সালটা ১৯৯৫ হবে। আর জি কর হসপিটালের মনোরোগ বিভাগে নিয়মিত যাই কেস দেখতে। সেইখানে আমি প্রথম দেখি সেই অন্য নারীকে, যার গল্প আমি আজ আপনাদের শোনাতে বসেছি।
ইনপেশেন্ট থেকে সাইক্রিয়ট্রিতে রেফার হয়ে এল বছর ষোলোর এক কিশোর। টুকটকে ফর্সা রং, ছিপছিপে চেহারা। কেস হিস্ট্রি দেখে চক্ষু চড়ক গাছ। সে নিজের যৌনাঙ্গ কেটে বাদ দিয়েছে। তাই তাকে ভর্তি করা হয়েছে আর জি কর হসপিটালে। ডাক্তাররা তাকে প্রাণে বাঁচিয়েছেন। কিন্তু মানসিকভাবে সে খুবই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। কথা বলে জানলাম তার মনোবেদনার কারণ সে গভীরভাবে বিশ্বাস করে সে আসলে একজন নারী, কিন্তু ভুল বশত: জন্মগতভাবে সে পুরুষের শরীর পেয়েছে। এই জন্য তার আক্ষেপের শেষ নেই। ছেলেটি কিছুতেই তার পুরুষাঙ্গ মেনে নিতে পারে না। তার সমস্যার কথা বাড়ির লোক কেউ বুঝতে চায় না। সমাজ, পরিবার সবাই তার বাইরের চেহারা দেখে ভাবে সে পুরুষ। আকুল হয়ে সে প্রশ্ন করে– বলো দিদিমণি, আমায় দেখে তোমার পুরুষ মনে হচ্ছে? তার মেয়েলি কথা বলার ধরণ, তার চোখের চাউনি সব কিছু দিয়ে সে প্রকাশ করছে তার একান্ত নিজস্ব সত্তার গভীরে লুকিয়ে থাকা এক অন্য নারীর গল্প।
কেসটা আজকের ডি এস এম 5 ক্লাসিফিকেশন অনুযায়ী জেন্ডার ডিস্ফোরিয়া। তবে কি এমন মনে হওয়া মানসিক রোগের লক্ষণ? আমেরিকান সাইক্রিয়াট্রিক আসোসিয়েশন এক্ষেত্রে
সময়ের সঙ্গে এগিয়ে যাওয়া প্রগতিশীল সমাজের দর্পন হিসাবে কাজ করেছে। তাই এই মনে হওয়াকে তাঁরা মোটেও মনের রোগ বলে চিহ্নিত করেন নি। যেটা বলা হয়েছে, তা হল লিঙ্গ সম্বন্ধে এমন অসঙ্গতির বোধ থাকলে মানুষটার যদি সার্বিক মর্মপীড়া (distress) দেখা দেয় তখন তাকে
মনোরোগের আওতায় আনা হবে।
এমন মানুষদের মানসিক চাপের যথেষ্ট কারণ আছে। কারণগুলো পর্যালোচনা করার আগে যৌন পরিচয় আর লিঙ্গ পরিচয় সম্বন্ধে ধারণা পরিস্কার হওয়া প্রয়োজন। কোন মানুষের যৌন পরিচয় (sex) বলতে তার বিভিন্ন দিক থেকে অর্থাৎ হরমোন, ক্রোমোজমের বৈশিষ্ট্য, শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ার দিক থেকে সে নারী না পুরুষ তা বোঝায়। কিন্তু লিঙ্গ যেন নারী বা পুরুষ নামের নির্মিত এক সত্ত্বা। সমাজ, পরিবার, ব্যক্তি নিজে তার আচরণ, তার সামাজিক অবস্থান দিয়ে গড়ে তোলে। শুধু যৌনাঙ্গের গঠন বা কাজ করার পদ্ধতি নয়, তার মানসিক গঠনের ওপরে নির্ভর করে সে পুরুষ না নারী। এ তার লিঙ্গ (gender) পরিচয়।
জেন্ডার আইডেন্টিটি নিয়ে বিপর্যয় তখনই হয় যখন কোন মানুষের যৌন পরিচয়ের সঙ্গে সে তার লিঙ্গ পরিচয়কে মেলাতে পারে না। ছোট থেকে তার যৌন পরিচয়ের ভিত্তিতে তার লিঙ্গ পরিচয় নির্মাণের যে নির্দিষ্ট বাঁধা গৎ আছে তার মুখোমুখি হতে হয় তাকে। পোশাক তার মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
একটু বড় হলে সে নিজের বিশ্বাস অনুযায়ী সাজগোজ করতে চায় যা তার যৌনপরিচয়ের
ঠিক বিপরীত। গোল বাঁধে তখনই। সমাজ হায় হায় করে ওঠে, পরিবারের মাথায় বাজ ভেঙে পড়ে। মিলছে না তো। পুরুষের যেমনটা হওয়ার কথা তেমন তো হচ্ছে না। বা নারী হয়ে এমন ছেলে ছেলে ভাব তো হওয়া শোভনীয় নয় তো কিছুতেই।
চলে অত্যাচার, মারধোর, হেনস্থা। তার ওপর নারী হয়েও পুরুষ শরীরে বন্ধ বা পুরুষ হয়ে নারী শরীরে বন্ধ থাকার যন্ত্রণা তো আছেই। সেই যন্ত্রণা থেকেই তো যৌনাঙ্গ কেটে ফেলার মতো এমন জীবননাশা হঠকারী সিদ্ধান্ত।
অনেকে বলে উঠবেন আরে এতো জানা বিষয়। এতো ট্রান্সজেন্ডারের গল্প বলছেন। যদি এমনটা ভাবেন তবে কিন্তু একটু ভুল হচ্ছে। ট্রান্সজেন্ডার যাঁরা তাঁদের মধ্যে জন্মগত ভাবে শারীরবৃত্তীয় দিক থেকে নারী পুরুষ উভয়ের যৌন বৈশিষ্ট্য থাকে। কিন্তু জেন্ডার ডিস্ফোরিয়ায় বায়োলজিকালি মানুষটা নারী কিংবা পুরুষ। কিন্তু মানসিক ভাবে তার সত্ত্বার সঙ্গে এই যৌন পরিচয়ে সে খাপ খাওয়াতে পারে না। ডি এস এম 5-এ বাচ্চাদের এবং কিশোর কিশোরী ও পূর্ণবয়স্কদের জেন্ডার ডিস্ফোরিয়ার সমস্যাকে আলাদা শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে। কারণ বয়সের সঙ্গে সঙ্গে এই সমস্যার রূপ বদলাতে থাকে। অনেক সময় বয়স বাড়ার সঙ্গে অনেক বাচ্চা এই সমস্যা অতিক্রম করে উঠতে পারে।
চিকিৎসা
এই মানুষগুলো ডিপ্রেশন ও আংজাইটির শিকার হয় খুব সহজেই। আত্মহত্যার সংখ্যাও এনাদের মধ্যে অনেক বেশি। তাই সাইকোথেরাপির মাধ্যমে নিজের সম্বন্ধে সচেতনতা তৈরির চেষ্টা করা যেতে পারে। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিজের ওপর আস্থা রাখার ট্রেনিং বিশেষ কার্যকরী হয়। পরিবারের সদস্যদের গ্রুপ বা ফ্যামিলি থেরাপির মাধ্যমে তাদের সাপোর্ট সিস্টেম পোক্ত করা চলতে পারে।
তাছাড়া হরমোনের চিকিৎসা বা সেক্স চেঞ্জ করার চিকিৎসা করা যেতে পারে।
এতো গেল শরীর বা মনের চিকিৎসা। কিন্তু আমাদের মননে, চিন্তায়, বিশ্বাসের পরিকাঠামোতে যে দগদগে ঘা হয়ে আছে তার প্রতিকার কি আছে? মুখে আমরা নিজেদের যতই প্রগতিশীল বলি আজও আমরা ট্রান্সফোবিয়ার শিকার। যখন তারা কোন পথ দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে, অসুস্থ হয়েছে, যৌন নির্যাতনের বলি হয়েছে ছুটে গিয়েছে চিকিৎসার আশায়। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে এমন খবর রিপোর্টেড হয়েছে যেখানে তাঁরা চিকিৎসা পান নি বা অনেক দেরিতে পেয়েছেন। কারণ এঁদের প্রতি ঘৃণা, ভয়, বিশেষ রকম নেতিবাচক মনোভাব কাজ করে এমনকি চিকিৎসা পরিষেবায় জড়িত মানুষদের মধ্যেও। এই ট্রান্সফোবিয়ার কারণ শুধুই এই যে তারা প্রচলিত যৌন ধারণার থেকে আলাদা?
ঘটা করে আইনসিদ্ধ করা হয়েছে তাদের অধিকার।
তৃতীয় লিঙ্গ বলে চিহ্নিতও করা হয়েছে তাঁদেরকে। কিন্তু সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা পরিষেবা পেতে গিয়ে যখন তাকে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় সে ছেলে না মেয়ে তখন কেন তার জন্য নির্দিষ্ট করা হয় না ওয়ার্ড।
এই গভীর ক্ষতের চিকিৎসা না করলে আমরা সত্যিই কি নিজেদের প্রগতিশীল ভাবতে পারি? মনে পড়ে যায় সেই অন্য নারীর ব্যাকুল বিহ্বল প্রশ্ন, আমি কি মেয়ে নয়, বলুন দিদিমণি।
অসাধারণ ।
?