারল – অসাধ্যসাধনের গল্প এমন ক্যাজুয়াল ভাষায় শুনিয়েছেন লেখক – প্রায় ম্যাজিক।
কিন্তু, শুধু সদিচ্ছে দিয়ে সবটুকু হয় না, হতে পারে না। সদিচ্ছের সাথে যুক্ত ছিল অসম্ভব মানসিক শক্তি, অকুতোভয় মানসিকতা, চূড়ান্ত আত্মবিশ্বাস, আশ্চর্য লিডারশিপ কোয়ালিটি এবং, অবশ্যই, অসামান্য দক্ষতা। ডাঃ সেনগুপ্তের গল্প অসাধ্যসাধনের গল্প – অনেককে অনুপ্রেরণা জোগাতে পারে, এমন গল্প, নিশ্চিত – তবু মনে রাখা জরুরী, যেকোনো মোটিভেশনাল কাহিনীর মতোই, সে কাহিনীর হুবহু পুনর্নিমাণ সকলের পক্ষে সম্ভব নয় – বিশেষ করে আরোই সম্ভব নয়, যখন ডাক্তারের ওপর রোগীর ভরসা কমছে এবং উল্টোটাও সমান সত্য (কোনটা আগে ঘটেছে এবং কেন ঘটেছে, সে বিতর্কে ঢুকছি না) – যখন সামান্য ত্রুটিতেও পরিজন চড়াও হচ্ছেন চিকিৎসকের উপরে – ঝুঁকি নিতে চাইবেন কে?
এই চটিবই, ডাঃ সেনগুপ্তর এই বয়ান, এক গণ্ডগ্রামে এক সামান্য ডাক্তারের অসাধ্যসাধনের গল্প, অনায়াসে, প্রথাগত সীমা ছাড়িয়ে বৃহত্তর পরিসরে এসে পড়ে – অনেক বড় প্রশ্নমালার দিকে নিয়ে যায় আমাদের, যাদের উত্তর মেলা সহজ নয়।
যেমন, রোগীর স্বার্থ, শুধুমাত্র রোগীর স্বার্থেই ডাক্তার কতখানি ঝুঁকি নিতে পারেন? বা, অন্যভাবে বলতে গেলে, শুধুমাত্র রোগীর স্বার্থ মাথায় রেখে চিকিৎসক কি নিয়মের ব্যতিক্রম করতে পারেন? উত্তরটা অবিমিশ্র অস্তিবাচক হলে, শেষমেশ যদি হিতে বিপরীত হয়, সেক্ষেত্রে? চিকিৎসা আর চিকিৎসকের বিচার হয় আদালতে – যেখানে চিকিৎসক শুধুই রোগীর স্বার্থে বড় ঝুঁকি নিয়েছিলেন, অন্য স্বার্থচিন্তা ছিল না তাঁর, একথা প্রমাণ করা তো সহজ হয় না। তাহলে? ডাঃ সেনগুপ্ত বলবেন, না, ভালোর জন্যে প্রথার বিপ্রতীপে যাওয়ার মধ্যে কোনো ঝুঁকি নেই – কিন্তু, সকলে একমত হবেন কি?
আবার, তার ঠিক উল্টোদিকে, যেখানে ঝুঁকি না নেওয়ার অর্থ গরীবগুর্বো মানুষগুলোর তিলে তিলে বিনা চিকিৎসায় মরে যাওয়া – রেফার হয়ে বড় হাসপাতালের সুদীর্ঘ লাইনের পেছনে খাড়া হয়ে প্রতীক্ষা করা, আর শেষমেশ প্রতীক্ষায় খেই হারিয়ে নিয়তির হাতেই আত্মসমর্পণ করা – সব ডাক্তারবাবু যদি সেফ খেলতে চান, তাহলে সাধারণ মানুষ যাবেন কোথায়?
ডাঃ সেনগুপ্ত খুব অনায়াসে নিজের রাস্তা বেছে নিয়েছিলেন – সেই পথের গল্প অসামান্য ঝরঝরে ভাষায় বর্ণিত হয়েছে এই চটি বইয়ে – কিন্তু, এই বই পড়তে বসে প্রশ্নহীন থাকা মুশকিল। চিকিৎসকের কর্তব্য কী? চিকিৎসকের দায়বদ্ধতার সীমানা কতদূর অব্দি? বিপাকে পড়লে, আদালতের কাঠগড়ায় রোগীর স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার আদালতগ্রাহ্য যুক্তি প্রমাণ করতে পারবেন তো চিকিৎসক?
সরকারি আধিকারিকরা যদি ডাক্তারের পাশে দাঁড়াতেন শর্তহীন – যেমন ছিলেন এই বইয়ে উল্লেখিত ডাঃ অনিরুদ্ধ কর – তাহলে অবশ্য কর্তব্যপরায়ণ চিকিৎসকদের মনে এত ডাইলেমার উদয় হত না।
তরতরে লেখা। চমৎকার ছাপা, বাঁধাই। ভারী সুন্দর প্রচ্ছদ। চটি বই। পড়েই দেখুন না।
এক গাঁয়ের ডাক্তারের গল্প,ডাঃ অনিরুদ্ধ সেনগুপ্ত, প্রকাশক – গুরুচণ্ডা৯। দাম – নব্বই টাকা
শ্রদ্ধেয় sir, প্লিজ এই বইয়ের pdf আপলোড করে দিন এই সাইটে
নুতন বই তবু সাহস করে বলছি যদি pdf পাওয়া যেত এই সাইটে, ভালো ছিল ।
মাত্র নব্বই টাকা তো দাম – ডিসকাউন্ট দিয়ে আরো কম। অনলাইনেও পাওয়া যায়।
কতো টাকা তো এদিক-ওদিক চলে যায়। কিনে দেখুনই না, প্লীজ। নিজেও পড়বেন – অন্যকে পড়াতেও পারবেন।
Online buy korar link ta din ?