– ডাক্তারবাবু, ওষুধগুলো হসপিটালেই পাওয়া যাবে তো?
– হুঁ। টেবিল থেকে মুখ না তুলেই বললাম। খসখসিয়ে প্রেসক্রিপশন লিখছি। আজ একদমই কথা বলার সময় নেই। সবার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে আউটডোর শেষ করতে সন্ধ্যে হয়ে যাবে। আর, সেক্ষেত্রে আইসিইউ-র প্রথম বেডটা আমার জন্যই রেখে দিতে হবে।
টেবিলের ওপার থেকে আবার অনুরোধ– হসপিটালের ওষুধই লিখবেন ডাক্তারবাবু। বাইরে থেকে কিনতে পারবো না।
এমনিতে ঘাড়ের ওপর তিনজন করে পেশেন্ট উঠে যাচ্ছে। তার ওপর এসব কথা শুনে মেজাজটা খাপ্পা হয়ে উঠল। ওষুধ কেনার সামর্থ্য থাক বা নাই থাক, সরকারি হাসপাতালে বসে খুব অসুবিধেয় না পড়লে পারতপক্ষে কখনও বাইরের ওষুধ লিখি না। লেখার নিয়মও নেই। একটু রুক্ষ ভাবেই জবাব দিলাম– সেটা মনে না করিয়ে দিলেও চলবে। সাধ করে লেখা তো দূরের কথা, আপনি বাইরের ওষুধ লিখতে বললেও লিখতাম না।
– রাগ করবেন না ডাক্তারবাবু। ওভাবে বলতে চাই নি। আমার আজ ওষুধ কেনার ক্ষমতাও নেই।
পেন থামিয়ে মুখ তুলে দেখলাম। প্রৌঢ়া ভদ্রমহিলা। চুলে রূপোলী রেখা পড়তে শুরু হয়েছে। চোখে বাদামী ফ্রেমের চশমা। ভদ্রমহিলার সাথে সাত বছর বয়সের নাতি। কথাবার্তা-বেশভূষায় রুচির ছাপ স্পষ্ট। শুধু চোখগুলো যেন বেমানান ভাবে বসে গেছে। দীর্ঘদিন উপবাস বা রোগভোগের পর যেমন হয়। মেলাতে পারলাম না। আমার রোগীদের মধ্যে গ্রাম্য ভাষায় কথা বলা প্রান্তিক মানুষজনই বেশি। ভদ্রমহিলার বাহ্যিক আচরণের সাথে ‘ওষুধ কেনার ক্ষমতা নেই’ কথাটা বড্ড বেমানান লাগল। অভিজ্ঞতা বলে, এসব ক্ষেত্রে বেবিফুড কিংবা ভালো কোম্পানির হজমের ওষুধ লিখে দেওয়ার অনুরোধ আসে। কিন্তু… ভদ্রমহিলার কথায় চিন্তার জট কাটলো– ছেলে একটা কোম্পানির কাজ করতো। লকডাউনে গাড়িঘোড়া বন্ধ ছিল। বাইকে যাতায়াত করতো। যেতে আসতে চারঘন্টা। ফাঁকা রাস্তায় সাঁইসাঁই করে লরি ছুটতো। সেই লরিতেই…
ভদ্রমহিলা ফোঁপাতে শুরু করলেন।- চারবার পাক খেয়ে উল্টে পড়েছিল। শিরদাঁড়াটা কত টুকরো হয়েছিল ইয়ত্তা নেই। বাড়ির একমাত্র রোজগেরে ছিল ডাক্তারবাবু।
মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিল। ত্রাতা আবার সেই মুখোশের আড়াল। নির্বাক পাথরের মতো বসে আছি। চারপাশের হাজারো কোলাহলের মধ্যেও কেমন যেন থমথমে নিস্তব্ধতা!
– নাতিটা আমার বড় অল্প বয়সে অনাথ হয়ে গেল বাবা।
অজান্তেই একবার বাচ্চাটার নামের দিকে চোখ গেল। নামের শেষে যে পদবী সেটা সমাজের তথাকথিত হিসেবে উচ্চবর্ণে পড়ে। জানি, বিশুদ্ধবাদী মাত্রই এ কথা পড়ে আমার মুন্ডুপাত করবেন- “বলেছিলাম না, সব ব্যাটারাই পদবী দেখে চিকিৎসা করে।” সে তাঁরা বলুন। আমি নিজের কাছে পরিষ্কার, জীবনে কোনোদিন জাতি-লিঙ্গ-ধর্ম-বর্ণের ভিত্তিতে চিকিৎসা করি নি। শুধু এটুকু বুঝতে পারলাম, ছেলেটির সামনে পড়ে থাকা আদিগন্ত পথ ভীষণরকম বন্ধুর হয়ে গেল। ভোটসর্বস্ব, সুবিধেবাদী রাজনীতি এ শিশুর জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখে নি। তিন-চার পুরুষ সুবিধে নেওয়া ক্রিম লেয়ারের এসি গাড়ি রাজপথ দিয়ে হাওয়ার গতিতে ছুটে যাবে। হয়তো তার পাশের ফুটপাথ দিয়েই এ শিশু অনন্ত পথ চলবে। সুখতলা ক্ষয়ে যাওয়া জুতো, ঘামে ভেজা শার্ট, টেনেটুনে মাসকাবারি। অথবা…
– ডাক্তারবাবু, প্রেসক্রিপশনটা দেবেন না?
স্থাণুবৎ বসে থাকতে থাকতে প্রেসক্রিপশন ফেরত দেওয়ার কথা ভুলেই গেছিলাম। বাচ্চাটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম– ভালো থাকিস বাবা। অনেক বড় হ।
ঘাড় নেড়ে সে চলে গেল। সাদার ওপর কালো গুটি দেওয়া শার্ট। চুলগুলো উস্কোখুস্কো।
ডানা মেলে দে অচেনা ছেলে! উঁচু পৃথিবীতে অনেক বৈভব, অনেক প্রাচুর্য। তুই সেসব পাবি না। তোর জন্য খুব সম্ভবত মইও ধরবে না কেউ। তোর শুধু একটাই ভরসা। ঘাম। আজ থেকে বুক বেঁধে ফেল। তুই পাথর গলানোর ক্ষমতা রাখিস। মুঠো আলগা করিস না অচেনা ছেলে! মারীর দেশ তোর কাছে নতজানু হওয়ার অপেক্ষায়…
দারুন লেখা।